সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
সৈয়দ ইকবাল: একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রী তার অভিনয় জীবনে অনেক চরিত্রের মুখোমুখি হন। অর্থাৎ তাকে প্রতিনিয়ত ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে রূপদান করতে হয়। এজন্য নিজেকে প্রতিদিন বদলাতে হয়। আর তাই একজন শিল্পীর ক্ষেত্রে ‘মেকআপ, গেটআপ’ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উপমহাদেশের জীবন্ত কিংবদনিৱতুল্য অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন ‘পা’ নামের একটি ছবিতে প্রতিবন্ধী এক কিশোরের চরিত্রে গেটআপ নিয়ে চলচ্চিত্র দুনিয়ায় দারুণ হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। দেশ-বিদেশে বহুল আলোচিত এই ছবিতে অমিতাভ বচ্চন তার ছেলে অভিনেতা অভিষেক বচ্চনের থেকেও কম বয়সী চরিত্রের গেটআপ নেন। অর্থাৎ অভিষেক বচ্চনের প্রতিবন্ধী ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেন অমিতাভ বচ্চন। একটি চলচ্চিত্রের জন্য একজন অভিনেতার এই যে ত্যাগ এবং ছবির চরিত্রে মিশে যাবার আন্তরিক চেষ্টা তা সত্যি প্রশংসনীয়।
‘পা’ ছবিতে অমিতাভের গেটআপ করতে সময় লাগত কয়েকঘণ্টা। প্রতিদিন শুটিং-এর আগে তিনি মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে মেকআপম্যানের সামনে বসতেন। একটা দক্ষ মেকআপ টিম তার চেহারা বদলে দিতেন। এজন্য অমিতাভকে প্রচুর কষ্ট করতে হয়েছে। কিন্তু একটি ভালো ছবির জন্য তিনি হাসিমুখে সব কিছু মেনে নিতেন।
ভারতের কিংবদনিৱতুল্য আরেক অভিনেতা আমির খান সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দঙ্গল’ নামের একটি ছবিতে কুসিৱগীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এজন্য তিনি তার শরীরের ওজন বাড়িয়েছেন। শরীর, স্বাস্থ্য কুসিৱগীরদের মতো মোটা করেছেন। এজন্য শরীর স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাবার খেয়েছেন। নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করেছেন। ছবির শুটিং শেষে আবার চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়ম মেনেই নিজের চেহারাকে আগের পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। সিনেমার একটি চরিত্রের প্রয়োজনে নিজেকে বদলে ফেলার এই যে আন্তরিক চেষ্টা তা সত্যি প্রশংসনীয়।
এর আগেও একাধিক ছবিতে চরিত্রের প্রয়োজনে আমীর খান নিজের চেহারা বদলে ফেলেছিলেন। ‘গজনি’ ছবিতে আমীর খান নিজেকে স্বাস্থ্যবান করার পাশাপাশি মাথার চুলও ন্যাড়া করেন। ফলে ছবিতে তার চরিত্রটি বিশ্বাসযোগ্যতা পায় দর্শকের কাছে। ৪৫০ কোটি রুপি ব্যয়ে নির্মিত ছবিটি প্রথম বছরেই আয় করেছিল প্রায় দুই বিলিয়ন রুপি।
এবার আসি আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা শাহরুখ খান প্রসঙ্গে। ‘ফ্যান’ নামে একটি ছবিতে ৫০ বছর বয়সের এই অভিনেতা ২৫ বছর বয়সী গৌরব নামের এক তরুণের চরিত্রে অভিনয় করেন। ছবিতে শাহরুখ খানকে গৌরবের বয়সে আনার জন্য কৃত্রিম আইভ্রু তৈরি করা হয়। পাশাপাশি তার নাক ও দাতেরও আলাদা ডিজাইন করা হয়। শাহরুখের চিবুকের আকার পরিবর্তন করার পাশাপাশি গলার উঁচু স্থানকেও মেকআপের মাধ্যমে সমান করতে হয়েছে। এছাড়াও পরিবর্তন করা হয়েছে চোখ ও কাঁধের ধরনও। ৮৫০ মিলিয়ন রুপি ব্যয়ে নির্মিত এই ছবিটি এখন পর্যন্ত বক্স অফিস রেকর্ড গড়ে আয় করেছে ১.৮৫ বিলিয়ন রুপি।
‘ভাগ মিলখা ভাগ’ সিনেমাটির কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। এই ছবির মূল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ফারহান আখতার। ছবির কাহিনির প্রয়োজনে একজন এথলেট হিসেবে নিজেকে তৈরি করেন। এজন্য তাকে প্রচুর অনুশীলন করতে হয়েছে। কষ্টের স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি। ছবিটি মুক্তির বছরে সেরা অভিনেতা হিসেবে জিতে নেন ফিল্ম ফেয়ার, আইফা অ্যাওয়ার্ডসহ একাধিক অ্যাওয়ার্ড।
চরিত্রের প্রয়োজনে একটি ছবির জন্য মাথার চুল থেকে ভ্রু পর্যন্ত কামাতে হয়েছিল মুন্নাভাই খ্যাত ভারতের আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা সঞ্জয় দত্তকে। ছবির নাম ‘অগ্নিপথ’। ২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমায় বিশালদেহী মানব হিসেবে সঞ্জয় দত্ত নিজেকে তৈরি করেছিলেন। এজন্য প্রশংসাও পেয়েছেন। ছবি মুক্তির বছরে সেরা খলনায়ক চরিত্রের জন্য আইফা অ্যাওয়ার্ড পান তিনি।
ছবির নাম ‘কই মিল গ্যায়া’। মানসিক এক প্রতিবন্ধী তরুণের চরিত্রে এই ছবিতে অভিনয় করেন ঋত্বিক রোশন। এজন্য ছবির প্রথম অংশে শারীরিক ওজন কমাতে হয়েছিল তাকে। আবার দ্বিতীয় অংশে ওজন বাড়াতে হয়েছে। কাজেই বোঝা যায় একটি চরিত্রের জন্য কি চেষ্টাটাই না করেছেন তিনি।
নিজ দেশের কথা
আমাদের দেশে একটি ছবির চরিত্রের প্রয়োজনে অভিনেতার নিজেকে বদলে ফেলার ঘটনা খুব একটা নেই। তবে অতীতকালে-এর নজীর ছিল। নায়করাজ রাজ্জাক, আনোয়ার হোসেনসহ অনেক গুণী তারকা ছবির চরিত্রের প্রয়োজনে নিজের গেটআপ বদলেছেন। ইদানিং আর তেমনটা দেখা যায় না। একই চেহারার শাকিব খান সব ছবিতে। অথচ সর্বশেষ ‘শিকারী’ ছবিতে শাকিব খান নিজের চুলের স্টাইলসহ গেটআপ বদল করার পর ব্যাপক আলোচনায় আসেন। তবে হ্যাঁ ফজলুর রহমান বাবু, চঞ্চল চৌধুরীসহ এই সময়ের জনপ্রিয় তারকারা ছবির প্রয়োজনে নিজেদের গেটআপ বদলে বেশ আন্তরিক। তৌকীর আহমেদের ‘অজ্ঞাতনামা’য় চরিত্রের প্রয়োজনে প্রায় একমাস মুখের দাড়িসহ খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে নিয়ম মেনে চলেছেন ফজলুর রহমান বাবু। বিশিষ্ট অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ একটি টিভি নাটকে অভিনয়ের জন্য মাথার চুল ন্যাড়া করেছিলেন। ‘লালন’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য দীর্ঘদিন তিনি মুখের দাড়ি কাটেননি।
আসলে অভিনয়তো প্রার্থনার মতোই। অন্যের চরিত্রে নিজেকে তৈরি করতে হয়। এজন্য শ্রম, নিষ্ঠা আর অধ্যবসায় জরুরি। আরো জরুরি ছবির চরিত্রের জন্য প্রেমময় এক সুন্দর সম্পর্ক। যা আমাদের অনেক ছবিতে দেখা যায় না বলে দর্শকের মনে দাগ কাটে না।
আমরা কথায় কথায় বলি দর্শক আমাদের সিনেমা দেখতে চায় না। কথাটা ভুল। দর্শক সিনেমায় নতুন কিছু দেখতে চায়। কারণ দর্শক সিনেমা দেখে আনন্দের পাশাপাশি নিজের মাঝে একটা স্বপ্নও তৈরি করতে চায়। আমরা কি আমাদের সিনেমায় সেই স্বপ্ন তৈরি করতে পারছি?