Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

যেন কাছে থাকি পাশে থাকি…

রেজানুর রহমান: অফিসে বসে আছি। হঠাৎ তুষার কানিত্ম এসে হাজির। তুষার প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনে কাজ করে। একজন লেখক। আমার রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল- ভাই একটা খুশির খবর আছে।

তুষারকে বসতে বলে জানতে চাইলাম- খুশির খবর? বলো… আসলে ব্যাপারটা কী…?

তুষার অতিমাত্রায় উচ্ছ্বসিত। খুশি যেন ধরে রাখতে পারছে না। সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে বলল- ভাই আমাদের সিনেমাটা মিঠু ভাই করবেন বলে রাজি হয়েছেন। তার সাথে কথাবার্তা ফাইনাল। এই খুশির খবরটা আপনার সাথে শেয়ার করার জন্যই এসেছি।

প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা বানাবে এখবর আগেই জেনেছি। সিনেমাটা খালিদ মাহমুদ মিঠুই বানাবেন এটা নিশ্চিত হয়েছিলাম আগের দিন। চ্যানেল আই এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার আমীরুল ইসলামের সাথে বিষয়টি নিয়ে ফোনে কথা বলছিলেন প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু। আমি তখন আমীরুল ইসলামের রুমে তার টেবিলের সামনে বসা। ফোনে আমীরুল  ইসলামের কথা শুনেই ধরে নেই প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের সিনেমাটি খালিদ মাহমুদ মিঠুই বানাবেন।

তুষার কানিত্মকে গতকালের এই ঘটনা বর্ণনা করলাম। সে খুব খুশি। যাবার সময় বলল- ভাই আপনাকে আরও একটি গোপন খবর জানাই। মিঠু ভাই বলেছেন, আমি যেন তার এই নতুন সিনেমায় সহকারী হিসেবে কাজ করি। ভাই আমি এখনও একথা বিশ্বাস করতে পারছি না। এতবড় একজন পরিচালক। তার সাথে কাজ করার সুযোগ! ভাই আমার জন্য দোয়া করবেন।

তুষার চলে গেল। সহকর্মী জাকীর হাসানকে ডেকে খবরটা জানালাম। আনন্দ আলোয় এ ব্যাপারে একটা নিউজ করার জন্য তাগাদা দিলাম। জাকীর তার টেবিলে চলে গেল। অফিসের জরুরি কাজে মনোযোগ দিয়েছি। বড় জোর ত্রিশ মিনিটের ব্যবধান। হঠাৎ জাকীর হাসান বিমর্ষ চেহারায় আমার সামনে এলো। বলল- দুঃসংবাদ আছে। মিঠু ভাই গাছ চাপা পড়ে মারা গেছেন!

প্রথমে কথাটা বুঝতে পারিনি। সে কারনে অবাক হয়ে জানতে চাইলাম- কী বললে? মিঠু ভাই! কোন মিঠু…? জাকীর বলল- খালিদ মাহমুদ মিঠু। আমাদের মিঠু ভাই… ঐ যে দ্যাখেন চ্যানেল আইতে স্ক্রলে নিউজ দিচ্ছে। টেলিভিশনে চ্যানেল আই চালু ছিল। স্ক্রলে খালিদ মাহমুদ মিঠুর মৃত্যুর খবর প্রচার হচ্ছে।

একদন্ড অপেক্ষা না করে ছুটে গেলাম চ্যানেল আইতে। ততক্ষণে চ্যানেল আই এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর মিঠুর ধানমন্ডির বাসায় যাবার জন্য গাড়িতে উঠে বসেছেন। তাঁর সাথে শিশুসাহিত্যিক লুৎফর রহমান রিটন এবং চিত্রগ্রাহক জোবায়েদ হোসেন তুফান। ফরিদুর রেজা সাগরের দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। চোখ মুছতে মুছতে বললেন- তুমি যাবে? তাহলে গাড়িতে ওঠ।

খালিদ মাহমুদ মিঠুর ধানমন্ডির বাসায় এর আগে দু’বার এসেছি। একবার সাক্ষাৎকার নিতে। আর একবার স্রেফ আড্ডা দিতে। বাসার সামনে ইতোমধ্যেই পরিচিত স্বজন, শুভাকাঙ্খী, বন্ধু-বান্ধব, শিল্পী সহকর্মীসহ প্রচার মাধ্যমের কর্মীরা এসেছেন। মিঠুর বাসায় অনেক মানুষ জড়ো হয়েছেন। ফরিদুর রেজা সাগরকে দেখে মিঠুর প্রিয়তমা স্ত্রী কনকচাপা চাকমা কেঁদে ফেললেন। ফরিদুর রেজা সাগরও নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না। আবারও তাঁর চোখে অশ্রু। একটু দূরে দাঁড়ানো চ্যানেল আই এর পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজের দু’চোখ ছলছল করছে। নির্বাক দাঁড়িয়ে আছেন বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম। তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন আরেক বিশিষ্ট চিত্রপরিচালক সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী, নারী উদ্যোক্তা কনা রেজা, বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী ফেরদৌস আরা, অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচীসহ অনেকে। মুহূর্তের মধ্যে ধানমন্ডির একটি বাড়ি শতশত সংস্কৃতিকর্মী ও বিশিষ্টজনের উপস্থিতিতে শোকাবহ হয়ে উঠলো।

আসছে স্বজন, আসছে বন্ধু, শুভাকাঙ্খী। সবার চোখে কান্না। হঠাৎ আমার চোখ পড়লো ডাইনিং টেবিলের রাখা একটি পান্ডুলিপির ওপর। প্রথম পাতায় শিরোনামটাই প্রথমে চোখে পড়লো- গাঙের মানুষ। প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের এই ছবিটাই মিঠু বানানোর প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন।

খালিদ মাহমুদ মিঠুকে নিয়ে এভাবে লিখতে হবে কখনও ভাবিনি। মনে অনেক প্রশ্ন। জন্ম-মৃত্যু অবধারিত। তাই বলে এমন মৃত্যু? একটি গাছ চাপা দিল মিঠুকে। অথচ মিঠু এই গাছ আর প্রকৃতি নিয়েই সারা জীবন কাজ করেছেন। মিঠু ছিলেন চ্যানেল আই পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাঁর অকাল মৃত্যুর পর চ্যানেল আইতে একটি শোকবই খোলা হয়। এই বইয়ে মিঠুর জন্য অনেকেই শোকগাঁথা লিখেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন, বিশিষ্ট সুরকার আজাদ রহমান, বিশিষ্ট শিল্পপতি আবুল খায়ের লিটু, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব লিয়াকত আলী লাকী, মুহম্মদ জাহাঙ্গীর, সঙ্গীত শিল্পী শুভ্রদেব, নির্মাতা আবু সায়ীদ, ঈশিতা, শামস সুমনসহ অনেকে।

আবুল খায়ের লিটু লিখেছেন, মিঠু ছিল আমাদের সবার প্রিয় একজন ভালো মানুষ, ভালো মাপের শিল্পী। ওদের পরিবারের সাথে আমাদের সখ্যতাও ছিল বেশী। অনেক স্মৃতি যা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। অনেক কিছু আমাদের জন্য মিঠু রেখে গেল।

মুহম্মদ জাহাঙ্গীর লিখেছেন, মিঠু অসাধারন গুণী-শিল্পী ও টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতা ছিলেন। তাঁর অকাল মৃত্যুতে মিডিয়া জগতের এক অপুরণীয় ক্ষতি হলো। এমন মৃত্যু যেন কারও না হয়।

লিয়াকত আলী লাকী লিখেছেন, এ কেমন চলে যাওয়া, কত স্বপ্ন পড়ে থাকল, কত কথা অব্যক্ত, কত দায়িত্ব থাকল অপূর্ণ। মিঠু, তোমার আসন শূন্য থাকবে চিরদিন।

মিঠুর জন্য শোক বইয়ে ইমদাদুল হক মিলন লিখেছেন, মিঠু, তোমার আততায়ী মৃত্যুকে আমি অভিশাপ দেই।

প্রিয় মানুষের মৃত্যু নিয়ে লেখা বড়ই কষ্টের। এক সাথে অনেক স্মৃতি জমা হয়। স্মৃতিরা প্রতিযোগিতা শুরু করে- আমার কথা আগে লেখ আমার কথা আগে লেখ করে। খালিদ মাহমুদ মিঠু তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনে। একসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনের চাকরি ছেড়ে দেন। তারপর যে কয়টি বড় কাজ করেছেন তার প্রায় সবকটিতেই চ্যানেল আই কিংবা ইমপ্রেস টেলিফিল্ম নানাভাবে জড়িত ছিল। মিঠুর দুটি ছবি যথাক্রমে ‘গহীনে শব্দ আর জোনাকির আলো’র প্রযোজকও ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। দুটি ছবি দেশে-বিদেশে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে। একাধিক পুরস্কার পেয়েছে। চ্যানেল আই-এর শুরুটাও হয়েছিল খালিদ মাহমুদ মিঠুর ক্যামেরায় ধারণ করা অনুষ্ঠান দিয়ে।

মিঠুর মৃত্যুর পর তাঁর সহধর্মিনী কনকচাপা চাকমা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মিঠু ব্যক্তিজীবনে এতটাই সৎ ছিলেন যে সংসারের জন্য তেমন কিছুই করে যেতে পারেননি। তাঁর দুই সনত্মান আর্য ও শ্রেষ্ঠও শিরোপা পুর্না দু’জনই মেধাবী। বাবার দেখানো পথেই হাঁটছে দু’জন। তবুও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশংকা প্রকাশ করেছে মমতাময়ী মা কনক।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস মিঠুর দুই মেধাবী সনত্মান ঠিকই বাবার আদর্শকে এগিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু আমরা যেন তাদের পাশে থাকি, কাছে থাকি। আমরা যেন তাদেরকে ভুলে না যাই। তাহলেই ওরা সাহস ও অনুপ্রেরণা পাবে। মিঠুর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জানানো হবে।