Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

বন্ধুহীন জীবন! মাইগড! অসহ্য জীবন! -সুবর্ণা মুস্তাফা

সুবর্ণা মুস্তাফা দেশবরেণ্য অভিনেত্রী, নির্মাতা। আনন্দ আলোর সপ্তম বর্ষের উনিশতম সংখ্যায় তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ হয়েছিল।

কেউ কেউ বলেন তিনিই আমাদের সুচিত্রা সেন। কারো কারো মনত্মব্য চলচ্চিত্রে তিনি যদি নিয়মিত হতেন তাহলে বরেণ্য অভিনেত্রী শাবানার অভাব পুরণ হয়ে যেত। আশির দশকে টিভি নাটকের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের পর্দায় জনপ্রিয়তার ঝড় তুলেছিলেন তিনি। এখনো টিভি পর্দায় সমানতালে অভিনয় করে চলেছেন। সেই সাথে নির্মাতা হিসেবেও সুনাম কুড়িয়েছেন। তিনি আর কেউ নন আমাদের প্রিয় অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা। সম্প্রতি উত্তরায় তার বাসায় ‘আনন্দ আলো’র মুখোমুখি হন তিনি। আনন্দ আলোর সম্পাদক রেজানুর রহমানকে বলেছেন সাম্প্রতিক সময়ের অনেক কথা। তারই চুম্বক অংশ…

আনন্দ আলো: সুবর্ণা মুস্তাফার প্রতিদিনের একটা গল্প শুনতে চাই। সকাল, সন্ধ্যা এবং রাত্রি…

সুবর্ণা মুস্তাফা: আমি সাধারণত খুব সকালে ঘুম থেকে উঠি। রাতে কোনো কাজ না থাকলে যেমন কোথাও বেড়াতে গিয়ে অথবা পার্টিতে এটেন্ড করার কারণে দেরি না হলে সাধারণত সাড়ে দশটা ১১টার মধ্যে ঘুমাতে যাই। আমি সাধারণ একটি দিনে যখন সকালে ঘুম থেকে উঠি তখন পরিবারের অন্যান্য সদস্য তখনো বিছানায়। তখন কি করা যায় ভাবি। এই সময়টাকে আমি নাটকের স্ক্রিপ্ট পড়ার জন্য ব্যয় করি। শুটিং থাকলে সকালটা একরকমভাবে শুরু হয়। আর শুটিং না থাকলে কিছুটা রিল্যাক্স মুড থাকে। শুটিং থাকলে আগের দিন রাতেই আমি সবকিছু গোছগাছ করে ফেলি। যাতে কলটাইমেই শুটিং স্পটে পৌঁছানো যায়। জ্যামট্যাম বলে আমি কোনো এক্সিউজ দিতে চাই না। ট্রাফিক জ্যাম তো আমাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। কাজেই এটাকে আমি কোনো কারণের মধ্যে ফেলতে চাই না। শুটিং থাকলে আমি বাইরের খাবার এভয়েড করার জন্যই এটা করি। শুটিং শেষে যখনই বাসায় ফিরি প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে টিভির সামনে বসা আমার নিত্যদিনের অভ্যাস। আমি ছোটবেলা থেকেই টিভি দেখতে পছন্দ করি। আমার বাবাও টিভি দেখা পছন্দ করতেন। টিভিতে খবর আমার প্রিয় অনুষ্ঠান। খবর না দেখলে কেন যেন মনে হয় আজ কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমার পেশাগত জীবন এবং ব্যক্তি জীবনের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য খোঁজা যাবে না। প্রায় একই রকম। তবুও পারিবারিক জীবনের যে দায়িত্বটুকু থাকে তা নিষ্ঠার সাথে পালনের চেষ্টা করি। আমার ৩টি পেট (পোষা প্রাণী) আছে। তাদের খাওয়া-দাওয়া ও দেখাশুনা করি। তবে হ্যাঁ, সকালে শুটিং-এর ঝামেলা না থাকলে আমি বই পড়তে পছন্দ করি। মাঝখানে বই পড়ার অভ্যাসটা একটু শিথিল হয়েছিল। তখন আবার চাঙ্গা হয়েছে।

আমি নিজে বাজার করি। নিজের মতো করে সবকিছু সাজাই। নাথিং ভেরি এক্সসাইটিং। কিন্তু আমি খুবই কমফোর্টেবল আমার এই লাইফে। অনেক বন্ধু, অনেক পার্টি, অনেক হৈচৈ-এর অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই। ১৮/১৯ বছর থেকে মিডিয়ার বাইরে যারা আমার বন্ধু ছিল তারা এখনো আমার বন্ধু। মিডিয়াতে অলমোস্ট অল মাই কলিগস আর মাই ফ্রেন্ডস। সেটা জুনিয়র হোক সিনিয়র হোক। যেমন জলি আমার পারিবারিক বন্ধু। চিত্রা, সাবেরীকে ছোটবেলা থেকে চিনি। ফেরদৌসী খালা, ত্রপা, জিতু… আমি যাদের সাথেই কাজ করছি তারা আমার বন্ধু আপনজন। আমার একটা কথা শুনে বিস্ময়কর লাগে। তাহলো- আমি যখন এই সময়ের ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞেস করি মিডিয়ায় তোমাদের বন্ধু কারা? তখন তারা উত্তর দেয়- মিডিয়ায় আমাদের কোনো বন্ধু নেই। তখন অবাক না হয়ে পারি না। কারণ এই ছেলেমেয়েরা মাসে ৩০ দিন একসাথে কাজ করে। অথচ তারা নিজেদের বন্ধু ভাবতে পারছে না। এটা ভালো লক্ষণ নয়।

আনন্দ আলো: বর্তমানে কি নিয়ে ব্যসত্ম আছেন?

সুবর্ণা মুস্তাফা: ধারাবাহিক নাটক, দেশ টিভিতে গহীনে সবেমাত্র শেষ হলো। কোমল বিবি শুরু হয়েছে চ্যানেল আইতে। গ্রন্থিগণ কহের শুটিং শুরু করব ফেব্রুয়ারিতে। অরুণ চৌধুরীর একটি ধারাবাহিক নাটক করার কথা রয়েছে। শহীদুজ্জামান সেলিম একটি নাটকের কথা বলেছে। এছাড়া আরো অনেকগুলো কাজ পরিকল্পনার মধ্যে আছে।

আনন্দ আলো: আপনি একজন ব্যসত্ম তারকা। আপনার সংসার জীবনটা কেমন? কীভাবে সংসারে সময় দেন?

সুবর্ণা মুস্তাফা: (মৃদু হেসে) শুধু বর্তমানের সংসার নয়। বাবা-মায়ের সংসারেও আমি প্রচুর সময় দিয়েছি। আমি খুবই সংসারী ধরনের একজন মানুষ। তবে সংসারের আসল সংজ্ঞা কি আমি জানি না। সংসার মানে যদি হয় মশলা বাটা, রান্না করা, কাপড় ধোয়া, নো… আই ডোন্ট ডু দ্যাট। বাট… আমি হচ্ছি সেই মানুষ… বাবা যতদিন জীবিত ছিল তার কাছে ছিলাম। তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যনত্ম কাছে থেকেছি। আমার মা প্রায় ৪ বছর বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন। তাকে আমিই দেখাশোনা করেছি। আমি একটা কথা বলতে চাচ্ছি। তাহলো আমি দারুণভাবে সংসারী একজন মানুষ। কে কোনটা খায় না। কার কিসে এলার্জী সব আমি জানি। আমি জানি না সংসারের আসল কনসেপ্ট কী? আমার ধারণা সংসারের কনসেপ্ট হলো আমার বাড়িতে যে কোনো সময় অতিথি এলে তাকে আপ্যায়ন করা যাবে। বাঙালির বাড়িতে চাল থাকে ডাল থাকে। সাথে সাথে তাকে ডিম ভাজি করে খাওয়ানো যায়। এজন্য আনত্মরিকতা জরুরি। আমার সংসারে এটাকেই আমি গুরুত্ব দেই। যখন আমাদের নাটকের শুটিং থাকে তখনো মূলত আরেকটি পরিবারকে চালাতে হয়। আমাদের একজন এডি আছে। ওর নাম মিলন। ওর একটি কথা উল্লেখ করতে চাই। ও সুন্দর করে কথাটি বলে দিদি যখন লোকেশনে থাকে তখন আমরা নিশ্চিনত্ম মনে কাজ করি। মনে হয় মা আছেন সাথে।

আনন্দ আলো: আপনাদের তারুণ্যের বন্ধুত্ব ছিল বেশ আলোচিত। এর কারণ কী? একটু ব্যাখ্যা করবেন?

সুবর্ণা মুস্তাফা: (ভেবে নিয়ে) বন্ধুত্ব হচ্ছে ট্রাস্ট। অর্থাৎ বিশ্বাস। বন্ধুত্ব হচ্ছে… ভালো হোক, খারাপ হোক, অথবা রাগ কিংবা হিংসার ব্যাপারটিও অকপটে বলে ফেলা। বন্ধুত্ব হচ্ছে রেসপেক্ট, সম্মান… এখানে কোনো সেকেন্ড থট নেই। বলব কি বলব না ভেবে বন্ধুত্ব হয় না। বন্ধুত্ব তো আর কনট্রাক্টের সম্পর্ক নয়। বন্ধুত্ব হচ্ছে ভালোবাসার সম্পর্ক। যেখানে বিশ্বাস খুবই জরুরি।

আমাদের সময় একটা ব্যাপার ছিল… তখন আমরা যারা বন্ধু ছিলাম সবার সাথে সবার একটা যোগসূত্র ছিল। একে অন্যের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলাম। যেমন ধরা যাক ইমদাদুল হক মিলনের কথা। ও তো লেখালেখির জগতের মানুষ। আমি অভিনয় করি। তবুও আমরা তখন থেকেই খুব ভালো বন্ধু। আমাদের আরেক বন্ধু যে যোবায়ের টেক্সাসে ছিল। ডালাসে মারা গিয়েছে। আমি একবার আমেরিকায় গিয়েছিলাম। ও ডালাস থেকে গাড়ি চালিয়ে হিউস্টনে এসে আমাকে ডালাসে নিয়ে গিয়েছিল।

ওই সময় আসলে আমরা সবাই বড় হচ্ছিলাম। বাংলাদেশও তরুণ ছিল। ’৭৫ সালে বাংলাদেশের বয়স তখন ৪। তখন সব কাজে এক ধরনের আলাদা প্যাশন ছিল। আমরা যে কাজগুলো করছিলাম সেগুলো এর আগে কেউ করেনি। প্রসেনিয়াম ভেঙ্গে কীভাবে থিয়েটার করা যায় তার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। মিউজিকে আজম খান, ফিরোজ সাঁই, ফকীর আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, হ্যাপী আকন্দ, লাকী আকন্দ নতুন একটা জোয়ার সৃষ্টি করেছিলেন। চিত্রকলায় তখন আমরা শাহাবুদ্দিনের সাথে পরিচিত হতে শুরু করেছি। যিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, তখনকার দিনে তারুণ্যই মিডিয়াকে এগিয়ে নিয়েছে। সেলিম আলদীন, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, আল মনসুর, আব্দুল্লাহ আল মামুন তখন ছিলেন তরুণ। সবার মাঝে সৃষ্টির পজেটিভ উন্মাদনা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। ভালো কাজের প্রয়োজনেই ঈর্ষণীয় বন্ধুত্বও গড়ে উঠেছিল সবার মাঝে।

আনন্দ আলো: বন্ধুত্ব আসলে টিকে থাকে কীভাবে? কোনো ফর্মুলা আছে কি?

সুবর্ণা মুস্তাফা: কোনো ফর্মুলা নেই। অনেস্টির মাঝেই বন্ধুত্ব টিকে থাকে। তবে এটাও সত্যি কথা… মানুষের জীবনের চাহিদা অগ্রাধিকারের বিষয়টি সবসময় এক থাকে না। সময়ের প্রয়োজনে পাল্টায়। একই কারণে ছোটবেলার বন্ধু হয়তো হারিয়ে যায়। যোগাযোগ থাকে না। আমার স্কুল জীবনের অনেক বন্ধুর সাথে এখনো ফেসবুকে কথা হয়। আমরা সময়টাকে ফিল করি। ছোটবেলার কথা ভেবে আবেগতাড়িত হই। মিডিয়ার বন্ধুত্ব ব্যাপারটাই ডিফিকাল্ট। এর কারণ হতে পারে কম্পিটিশন। কিন্তু কম্পিটিশনের কথা যদি ধরি আমাদের তারুণ্যে কি সেটা ছিল না? ছিল। কিন্তু সে সময় এপ্রিসিয়েশনও ছিল। মনে আছে বিটিভিতে আমার এবং আফজালের জুটি হিসেবে প্রথম যে নাটকটি ক্লিক করল তার নাম চেহারা। আনিস চৌধুরীর লেখা নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন আতিকুল হক চৌধুরী। বিটিভিতে ‘চেহারা’ প্রচারের পরের দিন কি এক কাজে আমি বিটিভিতে গিয়েছিলাম। আমাদের মিতা চৌধুরী আমাকে দেখে দূর থেকে চিৎকার দিয়ে বলল, এ্যাই একদম নড়বি না। দাঁড়িয়ে থাক। শয়তানি মেয়ে… বলেই দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে দুই গালে চুমু দিয়ে বলল, সব ভালো ভালো ক্যারেক্টার তুই করলে আমরা করব কি? ব্যাপারটা কি দাঁড়াল? ওর চুমো এবং আদরের ব্যাপারটা যেমন হানড্রেড পারসেন্ট জেনুইন ছিল তেমনি ঈর্ষাটাও জেনুইন ছিল। কিন্তু এ্যাপ্রিসিয়েশনটাও হানড্রেড পারসেন্ট জেনুইন ছিল। এভাবে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়।

শম্পা রেজার কথা বলি। একদিন ডলস হাউসের শুটিং চলাকালে আমাকে হঠাৎ খুব বকাঝকা করল। আমি চুপ হয়ে গেলাম। শুটিং স্পটে জলিকে ব্যাপারটা খুলে বললাম, আমার ধারণা শম্পা আজ কোনো কারণে দারুণ আপসেট। কি করা যায় বল তো? কিছুক্ষণ পর আমিই শম্পার সাথে কথা বলা শুরু করলাম। ব্যাপারটা নয়মাস হয়ে গেল। বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে তোমাকে একজন কনফিডেন্ট পারসন হতে হবে। যারা বলে বেড়ায় আমার কোনো বন্ধু নেই তারা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে অভাগা মানুষ। বন্ধুবিহীন জীবন! ও মাই গড! অসহ্য জীবন! কেন তোমার বন্ধু থাকবে না? তুমি নিশ্চয়ই স্বার্থপর। স্বার্থপর মানুষের কোনো বন্ধু থাকে না।

আনন্দ আলো: আপনার কয়েকজন প্রিয় বন্ধুর নাম বলা যায়?

সুবর্ণা মুস্তাফা: আমার একজন বন্ধু আছে ওর নাম রাজু জামালী। মাসুদ আলী খান জামালী এবং কণ্ঠশিল্পী রওশন আরা মাসুদ ছিলেন রাজুর বড় ভাই-ভাবী। তারা ছিলেন আমার বাবা-মায়ের ক্লোজ ফ্রেন্ড। তখন কিন্তু আমার সাথে রাজুর পরিচয় হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বের হয়েছি। হঠাৎ একজন আমার সামনে এসে বলল- আমার নাম রাজু। আমি তোমার চাচা হই। সেদিন তাকে সালাম দিয়ে বলেছিলাম-  ামালেকুম। কেমন আছেন! সেই রাজু পরবর্তীতে আমার ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে। আজ পর্যনত্ম তার এবং তার পরিবারের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ আছে। আমার আরেক বন্ধুর নাম সারা। তার কথা মিডিয়ার সবাই জানে। ওকে বন্ধু বলব নাকি সোলমেট বলব? সারা আমার জীবনের অনেক কিছু…।

কারো সেমপ্যাথি নেওয়ার জন্য নয়। আমার বাবা-মা বেঁচে নেই। আমার একটিমাত্র ভাই থাকে আমেরিকায়। আমি খুবই ভাগ্যবান যে সারা এবং রাজুকে পাশে পেয়েছি। ওরা আমার পরিবারের একটি বড় অংশ। দিন রাত ২৪ ঘণ্টা তাদের সাথে আমার যোগাযোগ থাকে। আফসানা মিমির কথা বলতে চাই। তার ছোটবেলা থেকে বড় হওয়া পর্যনত্ম মোটামুটি আমার সাথেই কেটেছে। মিমি প্রায়ই বলে সকালে ঘুম থেকে উঠে সুবর্ণা আপার বাসা। রাতে বাসায় যদি রান্না না হয়ে থাকে তাহলেও সুবর্ণা আপার বাসা। বেশি টায়ার্ড হয়ে গেলেও সুবর্ণা আপার বাসা। মিমি আমার খুব ভালো বন্ধু। সাবেরী আলম, জলি, চিত্রা, বন্যা, সাজু আমার অনেক প্রিয় বন্ধু।

আনন্দ আলো: এক সময় অভিনয় জুটি বেশ আলোচিত ছিল। এখন কেন জুটি গড়ে উঠছে না?

সুবর্ণা মুস্তাফা: এ ব্যাপারে অনেক কথাই বলা যায়। আমার এবং আফজালের জুটির কথা অনেকে বলবে। সে সময় রাজ্জাক-কবরী জুটি ছিল। ববিতা-ফারুক ছিল। কলকাতায় উত্তম-সুচিত্রা ছিলেন। সৌমিত্র-অপর্ণা সেনের জুটিও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এখন কিন্তু কোথাও সেভাবে জুটি গড়ে ওঠেনি।

আনন্দ আলো: কেন? সময় কী পারমিট করছে না।

সুবর্ণা মুস্তাফা: সময় পারমিট করছে কিনা জানি না। কিন্তু তখনকার দিনে অভিনয় করত কম সংখ্যক অভিনেতা-অভিনেত্রী। সে কারণে এর সাথে ওকে দেখলে ভালো লাগবে এরকম একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল। আমার এবং আফজালের জুটি নিয়ে অনেক কথা আছে। উইথ ইজ ফাইন! আমার এবং আফজালের অনেক ভালো নাটক আছে। কিন্তু ইকোয়েলি ভালো নাটক আছে ফরীদির সাথে। ইকোয়েলি ভালো নাটক আছে নূর ভাইয়ের সাথে। জুটি আসলে বানায় অডিয়েন্স এবং মিডিয়া।

আনন্দ আলো: নাটক অথবা সিনেমাকে জনপ্রিয় করার জন্য জুটির প্রয়োজন আছে কী?

সুবর্ণা মুস্তাফা: না। আমি তা মনে করি না। নাটক অথবা সিনেমা জনপ্রিয় হবে তার মেরিটের মাধ্যমে। অভিনয় দিয়ে। আমাকে আর আফজালকে একসঙ্গে দেখতে দর্শকের ভালো লাগত। আমরা একই গ্রুপে কাজ করতাম। আমাদের সময় এটা করো না, ওটা করো না এ ধরনের বাধা কম ছিল। সে কারণে আমরা নিজেরা নিয়ন্ত্রিতও ছিলাম। আমি তো মনে করি স্বাধীনতা সবচেয়ে বড় শৃঙ্খল। আমার মা জীবনে কোনোদিন আমার নাটকের রিহার্সেলে যায়নি। বর্তমান সময়ে মায়েদের ভূমিকা দেখে আমি বিস্মিত হই। এক মাকে জানি তিনি মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে পাঠিয়ে বাইরে গাড়িতে বসে থাকে। এটার কি কোনো প্রয়োজন আছে? অনেক অভিনেত্রীর মাকে দেখি শুটিং স্পটে এসে অযথাই বসে থাকে। মেয়েকে পাহারা দেয়। এভাবে যদি পাহারাই দিতে চান তাহলে মেয়েকে মিডিয়ায় কাজ করার অনুমতি দিয়েছেন কেন? মেয়ে যদি নিজে ঠিক না থাকে তাহলে পাহারা দিয়ে কিছু হবে? আমার মা আমাকে ক্লিয়ার বলে দিয়েছিলেন- বাইরে কাজ করতে গেলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। এটা তোমার দায়িত্ব। আমরা তোমাকে বিশ্বাস করি বলে স্বাধীনতা দিয়েছি। এটা রক্ষার দায়িত্ব তোমার।

আনন্দ আলো: দেখতে দেখতে মিডিয়া অনেক বড় হয়ে গেল। টিভি চ্যানেলের সংখ্যা ২১টি। আরো চ্যানেল আসছে। সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আপনার ধারণা কী, আমরা কোথায় দাঁড়ালাম?

Subarna-Mustafa-1সুবর্ণা মুস্তাফা: (দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভেবে নিয়ে) কোথায় দাঁড়ালাম। দাঁড়ালাম একটা অদ্ভুত জায়গায়। যেখানে সব চ্যানেলে অনুষ্ঠানের চেয়ে বিজ্ঞাপন বেশি হয়। যেখানে কোয়ালিটির চেয়ে কোয়ানটিটিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কোয়ালিটির কাজ করতে গেলে রীতিমতো ফিনান্সিয়াল বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। জগতের সবকিছুরই দাম বেড়ে গেছে। যে গাড়ি ১৮ শ টাকায় ভাড়া করতাম সেই গাড়িকে দিতে হয় সাড়ে তিন হাজার টাকা। খাবারের দাম বেড়েছে। শিল্পীর সম্মানী বেড়েছে। কিন্তু কেন কোনো টেলিভিশন কর্তৃপক্ষই বুঝতে পারছেন না নাটকের নির্মাণ ব্যয়ও বাড়াতে হবে? আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই কিছু মেধাবী মানুষ আর পাগলামির কারণে এখনো টেলিভিশনে ভালো কিছু কাজ হচ্ছে। কিন্তু ভবিষ্যতে একটা সময় আর ভালো কাজ হবে না। এটা এখন মোমেন্টাসের ওপর চলছে। বিভিন্ন চ্যানেল রিয়েলিটি শো-এর দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আমি সরাসরি চ্যানেল আই-এর কথা বলতে চাই। ‘চ্যানেল আই ইজ দ্যা চ্যানেল’ যার টাকা-পয়সা নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। যার ‘অল পেমেন্ট ক্লিয়ার’। চ্যানেল আই কেন ভালো মেকারসদেরকে ডেকে এনে- ‘করো’ বলে একটা ফিল্ড করে দিবে না। বাধা কোথায়? চ্যানেল আই এই মিডিয়ার উন্নয়নে অনেক কিছু করতে পারে।

আনন্দ আলো: একসময় সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন! এখন কেন করছেন না?

সুবর্ণা মুসত্মাফা: সিনেমা আমার খুবই পছন্দ। আই লাভ সিনেমা। প্রচুর কমার্শিয়াল ছবি করেছি। সেগুলো হিটও করেছে। শহীদুল ইসলাম খোকন আমাকে প্রায়শই বকাঝকা করে। তার ধারণা শাবানা আপার জায়গাটা আমি ধরে রাখতে পারতাম। ছবিতে অশ্লীলতা ঢুকত না। তার কথা আসলেই সত্যি! ছবিতে নিয়মিত হওয়া উচিত ছিল। কিছু ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে সিনেমায় নিয়মিত হতে পারিনি। তবে আমি সিনেমায় অভিনয় করতে আগ্রহী। বাণিজ্যিক ছবিতেও অভিনয় করতে চাই। ভালো স্ক্রিপ্ট, সম্মানজনক সম্মানী, ভালো পরিচালকের কাজ হয় তাহলে অবশ্যই কাজ করব। নাচে-গানে ভরপুর ছবিতেও কাজ করতে আগ্রহী। আই ডোন্ট মাইন্ড… আমি তো এন্টারটেইনার। শিক্ষা দিতে তো আসিনি। শিক্ষা দিতে আসলে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতাম। হ্যাঁ, তবে আমি সুস্থ এন্টারটেইনমেন্ট দিতে চাই। তার মানে এই নয় এটা দেখতে গিয়ে হলে দর্শক ঘুমিয়ে গেল! এই ধরনের চলচ্চিত্রে আমি বিশ্বাস করি না।

আনন্দ আলো: একটু আগেই আপনি কিছু ব্যক্তিগত সমস্যার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। জীবনের শুদ্ধতম একটা সিদ্ধানত্ম নিয়েছেন। এ ব্যাপারে কোনো অভিমান অভিযোগ আছে কী?

সুবর্ণা মুস্তাফা: না, মোটেই না। ভেরি সিম্পল… সেটা হচ্ছে… আই মেড এ চয়েজ। এবং সেই চয়েজটা হচ্ছে একদমই সারভাইভ করার জন্য, যেটার কাজ করার জন্য। সৌদের সাথে বিয়ে অনেক পরের ঘটনা। এ নিয়ে মানুষ অনেক কথা বলে। আই ডোন্ট কেয়ার। সত্য তো আমি জানি। আই মেড এ চয়েজ। খুবই বিস্ময়কর যে, এ ব্যাপারে আমাকে কোনো সংগ্রাম বা সংকটে পড়তে হয়নি। হুমায়ুন ফরীদির সাথে আমার সংসার ছিল এখন নেই। ডিভোর্স পৃথিবীতে প্রথম ঘটনা না। দৈনন্দিন জীবনে এটা অহরহ ঘটছে। কিছু মানুষ অবশ্যই আছেন যারা ভাবেন এর সাথে বন্ধুত্ব হলে ওর কাছে যাওয়া যাবে না। সেটা তাদের হীনমন্যতা। তার দায়-দায়িত্ব আমি নিতে পারব না। আই অ্যাম পারফেক্টলি হ্যাপি। আমার যারা তখনো বন্ধু ছিল তারা আমার এখনো বন্ধু! যারা কলিগ ছিল তারা এখনো আমার কলিগ। আমি পারসোনালি ফাইন উইথ এভরিথিং। কারো প্রতি আমার কোনো অভিমান, অভিযোগ নেই। সেলিম আলদীনের একটা কথা ‘কোট’ করতে চাই। তিনি বলেছেন- যে যার মতো করে জীবন-যাপন করো। প্রত্যেকের রাইট টু চ্যুজ আছে। সে চ্যুজ করেছে। আমি কাউকে কখনো বলিনি যে ওখানে যাবে না। এই ধরনের ডিসিশন যে নিয়েছে যে ওনার সাথে মিশলে আমার সাথে মেশা যাবে না সেটা তার সমস্যা। সেটা আমার না। একেবারেই আমার না। আমি রাখঢাক করে জীবন-যাপন করতে পছন্দ করি না। যেদিন আমার সাথে সৌদের বিয়ে হয়েছে কাবিননামায় সই করে সেদিনই সমসত্ম পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে খবরটা জানিয়েছি। বিয়ে তো সেলিব্রেট করার জিনিস। লুকানোর জিনিস নয়। যারা বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্কের খবর লুকায় তারা হিপোক্রাট।