Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

এখন রাতারাতি স্টার হওয়ার সুযোগ কম : আরফান নিশো

একেক নাটকে তাকে একেক চেহারায় দেখা যায়। সব নাটকেই নিজের অভিনীত চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলেন খুব সাবলীলভাবেই। এজন্য তার প্রস্তুতিটাও থাকে বেশ। প্রথমে স্ক্রীপ্ট পড়ে চরিত্র অনুযায়ী গেটাপ কেমন হবে সেটা নিয়ে চিন্তা করেন। তারপর পরিচালকের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে তিনি গেটাপটা নেন বলে জানান। আর তাই তো সেই চরিত্রটি নিয়ে যখন তিনি পর্দার সামনে হাজির হন তখন সত্যিকার অর্থেই ভিন্ন একজন অভিনেতা হয়ে যান তিনি। পাঠক, চরিত্র নিয়ে প্রতিনিয়ত ভাবনা-চিন্তার মধ্যে থাকা এই অভিনেতার নাম আরফান নিশো। যে কিনা ক্যারিয়ারের শুরু থেকে কখনোই নিজেকে ‘হিরো’ ভাবেন নি। তিনি ‘অভিনেতা’ হিসেবেই নিজেকে চিন্তা করে আসছেন। আর তাই তো প্রতিনিয়ত চরিত্রের পেছনে ছুটে চলেছেন নিশো। ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসে নিজের অবস্থান, অভিনেতা হওয়া কিংবা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের স্বপ্নসহ নানান বিষয় নিয়ে নিশো কথা বলেছেন ‘আনন্দ আলো’র সঙ্গে। উত্তরার একটি শুটিং হাউজে বসে চলছিলো তারই আলাপচারিতা। চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো। লিখেছেন সৈয়দ ইকবাল।
আনন্দ আলো: আপনাকে একেকটি নাটকে একেক গেটাপে দেখা যায়। চরিত্রের সঙ্গে আপনার সেই গেটাপ অনেকাংশেই মিলে যায় এক্ষেত্রে প্রস্তুতিটা কেমন থাকে?
আরফান নিশো: আমি নিজেকে একজন পারফর্মার হিসেবে দেখতে চাই। তাই আমি কখনোই নিজেকে তথাকথিত হিরো হিসেবে কল্পনাও করিনা। গল্পের স্বার্থে একজন মুচিও কিন্তু সেই গল্পের হিরো। অভিনয়টাকে আমি সেভাবেই দেখতে ভালোবাসি। আমি আসলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একজন পারফর্মার হিসেবেই থাকতে চাই। হিরো না। তথাকথিত ‘ললিপপ’ যেই হিরো তার আবেদন অথবা ভ‚মিকা যাই বলিÐ আমার কাছে তা সাময়িক মনে হয়। যতক্ষণ তার মধ্যে হিরোইজম থাকবে ততক্ষণই কিন্তু সে হিরো। তাই আমি পারফর্মার থাকতে চাই। এই ভাবনাটা আমার ক্যারিয়ারের শুরুর সময় থেকে যেমনি করে এসেছি, এখনো সেটাই ভাবনায় রয়েছে। সে কারনে একটি চরিত্র নিয়ে যখন আমি চিন্তা করি তখন নিজেই নিজের গেটাপ এবং পোশাক-আশাকের কথা ভাবি। নির্মাতার সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা করে নেই। কারন আমাদের এখানে আর্ট ডিরেক্টর বলতে কোনো পদ নাটকে তো পাই-ই না। একজন অভিনেতা হিসেবে আমার প্রথম কাজটি হলো চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তোলা। সেটাই আমি সবসময় চেষ্টা করি। যেমন গত ঈদে মাহমুদ দিদারের ‘পাপারাজ্জি’ নামে আমার একটি নাটক প্রচার হয়েছিল। সেখানে আমার চরিত্র ছিলো আশি-নব্বই দশকের একজন ফিল্ম ফটোগ্রাফারের। আমি চরিত্রটি নিয়ে নানানভাবে এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছি। তখন ঐ দশকের ইন্ডাস্ট্রির মানুষদেরকে দেখতাম মাথায় রুমাল বাধতো, দাঁড়ি রাখতো। তাই ইন্ডাস্ট্রির সে সময়কার একজন ফটোগ্রাফারের গেটাপটা কেমন হবে সেটা নিয়ে আমি ভাবতে থাকি। অবশেষে আমিও তেমন একটা গেটাপ নিলাম। এব্যাপারে ডিরেক্টরের সঙ্গে আলাপ করার পর তিনি তো মহাখুশী। অবশেষে পর্দায় নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হয়েছি। আমি এমনিভাবেই চরিত্র নিয়ে ভাবি। তবে প্রতিদিনের কাজের মধ্যে এই গেটাপ নেয়া কিংবা পরিবর্তন করা অনেক সময় কষ্টকর বিষয়ই বটে। তারপরও চেষ্টা করে যাচ্ছি। কারন এক নাটকে আমি দাঁড়ি বড় করে পরেরদিন আরেক নাটকে সেই দাঁড়ি ছোট করলে আগের নাটকের কন্টিনিটি ব্রেক হয়। তাই আমি চাইলেও অনেক সময় অনেক কিছু করতে পারি না। তারপরও যতোটুকু সম্ভব করছি। কারন আমি যদি সব নাটকেই স্যুটেড-ব্যুটেড থাকি তাহলে কিন্তু আমার চরিত্রের ভেরিয়েশন থাকবে না। কথার কথা চরিত্র অনুযায়ী পাঞ্জাবি পরলে একরকম লুক হবে, সেটাতে একটি কটি পরলে আরেক রকম লুক কিংবা শাল পরলে ভিন্ন আরেকটা লুক র্দাঁড়াবে। তাই আমি আগে বোঝার চেষ্টা করি চরিত্রটা কেমন। তারপর গেটাপ নেই।
আনন্দ আলো: ‘স্টারিজম’ শব্দটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
আরফান নিশো: আমি আসলে ঐভাবে বিষয়টাকে দেখি না। স্টার মানে তো বিশাল ব্যাপার। বিশাল আকাশে যেটা জ্বল জ্বল করে। কিন্তু আমাদের ইন্ডাস্ট্রি এতো বিশাল না। এই ছোট্ট কালচারাল ইন্ডাস্ট্রিতে জ্বল জ্বলে মানুষের সংখ্যা খুবই কম। আমি এখনো সেই জায়গায় যাইনি। তবে হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আমরা অন্য দশটা মানুষ থেকে আলাদা। আমাদের চলাফেরা, লাইফস্টাইল, কথা বলা-সবই কিছুটা আলাদা বিধায় মানুষ আমাদের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে। সেটা অবশ্যই এনজয় করি।
আনন্দ আলো: এই যে অভিনয় করেই যাচ্ছেন, নিরন্তর ছুঁটেচলা… অভিনয় জীবনে আপনার প্রায় পনের বছরের ক্যারিয়ার। অভিনয়ের ক্ষুধা কী মিটছে?
আরফান নিশো: কখনোই না। একটা কথা আছে না- যিনি নির্মাতা তিনি সারাজীবন একটি সিনেমাই বানাতে চান। ঐ একটি সিনেমা বানাতে গিয়েই তিনি আসলে কয়েকটি সিনেমা বানিয়ে ফেলেন। আমি যেহেতু অভিনেতা সেহেতু বলবো- ঐ একটি চরিত্রেই অভিনয় করতে চাই। সেই চরিত্রটা কী আমি নিজেও জানি না। সেটার সন্ধান এখনো পাইনি। সেই চরিত্রটিই বোধহয় খুঁজছি। আর সেটা খোঁজার জন্যই অনেক চরিত্রে অভিনয় করে যাচ্ছি।
আনন্দ আলো: অভিনয়ের ক্ষেত্রে আপনার কী কোনো আইডল আছেন?
Tal-o-Joler-Golpoআরফান নিশো: হ্যাঁ, আমাদের দেশে অভিনয়ের ক্ষেত্রে হুমায়ূন ফরীদির অভিনয় খুব ভালো লাগতো। তিনি ছিলেন আমার সবচেয়ে ভালো লাগার একজন অভিনেতা। প্রকৃত পক্ষ্যে আমাদের দেশে তাকেই আমার কাছে পারফর্মার মনে হয়। এটা আমি অন্যদের ছোট করে বলছি না। তাঁর মধ্যে কি যেনো একটা ছিলো। চোখের ভাষা নিমিষে পরিবর্তন করা, ঠোঁটের কোনায় কিছু একটা বলা, মাথা ঘুরিয়ে ক্যামেরার দিকে লুক দেয়া কিংবা কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করা। এরপরই শহীদুজ্জামান সেলিম ভাইয়ের অভিনয় আমার অসাধারণ লাগে। সেলিম ভাইও দূর্দান্ত অভিনয় করেন।
আনন্দ আলো: ক্যারিয়ারের শুরুর কথা কী মনে পড়ে?
আরফান নিশো: অবশ্যই মনে পড়ে। গোড়ার কথা কী ভোলা যায়? সেটা তো শিকড়, তাই না? তাই শুরুর কথা কখনোই ভুলে যেতে হয় না বলে আমি বিশ্বাস করি। প্রতিনিয়তই মনে হয়- আমি কোথায় ছিলাম, কোথা থেকে আসলাম, কোথায় যাব- এই বিষয়গুলো মনে রাখতে হয়। আমার ধারনা যে এগুলো মনে রাখতে পারে না, তার গন্তব্য হয় একরকম আর যে মনে রাখে তার গন্তব্যটা হয় আরেক রকম। ক্যারিয়ারের এই পনের বছরে শুরু থেকে শেষ অবধি সব ঘটনাই আমার মনে আছে। মডেলিং দিয়ে ক্যারিয়ারের শুরুর কথা, গাজী রাকায়েত স্যারের কাছে অভিনয়ে হাতেঘড়ি কিংবা টিভি বিজ্ঞাপনে কাজ করা- আমার সবই মনে আছে। নাটকে গুরু হিসেবে মানি শ্রদ্ধেয় গাজী রাকায়েতকে। তাঁর হাত ধরেই আমার নাটকের জগতে পথচলা শুরু। টিভিসির গুরু হচ্ছেন শ্রদ্ধেয় অভিতাম রেজা। তিনিই আমাকে প্রথম টিভিসিতে সুযোাগ করে দেন। এরপর দ্বিতীয় বিজ্ঞাপনে কাজ করেছিলাম জনপ্রিয় নির্মাতা আফজাল হোসেনের সঙ্গে। এই মানুষগুলোর কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। তাঁদেরকে আমি কখনোই ভুলতে পারবো না।
আনন্দ আলো: আপনি যেহেতু টিভি নাটকেরই শিল্পী সে কারনে বর্তমানের টিভি নাটক নিয়ে আপনার মন্তব্য কী!
আরফান নিশো: অনেক কোয়ালিটি সম্পন্ন নাটক হচ্ছে। তবে বর্তমানে একজন শিল্পী তৈরি হতে অনেক বেশি সময় লাগে। কারন অতীত যখন একটিমাত্র টিভি চ্যানেল ছিলো তখন একটি বা দু‘টি নাটকে ভালো অভিনয় করেই রাতারাতি স্টার হওয়া যেতো। কিন্তু এখন সেই সুযোগটা নেই। এখন একজন শিল্পীকে অনেক কাজ করে দর্শকদের কাছে পরিচিত হতে হচ্ছে। আর তখন একটিমাত্র কাজে যে বাজেট দেয়া হতো এখন তারচেয়ে কম বাজেটে টেকনোলজিক্যালি আধুনিক কাজ করতে হচ্ছে। তখনকার সময় খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে যাতায়াতের যে খরচ ছিলো এখন তা অনেকগুণ বেড়েছে। সেইদিক থেকে এখন কম বাজেটে যে কাজ হচ্ছে তা নি:সন্দেহে আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রশংসার দাবী রাখে। আর এখন চ্যানেল বেড়েছে, কাজের পরিমাণও বেড়েছে। এমনকি নাটক প্রচারের মাধ্যমও বেড়েছে। তবে মজার বিষয় হচ্ছে বাজেট বাড়েনি। নাটক প্রচারের অনেক মাধ্যম হওয়ায় দর্শক নানাভাবে ভাগ হয়ে গেছে। ফলে মনে হচ্ছে টিভি নাটকের দর্শক কমে গেছে। আসলে তা নয়। কারন আমরা ইউটিউবে একেকটি নাটকের ভিউয়ারস লাখ লাখ দেখতে পাই। টিভিতে একটি নাটক প্রচারের পর আবার ইউটিউবে নাটক দেখছে মানুষ। কাজেই নাটক প্রচারের মাধ্যমটা অনেক ভাগ হয়েছে।
Nil-ronger-golpoআনন্দ আলো: চলচ্চিত্রে আপনাকে এখনো দেখা যায়নি। অথচ, আপনার সমসাময়িক অনেকেই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এ ব্যাপারে কিছু বলবেন?
আরফান নিশো: কারো হয়তো পাঁচ বছর আগে শুরু হবে আবার কারো সেটা শুরু হবে পাঁচ বছর পর। আমি এটা নিয়ে একদমই চিন্তিত নই। বরং, আমার অবজারভেশনটা ভিন্ন। আমি এখন পর্যন্ত সমসাময়িক কোনো ছবি দেখে ওয়াও শব্দটি বলতে পারিনি। আশি-নব্বই দশকের ফিল্মের হিসাব আলাদা। আমি মুক্তিপ্রাপ্ত সব ছবিই দেখি। এখন পর্যন্ত দু‘একটি চলচ্চিত্র ছাড়া ভালো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে বলে আমার মনে হয়নি। তাই যেদিন আমি একটি ছবি দেখে এই ওয়াও শব্দটি বলতে পারবো সেদিন আমার মনে হবে এখন চলচ্চিত্রে অভিনয় করা উচিত। আরেকটি কথা এখানে না বললেই নয়। সারাবিশ্বেই অনেকে বলে থাকেন মিডিয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হচ্ছে চলচ্চিত্র। তবে আমার অবজারভেশনে আমাদের এখানে বিষয়টা ভিন্ন। কারন, বড় মাধ্যম চলচ্চিত্র হলে তো আমাদের এখানে বিশিষ্ট অভিনয়শিল্পীরা চলচ্চিত্রেই অভিনয় করতেন। তারা কেনো- দু‘একটি কিংবা তারও অধিক ছবিতে অভিনয়ের পর চলচ্চিত্র অঙ্গন থেকে বেরিয়ে এসে টিভি মিডিয়ায় কাজ শুরু করছেন। সিনিয়ররা যখন চলচ্চিত্র অঙ্গণ থেকে টিভি মিডিয়ায় ফিরে আসেন- তখন আমার মনে হয়- আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় গণি মাধ্যম টিভি মিডিয়া। রাইসুল ইসলাম আসাদ, আবুল হায়াত, আফজাল হোসেন, সুবর্ণা মুস্তাফাসহ এমন অনেক দর্শকনন্দিত অভিনয়শিল্পীর কথাই বলা যাবে। আমি নিজেই নিজেকে মাঝেমধ্যে প্রশ্ন করি- কেন গিয়াসউদ্দিন সেলিম ভাইয়ের মতো নির্মাতা একটি মনপুরা চলচ্চিত্র নির্মাণ করে একদম হাত গুটিয়ে বসে আছেন। কেন চঞ্চল চৌধুরী দু‘টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে এখন তার হাতে দশটি ছবি নেই কিংবা মোশাররফ করিম ভাইয়ের হাতে কেনো আট দশটা ছবি নেই। এমন অনেক প্রশ্ন আমার মনে জাগে। তখন মনে হয়- আমাদের যারা পথ প্রদর্শক তারা সঠিক পথটা দেখিয়ে যেতে পারেননি। কোথাও কোনো ঘটতি রয়েছে।
আনন্দ আলো: আপনি যেহেতু বিনোদন অঙ্গনের মানুষ তাই বলুন- আপনার কাছে বিনোদনটা কী?
আরফান নিশো: আমার কাছে আনন্দ বিনোদন সবটাই ছেলে অনির্বাণ। সারাদিনের শুটিং শেষ করে তার পাশে একটু ঘুমালেই আমার সব ক্লান্তি চলে যায়। সময় পেলে বই পড়ি, মুভি দেখি এবং গান শুনি। তবে পরিবারকে সময় দেয়াও আমার কাছে বিনোদন। কয়েক মাস পর পর কোথাও বেড়াতে যাওয়াটাও আমার কাছে বিনোদন বটে।