উত্তম সুচিত্রা জুটিই বাংলা সিনেমার সবচেয়ে আলোচিত এবং জনপ্রিয় জুটি ছিল। তারকা নামে সিনেমা চলে, সিনেমা হিট হয়, সিনেমা ব্যবসা করে তা প্রমাণ করেছেন বাংলা সিনেমার কিংবদন্তী তারকা উত্তম এবং সুচিত্রা। তাদের নামেই সিনেমা চলতো। কে আছেন সিনেমায়? উত্তম, সচিত্রা? তাহলে আর কোনো কথা নাই। এই সিনেমা হিট।
বাংলাদেশে সিনেমায় প্রথম আলোচিত জুটির নাম রহমান এবং শবনম। তরুণ দর্শকদের হৃদয় কেড়েছিলেন তারা দু’জন। তখনকার দিনে সিনেমা দেখার অবারিত সুযোগ ছিল না। একমাত্র সিনেমা হল ছাড়া সিনেমা দেখার আর কোনো মাধ্যম না থাকায় সব শ্রেণীর মানুষের জন্য সিনেমা দেখা সহজও ছিল না। তবে কালক্রমে সিনেমা হলের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সিনেমাই সবার বিনোদনের জায়গা দখল করে নেয়।
সড়ক দূর্ঘটনায় সেই সময়ের জনপ্রিয় নায়ক রহমান একটা পা হারানোর পর রহমান, শবনম জুটির গতিপথ বাধাগ্রস্থ হয়। সময়ের প্রয়োজন এবং অভিনয় যোগ্যতার নিরীখে আলোচনায় উঠে আসেন রাজ্জাক। এলাম আর জয় করলাম এমন ভাগ্য তাঁর ছিল না। কঠিন জীবন সংগ্রামের মাধ্যমে অভিনয় জগতে পা রাখা রাজ্জাক একটা সময় নায়করাজ উপাধি পান। রাজ্জাক-কবরী, রাজ্জাক-শাবানা, রাজ্জাক-সুজাতা, রাজ্জাক-ববিতা জুটি যারপর নাই হিট হয়। সম্ভবত রাজ্জাকই বাংলা সিনেমার একমাত্র তারকা যার সঙ্গে একাধিক নায়িকার সফল জুটি গড়ে উঠেছে। উত্তম সূচিত্রার ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেনি। উত্তমের সঙ্গে সূচিত্রা বাদে অন্য তারকার জুটি তেমন আলোচিত হয়নি। একই ভাবে সুচিত্রার সঙ্গে উত্তম বাদে অন্য তারকার জুটি দর্শক সেভাবে নেয়নি।

বাংলাদেশের সিনেমায় আলমগীর-শাবানা, ফারুক-ববিতা জুটিও বেশ আলোচিত। আলমগীর এবং শাবানা অভিনীত সিনেমার প্রতিও দুর্বার আকর্ষণ তৈরি হয় দর্শকদের। তখনকার দিনে টেলিভিশন মাধ্যম আজকের দিনের মতো এতটা সহজলভ্য ছিল না। টেলিভিশন বলতেই ছিল একমাত্র বিটিভি। ফলে সিনেমা হল এবং সিনেমার প্রতিই ছিল সবার দুর্বার আকর্ষণ।
তবে হ্যা, একটা সময় বাংলাদেশ টেলিভিশন অর্থাৎ বিটিভি দেশের মানুষের কাছে আনন্দ-বিনোদনের গুরুত্বপুর্ন মাধ্যমে পরিণত হয়। বিটিভি, দেশের একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল। আজকের দিনের মতো এত টেলিভিশন চ্যানেল ছিল না বিধায় সবেধন নীলমনি বিটিভির অনুষ্ঠানের প্রতিই সবার ঝোক ছিল। তবে একথা সত্য, তখনকার দিনে বিটিভির অনুষ্ঠান বিশেষ করে টিভি নাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, সিনেমা সহ একাধিক অনুষ্ঠান দর্শকদের পছন্দকেই গুরুত্ব দিয়েছে। টিভি নাটক ছিল অন্যতম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। টিভি নাটকে বহুল আলোচিত তারকা জুটি হলেন আফজাল হোসেন ও সুবর্না মুস্তাফা। দু’জনই মঞ্চ থেকে উঠে আসা তারকা। টিভি নাটকে অভিনয়ের নতুন দিগন্ত খুলে দেন তারা। একই সময়ে আরও অনেকে অভিনয় জুটির ক্ষেত্রে আলো ছড়িয়েছেন। তবে আফজাল-সুবর্নার মতো এত জনপ্রিয় হননি। ‘পারলে না রুমকী’ নামে একটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন আফজাল হোসেন ও সুবর্না মুস্তাফা। আজও অনেকের স্মৃতিতে এই নাটকটি আনন্দের ঢেউ তোলে।
আফজাল-সুবর্নার পথ ধরে আমাদের টিভি নাটকে একাধিক জুটি জনপ্রিয় হয়েছে। তাদের মধ্যে তৌকির-বিপাশা, জাহিদ হাসান-শমী কায়সার, মাহফুজ-তারিনের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
বর্তমান সময়ে টিভি নাটকে নীলয় আলমগীর-জান্নাতুল সুমাইয়া হিমি জুটি ব্যাপক আলোচিত ও প্রশংসিত। নীলয় ও হিমি অভিনীত টিভি নাটকের সংখ্যা ইতিমধ্যে ১০০ ছাড়িয়েছে। নন্দিত তারকা মেহজাবীন চৌধুরী ও অপূর্ব অভিনীত বহুল আলোচিত টিভি নাটক বড়ছেলের সাফল্যের পর অপূর্ব-মেহজাবীন জুটির প্রতি দর্শকদের আকর্ষণ বাড়ে। তরুণ তারকা জুটির মধ্যে ইয়াশ-তটিনী, আফরান নিশো ও মেহজাবিন, আরশ খান ও তাসনুভা তিসা জুটি বেশ আলোচিত।
আমাদের সিনেমায় যেমন নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে একাধিক নারী তারকার জুটি গড়ে উঠেছিল টিভি নাটকেও তেমনই জনপ্রিয় তারকা মোশাররফ করিম ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠেছেন। তার সঙ্গে একাধিক নারী তারকার অভিনয় জুটি দর্শকের বেশ পছন্দ। তাদের মধ্যে তানিয়া বৃষ্টি, তাসনিয়া ফারিন…

শুধু নায়ক-নায়িকার বেলায়ই নয় বাবা-মা চরিত্রেও জুটির ব্যাপারটিও বেশ গুরুত্বপুর্ন। সিনেমায় আনোয়ার হোসেন-রোজী সামাদ অথবা আনোয়ারা জুটি এতটাই হিট হয়েছিল যে দর্শকদের অনেকে ভেবে নিয়েছিলেন আনোয়ার হোসেন এবং আনোয়ারা বাস্তবেও স্বামী স্ত্রী। টিভি ধারাবাহিক নাটকের ক্ষেত্রেও বাবা-মার জুটি গড়ে উঠেছে। বিটিভির আলোচিত ধারাবাহিক নাটক ‘সকাল সন্ধ্যা’য় স্বামী-স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সেই সময়ের আলোচিত তারকা পিযুষ বন্দোপাধ্যায় ও আফরোজা বানু। দর্শকদের অনেকে ভেবে নিয়েছিলেন তারা বাস্তবেও স্বামী-স্ত্রী।
নাটক সিনেমায় জুটির ব্যাপারটা একদিকে যেমন ভালো অন্য দিকে তেমনই খারাপ। খারাপ এই অর্থে, কোনো একটা জুটি হিট হয়ে যাওয়ার পর ইদানিং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওই জুটিকে নিয়েই নাটক সিনেমা নির্মাণের হিড়িক পড়ে যায়। ফলে হিট তারকাদের ডিমান্ড বেড়ে যায়। তারা নিজেরাই নিজেদের পারিশ্রমিক বাড়িয়ে দেন। অনেক তারকা জুটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। ‘আমাকে নিলে তাকেও নিতে হবে’ অনেকে এমন শর্তের বেড়াজালে ফেলে দেন নির্মাতাদের। ফলে অনেক নির্মাতা তাদেরকে নিয়ে নাটক, সিনেমা বানাতে বাধ্য হন।
যুগে যুগে নাটক সিনেমায় জুটির ব্যাপারটি গুরুত্ব পেয়েছে। এখনও পাচ্ছে। তবে আমদোর প্রত্যাশা জুটি প্রথা যেন তথা কথিত সিন্ডিকেটের কৌশল অবলম্বন না করে।