আর্কেশিয়া স্থাপত্য পুরস্কার ২০২৫-এ সামাজিক দায়িত্বের পুরস্কার পেলেন স্থপতি শরীফ উদ্দিন আহম্মেদ
স্থাপত্যের জন্য এশিয়ার মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার আর্কেশিয়া স্থাপত্য পুরস্কার ২০২৫-এ স্বর্ণপদক পেল ল্যান্ডস্কেপ প্রকল্পটি। বিশেষ প্রকল্প ক্যাটাগরিতে “সোশ্যাল রেস্পন্সিবল” আর্কিটেকচার এর জন্য লাগসই চিন্তা ও বাস্তবায়নে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়েস্ট ল্যান্ডকে ল্যান্ডস্কেপ প্রকল্পের মাধ্যমে ইকোলজিক্যাল ওয়েসিসে রূপান্তরের জন্য বাংলাদেশের খ্যাতিমান স্থপতি মো. শরীফ উদ্দিন আহম্মেদ তাঁর অনন্য ডিজাইন মেধার স্বীকৃতি স্বরূপ স্বর্ণপদক পেয়েছেন। তিনি “স্থাপতিক” প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান স্থপতি। আর্কেশিয়া স্থাপত্য পুরস্কারের পর পরই স্থপতি শরীফ উদ্দিন ৭ম বাকু আন্তর্জাতিক স্থাপত্য পুরস্কার ২০২৫’ এ সেরা বাস্তবায়িত ইন্টেরিয়র অ্যাওয়ার্ড পান। গত বছর মানিকগঞ্জের শাহ্ মুহাম্মদ মহসিন খান দরগাহ’র নকশা করার জন্য স্থাপত্য বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার রিবা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স-২০২৪ এ বিজয়ী হয়েছিলেন তিনি। ২০২৩ সালে ইউনিয়ন অব ইন্টারন্যাশনাল আর্কিটেক্টস এর ফ্রেন্ডলি অ্যান্ড ইনক্লুসিভ স্পেস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন। এবার শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমিতে খ্যাতিমান এই স্থপতিকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন- মোহাম্মদ তারেক
এই পুরস্কার পাওয়া শুধুমাত্র ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং বাংলাদেশের স্থাপত্যচিন্তার একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন। এই প্রকল্পের পেছনে যে ভাবনা ছিল স্থাপত্যকে কেবল নির্মাণ নয়, বরং একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা হিসেবে দেখা, এই পুরস্কার যেন সেই দর্শনের স্বীকৃতি।
আমি বিশ্বাস করি, একজন স্থপতির কাজ কেবল ইট-পাথরের কাঠামো তৈরি করা নয়; বরং মানুষের জীবন, পরিবেশ, ও প্রকৃতির মধ্যে একটি ভারসাম্য সৃষ্টি করা। এই ডাম্পিং সাইটটিকে একটি প্রাণবন্ত, টেকসই ও সবার জন্য উন্মুক্ত সবুজ পরিসরে রূপান্তরিত করার লক্ষ্য ছিল সেই চেষ্টারই প্রতিফলন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের তরুণ স্থপতিদের জন্যও এক অনুপ্রেরণা যেন তারা দেখেন, সমাজ ও প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধ স্থাপত্যও বিশ্ব দরবারে জায়গা করে নিতে পারে।
এই পুরস্কার আমাকে আরও দায়িত্বশীল করেছে, যেন ভবিষ্যতের প্রতিটি কাজেই স্থাপত্য মানুষের কল্যাণে, পরিবেশের পুনর্জাগরণে, এবং দেশের ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতি ব্যক্ত করে এ কথা গুলো বললেন খ্যাতিমান স্থপতি শরীফ উদ্দিন আহম্মেদ।

স্থপতি শরীফ উদ্দিন আহম্মেদ ২০২৩ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কারে জয়ী হয়েছেন, যা তার কাজকে এবং বাংলাদেশের স্থাপত্যকে বিশ্বের দরবারে সমাদৃত করেছে। আর্কেশিয়া স্থাপত্য পুরস্কার ২০২৫ এ বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এই স্থপতির নকশা করা ল্যান্ডস্কেপে পুরস্কার পেয়েছে। স্থপতি শরীফ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, বাংলাদেশের ভূখণ্ডের একটি বড় অংশেই জলাবদ্ধতা এখন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষ করে জনবহুল এলাকা এবং নগরাঞ্চলে এর মাত্রা অনেক বেশি। এই প্রকল্পে ল্যান্ডস্কেপ পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল একটি জলাধার বা ওয়াটার রিটেনশন পন্ড তৈরি করা, যা শুধুমাত্র নান্দনিক নয়, বরং পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি জলাবদ্ধতার সমস্যা কমাতে কার্যকর সমাধান হিসেবে কাজ করে।
এখানে ল্যান্ডস্কেপকে কেবল সৌন্দর্যের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়নি; বরং এটি সামাজিক ও প্রাকৃতিক সমস্যার সমাধানেও অবদান রাখে। তাই প্রকল্পটি “Socially Responsible Architecture” ক্যাটাগরিতে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এই প্রকল্পটি একটি মডুলার সমাধান হিসেবে কাজ করতে পারে, যার বিভিন্ন উপাদান প্রয়োগ করে স্থানভেদে একই রকম ফলাফল অর্জন করা সম্ভব। স্থানীয় পর্যায়ে এই সমাধানকে গ্রহণ ও প্রয়োগ করলে জলাবদ্ধতা কমানো, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সামাজিক উপকারিতার দিকগুলো একসাথে পূরণ করা যেতে পারে।
এই পুরস্কার আমাদের শিখিয়েছে যে ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইন শুধু নান্দনিকতার জন্য নয়, বরং সমস্যা-ভিত্তিক, টেকসই এবং মানুষের কল্যাণে সহায়ক হতে পারে। ছোট ছোট পদক্ষেপের মাধ্যমে বড় পরিবর্তনের সূচনা করা সম্ভব, আর এই প্রকল্প সেই উদাহরণের প্রতিফলন।
স্থাপত্য যখন সমাজিক দায়িত্ব: প্রকল্পের শুরুতে ক্লায়েন্টের চাহিদা ছিল কেবলমাত্র একটি যানবাহন চলাচলের রাস্তা, চেকপোস্ট, ট্রাক পার্কিং এবং হাঁটার পথ তৈরি করা। কিন্তু স্থপতির মনে ছিল আরও বৃহত্তর সামাজিক দায়িত্বের ভাবনা। সেই ভাবনা থেকেই স্থপতি এই প্রকল্পের মাধ্যমে সমাধান খুঁজেছেন জীববৈচিত্র্যের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা, বিদ্যমান সাইটের জলাবদ্ধতা নিরসন এবং মানুষের জন্য একটি গণতান্ত্রিক শ্বাস-প্রশ্বাসের উন্মুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করার।
এখানে শ্রমিক ও অফিসকর্মীদের শ্রেণিভেদ ভেঙে সবার জন্য জীবনের উচ্ছ্বাস ভাগ করে নেওয়ার ক্ষেত্র সৃষ্টি করা হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যমান সাইটের ফেলে দেওয়া ডাম্পিং উপকরণ পুনর্ব্যবহার ও উপযোগিতার মাধ্যমে নির্মাণ ব্যায় কমানোরও চেষ্টা করা হয়েছে।
রাজধানীর জাহাঙ্গীর গেট থেকে মহাখালী যাওয়ার পথে রাস্তার বা পাশে এসকেএস টাওয়ারের ঠিক পেছনে ছিল টোবাকো কোম্পানির একটা কারখানা। যে জায়গায় কারখানাটি ছিল, সেটি মূলত সেনাবাহিনীর, মহাখালি ডিওএইচএস (ডিফেন্স অফিসার্স হাউজিং স্কিম) এর। ১৯৬০ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছ থেকে জায়গাটি ইজারা নিয়েছিল এই প্রতিষ্ঠান। কারখানার দক্ষিণ দিকের এই জায়গাটি বহু বছরের আবর্জনা জমে বনজঙ্গলের মধ্যে এক ডাম্পিং গ্রাউন্ডে পরিণত হয়েছিল। এছাড়া বর্ষাকালে এই জমিতে এক থেকে দেড় ফুট পর্যন্ত বর্ষার পানি জমত। সেই জলাবদ্ধ পানি কৃত্রিম আন্ডারগ্রাউন্ড ট্যাঙ্কে জমা করা হতো এবং সেই ট্যাঙ্ক থেকে পাম্পিং এর মাধ্যমে বাইরে ফেলে দেওয়া হতো। এজন্য প্রতিষ্ঠানটির বছরে কয়েক কোটি টাকা খরচ হতো।
স্থপতি এই জায়গাটিকে প্রথমে একটা রাস্তা, চেকপোস্ট, বাগান, জগিং স্পেস, মিটিং প্লেস মিলিয়ে প্রায় ৭-৮ কোটি টাকার একটা প্রজেক্টের পরিকল্পনা জমা দেন। সেটি বাতিল হয়ে যায়। এরপর স্থপতি বিদ্যমান সাইটের বর্জকে কাজে লাগিয়ে মাত্র ১ কোটি ৭২ লাখ টাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেন। আর সেই প্রকল্পই বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে এই সম্মানজনক পুরস্কার। এই প্রকল্পের জন্য আর্কেশিয়া স্থাপত্য পুরস্কার-২০২৫ অর্জনের পরপরই স্থপতির কাজের অনন্য সংবেদনশীলতা ও দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তিনি ৭ম বাকু ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ২০২৫ এ সেরা বাস্তবায়িত ইন্টেরিয়র ডিজাইন-এ সম্মানিত হন।
প্রজেক্টের পেছনের গল্প: প্রায় ৩ একর জুড়ে থাকা এই ডাম্পিং জায়গায় ক্লায়েন্টের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি স্থপতি সেখানে নির্মাণ করেন একটি প্রাকৃতিক জলাধার। যদিও শুরুতে ক্লায়েন্ট এতে অনাগ্রাহী, কিন্তু স্থপতির সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে বোঝায় যে বর্ষাকালে জমে থাকা পানি এই জলাধারে সংরক্ষিত হবে এবং সাইটের জলাবদ্ধতার একটি প্রাকৃতিক সমাধান হবে। জলাধার তৈরির ফলে জায়গাটির আবহাওয়া শীতল ও স্নিগ্ধ হয়েছে। ফলে স্থানটি একদিকে যেমন আরামদায়ক ও প্রশান্তিময় পরিবেশে পরিণত হয়েছে, তেমনি বানর, বাদুড় ও বেজিসহ নানা প্রাণীর খাবার ও পানিরও ব্যবস্থা হয়েছে, যার ফলে জীববৈচিত্র বৃদ্ধি পেয়েছে। এই এলাকায় ছিল উঁচু উঁচু মেহগনি গাছ। বর্ষার সময়ে জমে থাকা পানিতে মেহগনির পাতা ও ফল পড়ে পুরো জায়গাটিকে বিষাক্ত করে তুলতো।

স্থপতি শরীফ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, “মেহগনির ফল আসলে বিষাক্ত (এটা দিয়েই আসলে কীটনাশক তৈরি হয়)। এর কারণে বড় মেহগনি গাছের নিচে ঝোপঝাড় কিংবা ছোট গাছ জন্মাতে অসুবিধা হয়। তবুও আমরা ঠিক করলাম, কীভাবে একটি মেহগনি গাছও না কেটে এর পরিবেশগত সমাধান করা যায় এবং পাশাপাশি নতুন কী ধরণের গাছ এখানে রোপণ করা যায়। সত্যি কথা বলতে কী, আমরা কোনো গাছই কাটিনি। বরং নতুন গাছ লাগিয়েছি। গাছের ভেতর দিয়েই এমনভাবে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে যাতে একটি গাছও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। জমে থাকা পানির সমস্যার সমাধানের জন্য এখানে এমন সব গাছ লাগানো হয়েছে, যেগুলো দ্রুত পানি শোষণ করে নেয় এবং সেই সঙ্গে পানিকে পরিশোধন করে ভূগর্ভস্থ
প্রাকৃতিক জলাধারে পৌঁছে দেয়। ফলে ডিজাইনকৃত জলাধারে স্থায়ীভাবে পানি জমে থাকে না। বর্ষার সময় বৃষ্টির পানি জমলেও তা তিন-চার ঘণ্টার মধ্যেই সরে যায়। এই ব্যবস্থাপনা পুরো ঢাকা শহরের জমে থাকা পানির একটি কার্যকর সমাধান হিসেবে কাজ করতে পারে। এছাড়াও এখানে লাগানো হয়েছে নানান দেশীয় গাছ, ফুলের বাগান ও সবুজায়নের উপাদান, যা জায়গাটিকে করেছে আরও প্রাণবন্ত।
ক্লায়েন্টের প্রধান চাহিদা অনুযায়ী, বিদ্যমান বর্জ্য উপকরণ ব্যবহার করে একটি রাস্তা ও চেকপোস্ট তৈরি করা হয়েছে। প্রায় অর্ধ-শত বছরের যত মেটাল, ভাঙরি, স্লাব, ইটের টুকরা প্রভৃতি ফেলা হয়েছিল, সেগুলো রিসাইকেল করে এই রাস্তার পিচ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে রাস্তা তৈরির বিশাল খরচ অনেকটাই কমে এসেছে।
খুবই কম খরচে প্রাকৃতিক পরিবেশ অক্ষুণ্ন রেখে একটা পার্কের মতো স্পেস তৈরি করা হয়েছে যাতে প্রতিষ্ঠানের কর্মী, উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষ সবাই হাঁটাহাঁটি বা বসে গল্প করার জন্য ব্যবহার করতে পারে। এই প্রজেক্টটি সম্পন্ন করার কয়েক মাসের ভেতরেই কয়েকটি মৌমাছির চাক দেখা যায়। দেখা মেলে নানা ধরনের পাখির। তারমানে জলজ পরিবেশ, পাখি, ফুল, বিভিন্ন প্রাজাতির গাছ, প্রাণী মিলে যে বাস্তুতন্ত্র তৈরি হয়েছে তা মৌমাছি বাসা বানানোর জন্য উপযোগী। বিষাক্ত যে পরিবেশে ময়লা আবর্জনা ফেলা হতো, সেখানেই আজ ফুটছে ফুল। পাখিরা বাসা বাঁধছে নতুন নতুন গাছে। আমরা এমন একটা পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক স্পেস তৈরি করতে চেয়েছি, যেখানে প্রাণী-পাখি, গাছ, ফুল, প্রজাপতি, মানুষ সবাই মিলেমিশে থাকবে।’
