Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

স্বর্ণ-কিশোরীরাই গড়বে সোনার বাংলাদেশ!

মোহাম্মদ তারেক: জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এই দেশে জনসংখ্যার ২৬ শতাংশই ১০-১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী। এর মধ্যে ৪৮ ভাগই কিশোরী। যাদের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি। এদের মধ্যে কিশোরদের চেয়ে কিশোরীদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে পশ্চাৎপদ। বাংলাদেশে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে প্রজনন হার সার্ক এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তুলনামূলক বেশি। অনুরূপভাবে মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুর হারও বেশি।

তবে মাতৃমৃত্যুর হার বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে অনেক কমেছে। প্রতি এক লাখ জীবিত সনত্মান জন্মদানের ক্ষেত্রে মাতৃমৃত্যুর হার ২০০১ সালে ছিল ৩২০ জন এবং ২০১০ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১৯৪ জন। তারপরও সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা এমডিজি অর্জন করতে হলে মৃত্যুর এই সংখ্যা ১৯৪ থেকে ১৪৩ এ নামিয়ে আনতে হবে। গত কয়েক বছরে আমাদের দেশে শিশুমৃত্যুর হারও কমেছে। বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে। তবে এখনো তা অনেক উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বেশি। আজকের কিশোরীরাই আগামী দিনের মা। তাই কিশোরীদের বয়ঃসন্ধি স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন ও শিক্ষিত করে আমরা ভবিষ্যতে মাতৃমৃত্যু হ্রাসসহ নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে পারি।

পর্যায়ক্রমে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে সকল কিশোরী স্বর্ণ-কিশোরী নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে এবং বয়ঃসন্ধিকালীন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিজে জানবে এবং অন্যদের জানাবে। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে ২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করেছে স্বর্ণ-কিশোরী। ২০১৪ সালে বিভাগীয় পর্যায়ে, ২০১৫ সালে জেলা পর্যায়ে, ২০১৬ সালে উপজেলা, ২০১৭ সালে ইউনিয়ন, ২০১৮-১৯ সালে গ্রাম পর্যায়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে স্বর্ণ-কিশোরী প্রকল্প তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে।

স্বর্ণ-কিশোরী হচ্ছে বাংলাদেশের সেই ‘স্বপ্ন-কন্যা’ যে নিরাপদ মাতৃত্ব এবং কিশোরী বয়ঃসন্ধি স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিজেকে শিক্ষিত, সচেতন এবং আলোকিত করবে এবং স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে অন্যান্য কিশোরীদের এই বিষয়ে আলোকিত করে তুলছে। অর্থাৎ একজন স্বর্ণ-কিশোরী এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে সদা সচেষ্ট থাকবে।

স্বর্ণ-কিশোরীর প্রধান কাজ নিরাপদ মাতৃত্ব ও কিশোরী বয়ঃসন্ধি স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিজেকে সচেতন ও সক্ষম করা এবং অন্যদেরকে এ বিষয়ে অনুরূপভাবে আলোকিত হতে সহায়তা করা। সংক্ষেপে বলতে গেলে তাদের ভূমিকা হচ্ছে স্বর্ণ-কিশোরী প্রকল্পের উদ্দেশ্যসমূহ অর্জনে কাজ করা। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে দেশ জুড়ে অংশগ্রহণকারী কিশোরীদের মধ্য থেকে ২০১৪ ও ২০১৫ সাল একজনকে বর্ষসেরা স্বর্ণ-কিশোরী নির্বাচন করা হচ্ছে। বর্ষসেরা স্বর্ণ-কিশোরী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যেসব কিশোরী অংশগ্রহণ করে তাদের সকলকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়।

২০১৮ সালের থেকে মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি কিশোরী এই প্রকল্পে আওতাভুক্ত হবে। এ প্রকল্প আশা করছে যে সচেতনতা এবং তথ্যের অভাবে কোনো কিশোরী তার শপথগুলো থেকে আগামীতে সরে দাঁড়াবে না বরং অন্যদেরও তা পরিপালনে সহায়তা করবে। বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে এবং প্রতিটি নারীর জন্য নিরাপদ মাতৃত্ব ও নিরাপদ কিশোরী বয়ঃসন্ধি স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণকে উপজীব্য করে চ্যানেল আই-এর অনুষ্ঠানমালায় যুক্ত হয়েছে সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক অনুষ্ঠান স্বর্ণ-কিশোরী। প্রতিটি স্বর্ণ-কিশোরী চারটি বিষয়ে শপথ নিয়ে তার যাত্রা শুরু করে। নিচের বিষয়গুলোতে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে- ১. ১৮ বছরের আগে বিয়ে নয়, ২. ২০ বছরের আগে গর্ভধারণ নয়, ৩. ভাই আর বোন পুষ্টিকর খাবারে সমান দুইজন, ৪. বয়স ১৫ বছর যখন টিটি টিকার ৫ ডোজের শুরু তখন।

DSC-1388প্রসঙ্গ: স্বর্ণকিশোরী সুস্বাস্থ্য ক্লাব

বাংলাদেশের ৬৪ জেলার ৪৮৮ উপজেলায় একটি করে স্বর্ণ-কিশোরী সুস্বাস্থ্য ক্লাব নির্মিত হবে। এই ক্লাব বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ রোধ করবে, কিশোরী সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করবে। স্বর্ণ-কিশোরী আর সূর্য কিশোর মিলে ৩০ জন সদস্য এই ক্লাবটি পরিচালনা করবে।

স্বর্ণকিশোরী সুস্বাস্থ্য ক্লাবের উদ্দেশ্য: ১. বয়ঃসন্ধি স্বাস্থ্য ও নিরাপদ মাতৃত্ব অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করা।

২. কিশোরীদের বয়ঃসন্ধি অধিকার ও সেবা সহজলভ্য করা।

৩. কিশোরীদের জীবন দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের জীবনমান উন্নয়ন।

৪. নারী পুরুষ বৈষম্যহীন ও পারস্পরিক সুরক্ষামূলক সমাজ গঠনে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি।

৫. কিশোরীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা।

৬. বাল্যবিবাহ, যৌন নিপীড়ন, যৌতুক, হাত ধোঁয়া, মাসিক, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি।

স্বর্ণ-কিশোরী সুস্বাস্থ্য ক্লাবের লক্ষ্য:  পরিবার ও সমাজ সহায়ক পরিবেশে কিশোরীদের সুস্বাস্থ্যের পাশাপাশি সুষ্ঠু সমাজ পরিবর্তনে সক্রিয় এজেন্ট হিসেবে ক্ষমতায়িত করা।

সারাদেশে স্বর্ণ-কিশোরী স্বাস্থ্যক্লাব গঠন করা হবে

-ফারজানা ব্রাউনিয়া, নেটওয়ার্ক প্রধান, স্বর্ণ-কিশোরী

আনন্দ আলো: স্বর্ণ-কিশোরী কোন ভাবনা থেকে শুরু

ফারজানা ব্রাউনিয়া: একজন মা। যিনি পৃথিবীকে আলোকিত করেন মানব সনত্মান দিয়ে। ঈশ্বরের এই সৃষ্টির খেলা তার মাধ্যমেই ঘটে থাকে। এই মহৎ কাজটি করতে গিয়ে তথ্যের অভাবে কোনো মা যেন মৃত্যুবরণ না করেন। এই চিনত্মা থেকে চ্যানেল আইতে আমরা শুরু করেছিলাম জনকল্যাণমুখী অনুষ্ঠান ‘আমি মা হতে চলেছি’। গর্ভকালীন সময়ে একজন হবু মা কি করবেন, কিভাবে চলবেন। এ বিষয়গুলো তুলে ধরা হতো এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। অনুষ্ঠানটি দেশের লক্ষ লক্ষ প্রসূতি মায়ের সচেতনায় রেখেছে অনন্য অবদান। যখন একটি মেয়ে গর্ভবতী হয়ে যান তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। তার পেটে বাচ্চা চলে এসেছে। তার আগেই আমরা যদি সেই মেয়েটির কিশোরী বয়সে যখন তার প্রথম মাসিক হয়, সেই সময়টাকে তাকে স্বাস্থ্য নিয়ে, তার জীবন নিয়ে, শিক্ষা নিয়ে সচেতন করতে পারি তাহলে আমরা একজন শ্রেষ্ঠ মা পেতে পারি। আর শ্রেষ্ঠ মা মানেই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সনত্মান। একজন মা যদি নিজের শরীর সুস্থ রাখে, তবেই সে সঠিক ওজনের বাচ্চা জন্ম দিবে। আর যে শিশুটিকে আমরা তার পেটের মধ্যে বাচ্চা দিয়ে দিচ্ছি, তার নিজের শরীর তখনও সনত্মান ধারণের জন্য প্রস্তুত হয়নি, কিন্তু প্রক্রিয়ার মধ্যে সনত্মানও ধারণ করে ফেলেছে। ফলে কিশোরী মা এবং তার সনত্মান দু’জনের জীবনই হয়ে পড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ। একটি শিশুর গর্ভে আরেকটি শিশুর জন্ম কীভাবে নিরাপদ হতে পারে?

এই ভাবনা থেকে মূলত স্বর্ণ-কিশোরীর কার্যক্রম শুরু। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৬ ভাগ হলো ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী। ৪৮ ভাগই কিশোরী। যাদের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি। ২ কোটি মেয়েকে যদি স্বাস্থ্য, শিক্ষ্য, তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করতে পারি তাহলে আমরা পাবো আমাদের সোনার বাংলাদেশ। স্বর্ণ কিশোরদেরকে নিয়েই একটা বলিষ্ঠ বাংলাদেশ, তারপর স্বর্ণ-কিশোরীদেরকে নিয়েই একটি বলিষ্ঠ পৃথিবী গড়তে চাই আমরা।

আনন্দ আলো: আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

ফারজানা ব্রাউনিয়া: ভবিষ্যতের আগে তো বর্তমান! এই বর্তমান পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার দু’টি বছর আমরা সফলতার সঙ্গে শেষ করেছি। সামনের তিনটি বছর শেষ করতে হবে। তিনটি বছরের এই একটি বছর আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই বছরই নির্মিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ৬৪ জেলার ৪৮৮ উপজেলায় একটি করে স্বর্ণ-কিশোরী সুস্বাস্থ্য ক্লাব। এই ক্লাব বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ রোধ করবে। স্বর্ণ-কিশোরী আর সূর্য-কিশোর মিলে ৩০ জন সদস্য নিয়ে এই ক্লাবটি গঠিত হবে। এই ক্লাবের মাধ্যমে তারা আমাদের বিভিন্ন জাতীয় ও আনত্মর্জাতিক দিবসগুলো (বিশ্বস্বাস্থ্য দিবস, নারী দিবস, এইডস দিবস, জাতীয় শিশু দিবস, বেগম রোকেয়া দিবস, নারী দিবস, শহীদ দিবস, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি) উদযাপন করবে। এটা অত্যনত্ম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে আমরা এবছরই বাংলাদেশের সবকটি উপজেলায় আমাদের স্বর্ণ-কিশোরী সুস্বাস্থ্য ক্লাব নিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছি। তাই পরিকল্পনা শেষ করেই পরবর্তী পরিকল্পনায় পা রাখতে পারব বলে আমাদের বিশ্বাস।  5