সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
বিকাশ সউদ আনসারী। বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য স্থপতি। ফেরো সিমেন্ট কংক্রিট, ইকো ফ্রেন্ডলী স্ট্রাকচার নিয়ে স্থাপত্য শিল্পে দেশের জন্য সৃষ্টিশীল কাজ করে চলেছেন। তিনি বাঁশের বিশেষ প্রয়োগে স্ট্রাকচার হিসেবে বাঁশকে উপযোগী করে তোলার জন্য বিভিন্ন রকম গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্য বিষয়ে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। পাস করে বের হওয়ার পর পরই চার বন্ধু মিলে গড়ে তোলেন ‘স্থাপতিক’ নামের একটি আর্কিটেকচারাল ফার্ম। ২০০০ সালে নিজে গড়ে তোলেন ‘এ প্লাস এএ আর্কিটেকটস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এ যাবৎ তিনি বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার ডিজাইন করেছেন। তার ডিজাইন করা স্থাপত্য আগাখান ইসলামিক আর্কিটেকচার কার্যক্রমের অধীনে আন্তর্জাতিক স্থাপত্য জার্নাল মিমার-এ পর পর দুইবার প্রথম স্থান লাভ করে। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগে প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি স্থাপত্য চর্চা করে যাচ্ছেন নিয়মিত। এবার শাহ্ সিমেন্ট সুইট হোমে তাকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক
চার ভাইবোনের মধ্যে আর্কিটেক্ট বিকাশ সউদ আনসারী সবার ছোট। তার গ্রামের বাড়ি খুলনা জেলার রাম ভদ্রপুরে। তার জন্ম খুলনার বিএল কলেজ ক্যাম্পাসে। বাবার নাম মু. মুসা আনসারী (মৃত)। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ছিলেন। মা সুরাইয়া আনসারী গৃহিণী।
স্কুল জীবন থেকেই সাংস্কৃতিক কর্মকাÐের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আঁকাআঁকির প্রতি ছিল তার প্রচÐ নেশা। বিভিন্ন বিষয়ের উপর বই পড়া আর লেখালেখি করা ছিল তার পছন্দের বিষয়। অবসর পেলেই খাতা কলম নিয়ে বসে পড়েন স্থাপত্য বিষয়ের উপর লিখতে।
ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছা ছিল বিজ্ঞানী হওয়া। কিন্তু তিনি হয়েছেন সফল একজন স্থপতি। নিজের ইচ্ছা থেকেই আর্কিটেক্ট হয়ে ওঠা তার। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ১৯৭৯ সালে। ১৯৮১ সালে একই কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগে।
বিকাশ সউদ আনসারী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্য বিষয়ে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৮৯ সালে। পাস করে বের হওয়ার পর পরই তিনি সহপাঠী তিন বন্ধু শাহেদুর রহমান বাবলা, রফিক আজম ও আছিয়া চৌধুরী বনুকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘স্থাপতিক’ নামের একটি আর্কিটেকচারাল ফার্ম। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তারা একসঙ্গে কাজ করেন। পরবর্তীতে বন্ধু শাহেদুর রহমানের সঙ্গে স্থাপত্য চর্চা চালিয়ে যান। এরই মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ বর্ষে আরবান ডিজাইন স্থাপত্য স্টুডিও পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তিনি।
২০০০ সালে স্থপতি বিকাশ সউদ আনসারী নিজে গড়ে তোলে ‘এ প্লাস এ এ আর্কিটেক্টস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। উত্তরার নিজ বাসভবনে খুব সুন্দর একটি অফিস সাজিয়েছেন তিনি। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের তিনি স্থাপত্যের নানা বিষয়ে হাতেকলমে শিক্ষা দিচ্ছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি স্থাপত্য চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
ইতোমধ্যে বিকাশ সউদ আনসারী দেশের নামকরা মেডিক্যাল কলেজ ও হোস্টেল, হাসপাতাল, ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ইউনিভার্সিটি, শপিং সেন্টার, স্কুল, হোটেল কমপ্লেক্স, অফিস বিল্ডিংসহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছেন। স্থাপতিক প্রতিষ্ঠানে থাকাকালীন সময়ে তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে চিটাগাং-এর ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি (আইআইইউসি)সহ বিভিন্ন মাস্টার প্লান, ক্যাম্পাস প্লান, বন্যাদুর্গতদের জন্য বিশেষ পদ্ধতির প্রোটোবেল বাড়ি, বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বেক্সিমকো গ্রæপের ইন্টেরিয়র ডিজাইন, রহিম আফরোজ এর ইন্টেরিয়র ডিজাইন ইত্যাদি।
এ প্লাস এএ আর্কিটেক্টস ফার্মের হয়ে তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টের ফিরো সিমেন্ট কংক্রিটের প্রয়োগে লাইট স্ট্রাকচার টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (টিটিআই), রংপুর ক্যান্টনমেন্টের ফেরো সিমেন্ট কংক্রিট এবং আরসিসি নির্মাণ পদ্ধতি প্রয়োগে ক্যান্টনমেন্ট স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষের বাসভবন, রংপুরের আর্মি মেডিক্যাল কলেজের জন্য আর এ এম সি নামের একটি ১৭ তলা হোস্টেল, মেডিক্যাল কলেজ ও আন্তর্জাতিক মানের শপিং সেন্টার, নাভানা গ্রæপের বিভিন্ন প্রজেক্টের কাজ, চিটাগাং মেট্রোপলিটন গ্রæপের হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, স্কুল এবং অ্যাপার্টামেন্ট বিল্ডিং, যশোরের জেনেসিস হাসপাতাল, কক্সবাজারের ১১তলা বিশিষ্ট ডাভ সী কুইন হোটেল কমপ্লেক্স, সাভারের কলমাই রিসোর্ট কেন্দ্রিক মাল্টি পারপাস ডেভলপমেন্টের কাজসহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছেন। এছাড়া বর্তমানে বেশ কিছু প্রজেক্টের কাজ করছেন। আনসারী তার সব ধরনের কাজ স্থাপত্য নীতি ও রাজউকের নিয়ম মেনেই করেন।
২০০০ সালে তিনি বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম সামীনা আনসারী। তিনি একজন বিউটিশিয়ান এবং রন্ধনশিল্পী। এই দম্পতি এক ছেলে সন্তানের জনক-জননী। ছেলের নাম সুধীন হামেদ আনসারী। সে উত্তরার স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। স্থপতি বিকাশ সউদ আনসারী বলেন, আমি বিশ্বাস করি গবেষণার মাধ্যমে আমাদের দেশের নিজস্ব সংস্কৃতিকে আধুনিকতার স্পর্শে, নন্দনচর্চার নব নব শৈলীতে প্রকাশ করা সম্ভব। দেশজ নির্মাণ প্রক্রিয়া, নির্মাণ কাঠামো, নির্মাণশৈলী, ম্যাটেরিয়াল বাঁশ, কাঠ, বেত, চামড়া, মাটি ইত্যাদির সঙ্গে আমি পশ্চিমা ধাঁচের ফিউশনের চেষ্টা করছি। নিজ দেশ, নিজ সংস্কৃতি, নিজ আবহাওয়া ইত্যাদি আমার গবেষণার মূল উৎসাহ। আমি প্রতিনিয়ত পশ্চিম এর থেকে পাওয়া বা জানা নির্মাণ ভাবনার সংমিশ্রণে প্রয়োগ করতে চাই। টিটিআই প্রজেক্টে আমি ফেরো সিমেন্ট কংক্রিট এর নিজস্ব প্রয়োগবিধিকে মাথায় রেখে প্লেট হিসেবে স্ট্রাকচারের রূপায়ণ করতে চেষ্টা করেছি। যা মূলত আমাদের দেশের নি¤œবিত্ত বা মধ্যম নি¤œবিত্তদের আবাসনের জন্য ভীষণভাবে উপযুক্ত। যদিও এই নির্মাণ পদ্ধতি বিশষায়ীত হওয়ায় প্রচুর ট্রেনিং প্রয়োজন। তাই আমি ক্রমান্বয়ে দেশে এই অলটারনেটিভ প্রযুক্তিকে জনপ্রিয় করবার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমি কংক্রিটের ফর্ম ফিনিশ চেহারাকে আমার স্থাপত্য চেষ্টায় প্রায়ই প্রয়োগ করবার প্রয়াসে লিপ্ত থাকি। ফেরো সিমেন্ট কংক্রিটের প্রয়োগের মাধ্যমে সাশ্রয় মূল্যে ফেয়ার ফেস ফিনিশ প্রয়োগ করার জন্য প্রতিনিয়ত গবেষণা করছি।
আমি বিশ্বাস করি বিল্ডিং নির্মাণে, ইন্ডাস্ট্রি, ব্রিজ, সুউচ্চ বা বহুতল ভবন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মসজিদ, মন্দির ইত্যাদি সব জায়গায় স্বল্প মূল্যের ফেরো সিমেন্ট কংক্রিটের ব্যাপক প্রয়োগ আনা একান্ত প্রয়োজন। বাঁশের স্ট্রেকচার এবং ফেরো সিমেন্ট কংক্রিটের প্রয়োগের মাধ্যমে এবং র্যামড আর্থ এর প্রয়োগের মাধ্যমে একটি ব্যাপক ভিত্তিক নির্মাণ প্রাকটিসে ব্যস্ত থাকতে চাই, যার মাধ্যমে একটি উন্নয়নশীল বা মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আমাদের আপামর জনসাধারণ স্থাপত্যের সহজ, মিতব্যয়, স্বল্প মূল্যের কাঠামো নির্মাণে উদ্যোগ রাখতে পারি। যার ফলে আমরা আমাদের নিজস্ব ভাবনা, ধ্যান, দর্শন ইত্যাদির নিজস্ব রূপ তৈরি করতে পারব।
তিনি আরো বলেন, আমার শিক্ষকতার মাধ্যমে একটি মনোযোগী দায়িত্ববোধ সম্পন্ন মেধাবী পরিশ্রমি তরুণ স্থপতি সৃষ্টি করতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমার শিক্ষার্থীরা যেন ভবিষ্যতে দেশে ও বিদেশে সফলতার সঙ্গে স্থাপত্য চর্চায় যুক্ত থাকবে এবং নিজ দেশের ভাবমূর্তিকে পৃথিবীর কাছে তুলে ধরবে। ভবিষ্যতে আমার ইচ্ছা চর্চা, জ্ঞান ও গবেষণাতে আমি আজীবন নিযুক্ত থেকে জনকল্যাণে ভূমিকা রাখতে চাই। বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু, প্রকৃতিকে ঠিক রেখে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের দিকে নজর দেন তিনি। এই স্থাপতি তার কাজ সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে করতে ভালোবাসেন। পেশার কাছে দায়বদ্ধ থেকে সেটাকে সততার সঙ্গে শেষ করতে চান স্থপতি বিকাশ সউদ আনসারী।