পরকীয়া: সম্পর্কের মধু না বিষ!

কামরুল আহসান

ট্রয়ের নির্বাসিত রাজপুত্র প্যারিস আশ্রয় পেলেন স্পার্টার রাজপুত্র মেনিলাসের বাড়িতে। ভালোই যাচ্ছিল তার দিন-কাল। নিরাপদে-নিশ্চিতে। হঠাৎ তার শান্তিতে বিঘ্ন ঘটালেন মেনিলাসের পরমা-সুন্দরী স্ত্রী হেলেন। হেলেনের এমনই অপার্থিব রূপ যে দেবতারও তার গুনগান গাইতেন। আর প্যারিস লক্ষ্য করলেন হেলেনের মধ্যে কীসের যেন বিষাদ! মেনিলাসের সাথে তার যেন ঠিক বনিবনা হচ্ছে না। আকারে-ইঙ্গিতে প্রথমে হেলেনকে নিজের আকুতির কথা বোঝান প্যারিস। কিন্তু হেলেন প্রথমে পাত্তা দেননি তাকে। কিন্তু প্যারিসও সুপুরুষ কম না। অসুখী নারীদের ভুলানোর মতো কথাবার্তা ভালোই জানেন। আস্তে আস্তে প্যারিস হেলেনকে পটিয়ে ফেললেন। মেনিলাসের অনুপস্থিতে একদিন হেলেনকে নিয়ে রওয়ানা হলেন নিজের রাজ্য ইলিয়ামে। বাড়ি ফিরে মেনিলাস যখন এই খবর শুনলেন প্রচণ্ড রাগে ফুঁসে উঠলেন। দ্রুতটা কথাটা জানালেন বড় ভাই মাইসিনীয়ের রাজা অ্যাগামেমনকে। অ্যাগামেমন তো আরো আগুন! এই অপমান তো মেনে নেয়া যায় না। তিনি দ্রুত খবর দিলেন সমস্ত গ্রিক বীর-সৈনিকদের। বিশাল এক রণবহর নিয়ে যাত্রা করলেন ট্রয়ের উদ্দেশ্যে। দশ বছর ধরে যুদ্ধ চলল গ্রিক আর ট্রোজানদের। এই যুদ্ধে ট্রয় ধ্বংস হয়ে গেল। এই যুদ্ধকে ভিত্তি করে রচিত হলো হোমারের অমর মহাকাব্য- ইলিয়ড!

মহাকবি হোমার রচিত ‘ইলিয়াড’ মহাকাব্য অবলম্বনে ভোলফগাং পিটারসেন পরিচালিত ‘ট্রয়’ ছবির দৃশ্যে হেলেন ও প্যারিস। তাদের পরকীয়া প্রেমের কারণে একটি সামাজ্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, সহস্র বছর ধরে ইলিয়ামের শোকগাথা গাইছে মানুষ। একটি পরকীয়া সম্পর্কের কারণে একটি রাজ্য ধ্বংস হয়ে গেল! কত কত মানুষের জীবন! পরকীয়া সম্পর্ক নিয়ে প্রাচীনকাল থেকেই ধর্ম-দর্শন-পুরাণে নানা আলাপ-আলোচনা চলছে। সমস্ত ধর্মেই পরকীয় সম্পর্ক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারপরও যুগে যুগে পরকীয় চলছে নানা আকারে। হাল আমলে পরকীয়া প্রায় মহামারীর আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে এই বাংলাদেশে। যখন হাতে হাতে মোবাইল-ইন্টারনেট-ফেসবুক। নিষিদ্ধ ঘরে প্রবেশ এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে।

এক সময় ভারতবর্ষে, এই বাংলায়, উনবিংশ শতাব্দীর দিকে প্রেম বলতেই বোঝানো হতো পরকীয়া সম্পর্ক। কারণ, তখন মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত অল্প বয়সে। পুরুষদের বয়স হতো মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি। হয়তো স্বামীদের সাথে স্ত্রীদের ঠিক মতো বনিবনা হতো না, কিংবা স্বামী হয়তো মারাই যেত বয়সজনিত বা অন্য কোনো কারণে; কিন্তু বিধবাদের পুনঃবিয়ে-প্রথা তখন প্রচলিত ছিল না; ফলে বাধ্য হয়েই নারীদের তখন পরকীয়া সম্পর্কে জড়াতে হতো আশেপাশের যুবকের সাথে; তাই পরকীয়া সম্পর্কটিকে দেখা হতো ব্যাভিচার হিসেবে। এর ফলে একটি নারী বা একটি পরিবারের জীবনে কীরকম দুর্ভোগ নেমে আসতো তা দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে।

বর্তমান সময়ে পরকীয়া সম্পর্কটি যেন অনেকটা বিনোদনের মাত্রা পেয়েছে। বৈবাহিক সম্পর্কে একটু ক্লান্তি এসে গেলে, একটু ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হলেই অনেকে একটি বা ততোধিক অবৈধ দরজা-জানালা খোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে যান। কিন্তু তার ফল কী হয়? ট্রয়ের মতো যুদ্ধ হয়তো বাঁধে না, কিন্তু তাতে করে একটি পরিবারে ঠিকই যুদ্ধ শুরু হয়, আর তার ফলে একটি পরিবার ট্রয় নগরীর মতো ধ্বংস হয়ে যায়। এবং তার সবচেয়ে করুণ ফল ভোগ করে সেই পরিবারে যদি কোনো সন্তান থাকে- তারা।

পরকীয়া সম্পর্ক কি মধু না বিষ!

anna
টলস্টয়ের উপন্যাস ‘আন্না কারেনিনা’ অবলম্বনে নির্মিত বার্নার্ড রোজ পরিচালিত ছবির দৃশ্যে সোফি মার্সো ও শন বিন। পরকীয়া প্রেমের আধুনিক সময়ের সবচেয়ে করুণ পরিণতির গল্প...

প্রথমেই বলে নেয়া ভালো যে, পরকীয়া সম্পর্ক যতটা না প্রেম তারচেয়ে বেশি কামনা-বাসনা। যতটা না ত্যাগ, তারচেয়ে বেশি যৌনতা, দখল। অন্যের অধিকার দখল করে নেয়ার এই প্রবণতা অনেকটাই ইগোদ্বারা তাড়িত। অর্থাৎ দায়-দায়িত্বহীনভাবে দখলদারিত্ববোধই এই সম্পর্কের মূল চালিকাশক্তি। তাই যে-দিক থেকেই ব্যাখ্যা করা হোক- পরকীয়া বস্তুত এক ধরনের অসুস্থ সম্পর্ক। কোনো পরকীয়া সম্পর্কই শেষ পর্যন্ত শান্তি বয়ে আনে না। কাউকে না কাউকে এর বলি হতে হয়ই। হয়তো বিবাহীত নারীর স্বামীকে, বিবাহীত পুরুষের স্ত্রীকে; কিংবা, তাদের সন্তানদের। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও এতে মানহানি হয়।
কিন্তু এগুলো নীতিবাগিশ কথা। সমাজ ও জীবন কি সব সময় নীতি দিয়ে চলে!

আমরা যদি লিও তলস্তয়ের ‘আন্না কারিকানা’ উপন্যাসটি পড়ি তাহলে দেখব পরকীয়া আসলে কতখানি জটিল এক সম্পর্ক! স্বামী আলেক্সেই আলেক্সান্দ্রোভিচ কারেনিনকে ভালো লাগত না আন্নার। একটা কারণ স্বামীর কান বড়। কেমন যেন খরগোশের মতো। আসলে তা না। স্বামীর সাথে কোনোকছিুতেই বনিবনা নেই আন্নার। স্বামী তাকে সময় দিতে পারে না। সবচেয়ে বড় কথা, আন্নার যেমন শিল্প-সাহিত্যে খুব আগ্রহ, আলেক্সেই কারেনিনের তা একেবারেই নেই। ভেতরে ভেতরে মরে যাচ্ছিল আন্না। প্রেম ছাড়া কি বেঁচে থাকা যায়! যখন তিনি ভ্রনোস্কিকে দেখলেন নতুন করে বেঁচে উঠলেন। ভ্রুনোস্কি সুদর্শন, সুবক্তা, অভিজাত, আবেগপ্রবণ, রোমান্টিক। এক মুহূর্তে ভ্রুনোস্কি আন্নাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন প্রেমের জোয়ারে। স্বামী-সংসাস-সমাজ এমন কি একমাত্র সন্তানকেও ছেড়ে আন্না ভ্রনোস্কির হাত ধরে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু তাদের সেই জীবন কি সুখের হয়েছিল? কামনা-বাসনা মিটে যাবার পর সমস্ত প্রেম কর্পূরের মতো উড়ে গেল। যার কারণে আন্নাকে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিতে হলো। আন্নার এই করুণ পরিণতির বিচার আমরা কীভাবে করব? তলস্তয় বলেছেন, আন্নার বিচার করো না, পারো তো করুণা করো!

শিল্প-সাহিত্যে-চলচ্চিত্রে পরকীয়া প্রেমের পরিণতি নিয়ে অনেক শৈল্পিক উপস্থাপন হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা তো শিল্পের চেয়ে ভয়াবহ।যখন একটি-দুটি সন্তান ছেড়ে কোনো মা বা বাবা পরকীয়া সম্পর্কে জড়ান, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান তখন তাদের কী অবস্থা হয়? সন্তানের জায়গা থেকে বিষয়টি কোনোভাবেই অন্য মানুষ অনুধাবন করতে পারবে না। তাদের জীবন স্রেফ স্থায়ী এক ট্রমায় পরিণত হয়। বহু গবেষণায় দেখা গেছে ঘর-ভাঙ্গা পরিবারের ছেলেমেয়েরা খুবই কম আত্মবিশ্বাসী হয়। তারা অন্য মানুষকে আর সহজে বিশ্বাস করতে পারে না। জীবনভর তারা এক গভীর বিষাদ বহন করে চলে।
কিন্তু সন্তানদের জন্য তো বাবা-মার স্নেহ-মায়া-মমতা-ভালোবাসা কম নেই? তাও সন্তানদের কথা বিবেচনা না করে তারা পরকীয়া সম্পর্কে জড়ান কেন? শুধু নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে না, বিষয়টি যদি আমরা মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়েও খতিয়ে দেখি তাহলে অনেক অজানা বিষয়ই জানা যাবে। এ সত্য যে, যৌনতার চেয়ে বড় শক্তি মানুষের আর কিছু নেই। ফ্রয়েড এ-বিষয়ে বিস্তর গবেষণা করে দেখিয়েছেন, যৌন-অবদমনের ফলে মানুষের মধ্যে যে বিকারের সৃষ্টি হয় তার কারণে সে অনেক অনাসৃষ্টি করতে পারে। এখন যৌনতা কেবল শারীরিক সম্পর্কই না, তার সাথে অনেক মানসিক দিক জড়িয়ে থাকে। আন্না কেবল যৌনতার জন্যই ভ্রুনোস্কির হাত ধরে পালিয়েছিল বললে ভুল হবে। তার মানসিক ক্ষুধাটাই সেখানে বড় ছিল।

Ashwariya
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত ‘চোখের বালি’ ছবিতে ঐশ্বরিয়া রাই ও প্রসেনজিৎ

প্রথমে কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে, তা যদি বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়, সেখানে যদি মনের মিল না হয় তাহলে কী করা? সেই ভুল সম্পর্ক মেনে নিয়েই জীবন-যাপন করতে হবে? শুরুতেই, হুট করে ছাড়াছাড়িটা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই সম্পর্কের কয়েকটা জানালা খুলে রাখে। এক সময় দরজাও খুলে দেয়। আবার, যে- কোনো সম্পর্কের মতো দীর্ঘদিনের বৈবাহিক সম্পর্কেও ক্লান্তি আসা স্বাভাবিক। মানুষের মনটিকে সব সময় নীতি-নৈতিকতা, দায়-দায়িত্ব, সামাজিক বিধি-নিষেধ দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা, ব্যক্তি মানুষকে অবশ্যই বাঁচতে হবে। বেঁচে থাকার জন্য একটি সম্পর্ক থেকে মুক্তি নিয়ে যদি অন্য সম্পর্কে জড়াতে হয় তাও বাঞ্ছনীয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, একটি সম্পর্কে জড়িত থাকার মধ্যেও যদি কেউ অন্য সম্পর্কে জড়ায় তা অবশ্যই নিন্দনীয়। বিশেষ করে সেখানে যদি আরো সব মানুষ জড়িয়ে থাকে। নিজের ব্যক্তিগত আনন্দ, সুযোগ-সুবিধা নেয়ার জন্য কোনোভাবেই আমরা অন্য কারো জীবনকে হুমকির মধ্যে ফেলতে পারি না। আর সেখানে যদি ছোট শিশুরা যুক্ত থাকে- তাহলে তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। ব্যক্তিগত জীবনের চেয়ে শিশুদের জীবনকেই প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ, শিশুরা ভবিষ্যতের পৃথিবী গড়ে তুলবে।

খুব বেশি গভীরে না গিয়ে আমরা যদি বর্তমান পরকীয়া সম্পর্কগুলো দেখি তাহলে দেখব সেগুলো খুবই হালকা-পটকা। আগেও যেমন বলেছি, অনেকটা বিনোদনের মতো। যেন লুকিয়ে একটু নিষিদ্ধ খাবার খাওয়া। নিজের একটু খেয়ালখুশি পূরণ করার জন্য কী সর্বনাশা কাণ্ড! কোনো কোনো ক্ষেত্রে জৈবিক তাড়নায় পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন বিবাহীত নারী-পুরুষ। সংসার ভাঙ্গে। এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্তানেরা।
কোনো সম্পর্ককেই হালকাভাবে নেয়া উচিত না। এর ফলে বহু সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে, পরিবারের সব সদস্য অসুখী হয়ে উঠছে। জীবন সুন্দর, আর তা সুন্দর কেবল সুন্দর সম্পর্কের কারণেই। তাই এই সিদ্ধান্ত আগেই নেয়া জরুরি যে, পরকীয়া সম্পর্কের মধ্য দিয়ে আপনি মধু পান করছেন না বিষ!