এক সাক্ষাতকারে মেহের আফরোজ শাওন বলেছেন, “হুমায়ূনের মুডের ওপর নির্ভর করত কী খেতে চাইবেন। কখনো বলতেন চিংড়ি মাছের ঝোল রাঁধো, কখনো বলতেন ডাল ভুনা চাই।” তাঁর হাতে তৈরি চিংড়ি মাছ আর ডাল ভুনা ছিল হুমায়ূনের বিশেষ পছন্দ। আর নিয়মিত প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল সাদা ভাত, গরুর মাংস, মাসকলাই ডাল, সবজি আর পায়েস।
এই সরল খাবারগুলোতেই ছিল তাঁর জীবনের মিষ্টি ছোঁয়া। তিনি ছিলেন একেবারে গরম খাবারপ্রেমী । খাবার ঠান্ডা হয়ে গেলে খেতে চাইতেন না। “হুমায়ূন আহমেদ বলতেন, খাবার ঠান্ডা হলে তার প্রাণটাই শেষ হয়ে যায়।” তাই সবসময় বাসায় গরম খাবার পরিবেশন করার আয়োজন চলত ভাত থেকে তরকারি, সবকিছু ধোঁয়া উঠা অবস্থায় টেবিলে আসত।
এমনকি হুমায়ূনের একটা অভ্যাস ছিল চা খাওয়ার পর সিগারেটের ছাই চায়ের কাপের ভেতর ফেলা। তিনি প্রতিদিন অসংখ্যবার চা খেতেন, আর প্রতিবারই এই অভ্যাসটি যেন তাঁর ভাবনার সঙ্গী হয়ে যেত।
হুমায়ূন আহমেদের খাবারপ্রেম তাঁর লেখাতেও সমানভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর উপন্যাস বা গল্প পড়তে পড়তে মনে হয়, যেন প্রতিটি দৃশ্যের সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে রান্নার ঘ্রাণ।‘কবি’ উপন্যাসে আতাহার চরিত্রটি যেমন প্রেমে পড়ে নীতুর হাতের রান্নায়, তেমনি পাঠকও মুগ্ধ হয় সেই সহজ অথচ জীবন্ত খাবারের বর্ণনায়। গরম পরোটা, ডিমভাজা, গরুর মাংস খাবারগুলো তেমন আহামরি নয়, কিন্তু হুমায়ূনের লেখায় তা হয়ে ওঠে প্রেমের প্রতীক, সম্পর্কের উষ্ণতার ভাষা। ‘লীলাবতী’ উপন্যাসে মুরগির মাংসের সঙ্গে কাঁঠালের বিচি মিশিয়ে বানানো সালুনের বর্ণনা শুধু এক নতুন রেসিপির বয়ান নয়, বরং এটি গ্রামীণ রন্ধনসংস্কৃতির সঙ্গে শহুরে জীবনের এক সেতুবন্ধন। তাঁর কলমের জাদুতে পাঠক টের পায়, খাবারও হতে পারে সংস্কৃতি ও স্মৃতির বাহক।
‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসে কলাপাতায় ধোঁয়া ওঠা ভাত, খলিশা মাছের ঝোল, পাটশাক ও ডালের বর্ণনা আমাদের গ্রামীণ রন্ধন ঐতিহ্যের ছবি আঁকে। সেখানে লাবুশের মুখে শোনা যায় “জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দ ভরপেট খাওয়ায়।” হুমায়ূনের ভাষায় এই বাক্যটি শুধু ক্ষুধার প্রকাশ নয়, এটি জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতার ঘোষণা। তিনি বুঝতেন, খাওয়া মানে কেবল মুখভর্তি ভাত নয় খাওয়া মানে তৃপ্তি, শান্তি, জীবনের স্বাদ নেওয়া।
তাঁর অদ্ভুত চরিত্র হিমু যেমন খালি পায়ে হাঁটে, তেমনি খাওয়ার ক্ষেত্রেও আলাদা। হিমুর প্রিয় খাবার বাসি পোলাও, ডিমভাজা বা আগের রাতের তরকারি। সমাজ যেটিকে পুরনো বলে ফেলে দেয়, হিমু সেটিকেই ভালোবাসে। এই ভালোবাসার মধ্য দিয়েই হুমায়ূন যেন বলেন “সুন্দর জিনিস সবসময় নতুন হয় না।” তাঁর লেখায় এই বাসি খাবার হয়ে ওঠে স্মৃতির মতোই উষ্ণ ও মানবিক।
হুমায়ূন আহমেদ পোড়া খাবারের প্রশংসাও করেছেন তাঁর লেখায়। বাঙালি সংস্কৃতিতে পোড়া মানে অনেক সময়ই বিশেষ স্বাদ। বেগুন পোড়া, টমেটো পোড়া, মরিচ পোড়া এইসব খাবার আমাদের ঘরোয়া রন্ধন সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ‘জোছনা ও জননীর গল্প’-এ পোড়া টমেটো ভর্তার বর্ণনা যেন আমাদের ঐতিহ্যকে নতুন করে মনে করিয়ে দেয়। তাঁর লেখায় পোড়া খাবারের গন্ধে মিশে থাকে জীবনের আসল ঘ্রাণ যেখানে ত্রুটি, দাহ ও অসম্পূর্ণতাও হয়ে ওঠে সৌন্দর্যের রূপ।
হুমায়ূন আহমেদের লেখায় ক্ষুধা একটি ধারাবাহিক মোটিফ। ‘মধ্যাহ্ন’-এর লাবুশ যেমন কলাপাতায় ভাত খেয়ে বলে “এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আনন্দ ভরপেট খাওয়ায়”, তেমনি হুমায়ূনের লেখার প্রতিটি চরিত্রই কোনো না কোনোভাবে এই ক্ষুধার মধ্যে জীবনের মানে খুঁজে পায়। এই ক্ষুধা কেবল দেহের নয়- এটি মনের, সম্পর্কের, এমনকি অস্তিত্বেরও ক্ষুধা।
তিনি বিশ্বাস করতেন, খাওয়ার মধ্যে আছে জীবনের পূর্ণ অভিজ্ঞতা। তাঁরই কথায়, “খায় শুধু মুখ নয়, খায় চোখ, নাক, হাতও।” তাই তাঁর লেখায় খাবার কখনো নিছক উপকরণ নয়, এটি হয়ে ওঠে অভিজ্ঞতার পূর্ণতা। খাবারের ঘ্রাণ, রঙ, গরম ধোঁয়া সবকিছুই তাঁর লেখায় ছুঁয়ে যায় পাঠকের ইন্দ্রিয়কে।
দিনের শেষে ক্লান্ত শরীরে ফিরে এসে গরম ভাতের উপর এক চামচ গাওয়া ঘি, পাশে ডিমভাজা আর এক কাপ চা এই দৃশ্যেই যেন ধরা দেয় হুমায়ূনের দার্শনিকতা। জীবনের সমস্ত বিশৃঙ্খলা শেষে মানুষ আসলে যে স্বস্তি খোঁজে, তা কোনো জাঁকজমকে নয়, বরং সরলতায়। তাঁর কাছে খাবার মানে ছিল জীবনকে সহজভাবে উপভোগ করা। তাই তিনি শেখান “অতি সাধারণ জিনিসই সবচেয়ে অসাধারণ।”