এই সময়ে সংস্কৃতির দৌড়

মনি হায়দার

হাজার বছরের সমন্বিত পথচলায় একটি জাতির সামগ্রিক লোকজমিনের আকাংখাই সংস্কৃতি।
এই আকাংখার মধ্যে বিচিত্র ধরনের উপাদান সন্নিহিত থাকে। যেমন নাটক, যাত্রা, গীত বা গান জারি, সারি, নৃত্য পুতুলনাচ, বিয়ের গান, নববর্ষ, ধান উৎসবসহ এলাকা ভিত্তিক বিচিত্র অনুসঙ্গ। লিখতে আনন্দবোধ করছি- বাংলাদেশের আয়তন পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় খুব ছোট হলেও সংস্কৃতির বৈচিত্র্যে অনন্য উপাখ্যানে খুবই অগ্রসর। ধর্মীয় পরিমণ্ডলেও নানা ধরনের উৎসব সংস্কৃতির ধারা প্রবহমান। মুসলমানদের বছরে দুটি ঈদ, হিন্দুদের নানা ধরনের পূজা পার্বন, বৌদ্ধদের বুদ্ধ পূর্ণিমাসহ জাগ্রত জনতার জনতুষ্টিতে মুখর থাকে বাংলাদেশ, প্রায় বারো মাস।


বিশিষ্ট তাত্ত্বিক ও সংস্কৃতি চিন্তাবিদ মোতাহের হোসেন চৌধুরীর সংস্কৃতি সম্পর্কিত একটি বাক্য নিত্যঅনুভবযোগ্য। তিনি সংস্কৃতি কথা প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার আর কালচার শিক্ষিত, মার্জ্জিত লোকের ধর্ম।’ এই বাক্যটির মধ্যেই বাঙালি সংস্কৃতির সকল উপাদান যুক্ত করা আছে, কেবল বুঝে নেয়ার দরকার। বুঝে নেয়ার জন্য একটু বোধের গভীরে ডুব দেয়াও অপরিহার্য। ডুব না দিলে গভীরে প্রবেশ না করলে সংস্কৃতির জাতিবোধ উপলদ্ধি করা যায় না।

বাংলাদেশে এখন বিসংস্কৃতিকরণ চলছে। নিজের দেশের অভ্যন্তরিন শ্বাশত সত্তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে অপরের কালো আলখেল্লার সংস্কৃতি রাজনীতিকরণের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। যা মন ও মানসিকতার বিপরীতে এক নতুন ও চতুর খেলা। এই খেলাটা অধিকাংশ বাঙালি অনুধাবন করতে পারছে কি না, বোঝা মুশকিল। আমরা বলি বা লিখি- জাতি। জাতি কী সহজ বা সস্তা কোনো প্রসঙ্গ? হাজার হাজার বছরের লড়াই শেষে একটা জনগোষ্ঠি নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি গড়ে তোলে। সেটা যখন ধার না করা কোনো আলখেল্লায় ডুবে যায়, বুঝতে হবে জীবন বড় বিড়ম্বিত। সামনে বিপদ।

আবার বিপদ বা প্রতিকূল পরিবেশই বাঁচিয়ে রাখে সংস্কৃতিকে। সেই চর্চাপদের কাল থেকে বাংলা ভাষার উপর আক্রমন চালিয়েছে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে, কিন্ত অন্তজ্য শ্রেণীর জনতা শত বাধা অতিক্রম করে বাংলাভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বাংলা ভাষার উপর সর্বশেষ যে আগ্রাসন চালিয়েছিল ১৯৫২ সালে পাকিস্তানীরা, সেখানেও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণীর সঙ্গে বঙ্গের সাধারণ জনগণ। সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের যে অস্ত্র- সেটা অবশ্যই সংস্কৃতি।

সম্পর্কিত

বলিউডের পথে বাংলা সিনেমা
১৯৭১ সালে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলার সাড়ে সাতকোটি মানুষের অন্তহীন লড়াই ও বিজয়ের মূলেও ছিল সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতির বন্ধন। বাংলা সাহিত্যের অসামান্য লেখক সৈয়দ শামসুল হকের নূরুলদীনের সারাজীবন নাটকের অবিসংবাদিত সংলাপ- জাগো বাহে, কোনঠে সবাই- মূলত বাংলার সকল জনতাকে একটি সূত্রে বেঁধে রাখে, এগিয়ে নেয় সামনে, সংস্কৃতির উদ্ধোধনী প্রেরণায়। এইভাবে সমরে শান্তিতে একতায় সংস্কৃতির মিছিলে আমরা একটি সমন্বিত স্রোতধারা হয়ে বয়ে যাই, তেরোশো নদী পার হয়ে বিশাল বঙ্গোপাসাগরে।

 

স্বাধীনতার পর পরই সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে সৃষ্টির প্রেরণায় একটা বাণ এসেছিল দুর্বার। মঞ্চ নাটকে, কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে গোটা বাংলা সংস্কৃতি জেগে উঠেছিল অনিবার্ণ চেতনায়। কিন্ত গোষ্ঠিবদ্ধ রাজনীতির যূপকাষ্ঠে নিপতিত বাংলাদেশে এখন চলছে সংস্কৃতির এক মহা বন্ধ্যাকাল।

 

বাংলার লোকগীতির ধারা সমূহ  - Drishtibhongi দৃষ্টিভঙ্গিকিন্ত আমরা এটাও দেখেছি, বাঙালি সময়ের প্রয়োজনে সঠিক সময়ে জেগে ওঠে ঘুমের সকল পিঞ্জর ভেঙ্গে। কারণ, আমাদের কানে কানে মর্মে মর্মে তো ছড়িয়ে আছে ঝরা পাতার অসাধারণ গান, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…। বাংলার ভালোভাসার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন গগন হরকরা, কাঙ্গাল হরিনাথ, মীর মশাররফ, লালন সাঁই, শাহ আবদুল করিম, হাসন রাজা, সুফিয়া কামাল, হাসান হাফিজুর রহমান এবং সেই মহাবাক্য- একশো বছর আগে, যারা শুরু করেছিলেন মুসলিম সাহিত্য সমাজ-জ্ঞান যখন সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যখন আড়ষ্ট, মুক্তি যখন অসম্ভব’,এই শ্লোগানকে সামনে রেখে।

আমরা সংস্কৃতির ছোট ছোট সড়ক থেকে জ্ঞানের মহাসড়কে যাত্রা করতে চাই। যে যাত্রায় সকল মত ও পথের বন্ধুরা থাকবে, লাল সবুজের পাতায় বহ্নিমান থেকে সংস্কৃতির স্রোতে দাঁড়িয়ে বলবো- বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলমান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খৃস্টান- আমরা সবাই বাঙালি।