তিনি হেঁটেছেন জলে জোছনার প্রান্তরে

খান মুহাম্মদ রুমেল

বেড়াতে ভালোবাসতেন হুমায়ূন আহমেদ। তার বিভিন্ন লেখায় পরিচিতজনদের স্মরণে স্মৃতিতে ধরা দেয় এমন চিত্র। সময় সুযোগ পেলেই দলবল নিয়ে বের হয়ে পড়তেন দেশে কিংবা বিদেশে। অনেকেরই জানা এমন তথ্য একপাশে রেখে ফেরা যাক একটু পেছনে।

এক সময় খুব ঘরকুনো স্বভাবের ছিলেন নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ।  আত্মজীবনীধর্মী বইয়ের সংকলন ”আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই” এর প্রথম ফ্ল্যাপে লিখেছেন – ”এক সময় আমি খুব ঘরকুনো স্বভাবের ছিলাম। কোথাও যেতে ভালো লাগতো না। নিজের অতি পরিচিত জায়গা ছেড়ে দুদিনের জন্য বাইরে যাবার প্রয়োজন হলেও গায়ে জ্বর আসতো।  সেই আমাকে সাত বছরের জন্যে দেশ ছেড়ে আমেরিকা যেতে হলো।” সেটা না হয় পড়াশোনার জন্য গিয়েছিলেন! প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক বেড়ানোর গল্প বলতে গিয়ে পিএচডির জন্য মার্কিন মুলুকে যাওয়ার কথা তোলার কী সম্পর্ক থাকতে পারে? সম্পর্ক একটা তো আছেই। হুমায়ুন আহমেদ নিজেকে বলেছেন ঘরকুনো। আবার সেই তিনিই হয়ে উঠেছেন – “পায়ের তলায় খড়ম”ওয়ালা এক পর্যটক। এ কি তবে সেই চিরন্তন কথা – ”মানুষ মরে গেলে পচে যায়। বেঁচে থাকলে বদলায়। সকালে বিকালে বদলায় । কারণে অকারণে বদলায়” – এর প্রতিফলন? আজকে বরং বাদ থাকুক সেই তত্ত্ব কথার আলোচনা। আমরা বরং ফিরি ম্যাজিক মুনশির বেড়ানোর গল্পে। কবে কোথায় হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন মনে নেই। তবে হুমায়ূন পাঠের স্মৃতি আউড়ে বলছি- একবার বইয়ের রয়্যালটি বাবদ বেশ কিছু টাকা পেয়ে হুমায়ূন আহমেদ কিনে ফেললেন সতেরো সিটের মাইক্রোবাস! সেই মাইক্রোবাস কয়েকদিন পড়ে থাকলো শহীদুল্লাহ হলে তার আবাসিক ভবনের সামনে। হুমায়ূনকন্যারা সেই সেই মাইক্রোবাসের ভেতর বসে রান্নাবাটি খেলে। অবশেষে এক চাঁদনি পসর রাতে সেই মাইক্রোবাসে আত্মীয় পরিজনের বিশাল বহর নিয়ে হুমায়ূন যাত্রা করেন সিলেটের পথে।

The last farewell… | The Daily Starহুমায়ূন আহমেদের বেড়ানোর ফিরিস্তির কী শেষ আছে? বেড়ানোর সঙ্গী হিসেবে তিনি চাইতেন পরিবার কিংবা ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের। তিনি ভাবতেন বেড়ানোর আনন্দ একা উপভোগের নয়। দেশে বিদেশের বহু জায়গায় তিনি ঘুরেছেন। সেসব নিয়ে লিখেছেনও। শ্রীলঙ্কা বেড়ানোর মনোহর বয়ান তিনি লিখেছেন রাবণের দেশে আমি এবং আমরা। বইয়ের ফ্ল্যাপে তিনি লিখেছেন- ” ভূপর্যটক মার্কোপলো শ্রীলংকা গিয়েছিলেন। তাঁর বিখ্যাত ভ্রমণকাহিনীতে শ্রীলংকা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “এই দেশে কিছু বানর আছে, যাদের মুখে মানুষের দাড়ির মতো দাড়ি। এইসব বানরের একজন রাজা থাকে। রাজা মাথায় পাতার মুকুট পরে। রাজাকে ঘিরে থাকে সভাসদরা। অন্য বানররা ফল-মূল নিয়ে রাজাকে ভেট দিতে আসে। ভেট দেওয়ার পর তারা রাজাকে কুর্নিশ করে এবং বিনীত ভঙ্গিতে বসে থাকে। বানর রাজা তাদেরকে নানা উপদেশ দেন।” মার্কোপলোর বানরদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে ।” পড়লেই বোঝা যায় বইয়ের শুরুতেই নিজের পরিচিত ভঙ্গির চিরাচরিত ঢংয়ে চুম্বকের মতো আটকে ফেলেছেন পাঠককে।

হুমায়ূন আহমেদ বেড়িয়েছেন নিজের কাছের মানুষদের নিয়ে। কিন্তু ভ্রমণের ভাগ দিয়েছেন অসংখ্য মানুষকে। নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু বই। লিখেছেন অনেক ছোটগল্প। তাঁর নির্মল বর্ননায় পাঠকও তার সঙ্গে ঘুরেছেন দেশে বিদেশের বড় ছোট শহরে কিংবা অজ কোনো গ্রামে।

আচ্ছা, যদি বলি যশোহা বৃক্ষের দেশ কোথায়? হুমায়ূন না পড়া কয়জন মানুষ তার উত্তর দিতে পারবেন? ধারণা হয় খুব বেশি উত্তরদাতা পাওয়া যাবে না। কিন্তু যদি বলি আমেরিকা কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র? তাবত মানুষ চিনে যাবেন নিশ্চয়। জি যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের নাম – যশোহা বৃক্ষের দেশে।

সুইজারল্যান্ডে নাটক বানাতে গিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। এরপর লিখলেন ”দেখা না দেখা”। বেড়ানোর সুন্দর বর্ননার সঙ্গে পাঠকের হাতে তুলে দিলেন অজানা অনেক তথ্য।
প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন বেড়াতে গিয়ে এতোটাই মুগ্ধ হলেন- একখণ্ড জমি কিনে বাড়ি বানালেন। নাম দিলেন সমুদ্র বিলাস। হুমায়ূন চলে গেছেন অনেক দিন হয়। আজও কোনো জোছনা রাতে রূপালি আলোয় ভেসে গেলে চারপাশ, মন কেমন করা কোনো তরুণী কি গেয়ে উঠেন আনমনে – চাঁদনি পসরে কে আমারে স্মরণ করে, কে আইসা দাঁড়াইসে গো আমার দুয়ারে! হুমায়ূন আহমেদ মানুষকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন।

তিনি চলে গেছেন। তবে চলে গিয়েও প্রবলভাবে আছেন- সাগরজলের জোছনায়। হাওরের হু হু বাতাসে। আছেন আদিগন্ত বিস্তৃত পথে প্রান্তরে। দেশে বিদেশে পদচিহ্ন ফেলা নানা জানা অজানায়।