Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

যন্ত্রকে প্রাধান্য দিয়ে অন্তরকে বিষিয়ে তুলছি-মনির খান

জনপ্রিয় সংগীত তারকা মনির খান। সংগীত জীবনের দুই দশক পার করেছেন। প্রায় চারশ ছবিতে প্লেব্যাক করেছেন। সংগীত শিল্পী হিসেবে পেয়েছেন তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ইতোমধ্যে তার একচল্লিশটি একক অ্যালবাম প্রকাশ হয়েছে। ডুয়েট ও মিক্সড মিলিয়ে চার থেকে পাঁচশ অ্যালবামে গান গেয়েছেন। মনির খানের সংগীত জীবনের নানান প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হয় আনন্দ আলো সঙ্গে। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক

আনন্দ আলো: আপনি দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে গানের সঙ্গে জড়িত আছেন। অনুভূতি কেমন?

মনির খান: অনুভূতি খুবই ভালো। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় কখনো পিছিয়ে পড়িনি। যত দিন গেছে এগিয়েছি। ব্যবসায়ও কিন্তু লাভ লোকসান আছে। কিন্তু গান করতে এসে সব সময় ভালোটাই চোখে দেখেছি। শ্রোতারা আমার গান পছন্দ করছেন। সবার ভালোবাসা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

আনন্দ আলো: এই দীর্ঘ পথচলায় শ্রেতাদের প্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পেরেছেন বলে মনে হয়?

মনির খান: আমরা একটা টিম নিয়ে কাজ করতাম। টিমের মধ্যে আমি গায়ক, গীতিকার ও সুরকার। প্রত্যাশা পূরণ যদি বলতে হয় তাহলে চেষ্টা করেছি। কিছুটা হয়তো সফল হয়েছি বলে এখনো গান গাইতে পারছি। তবে আমি মনে করি এর ক্রেডিটটা শুধু আমার একার নয় গীতিকার ও সুরকারদেরও ।

আনন্দ আলো: এ যাবৎ আপনার কয়টি অ্যালবাম বের হয়েছে?

মনির খান: এ পর্যন্ত আমার ৪১টি একক অ্যালবাম বের হয়েছে। আর দ্বৈত ও মিক্সড অ্যালবাম বেরিয়েছে প্রায় ৪০০ এর মতো। আমার উল্লেখযোগ্য একক অ্যালবামগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ ‘জোর করে ভালোবাসা হয় না’, ‘সুখে থাকা হলো না আমার’, ‘তোমার কোনো দোষ নেই’, ‘যে ভুল করেছি আমি’, ‘তুমি দূরের মানুষ হয়ে গেলে এ কেমন জীবন’, ‘তোমার জন্য’, ‘দূরের কাশবন’, ‘আবার কেন পিছু ডাকো’, ‘বুকটা আমার বাড়াবাড়ি’, ‘স্মৃতিটুকু স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি’, ‘সে তো আর ফিরে এলো না’ এবং সর্বশেষ অ্যালবাম ‘লীলাবতি’ ইত্যাদি।

আনন্দ আলো: আপনার ‘লীলাবতি’ অ্যালবামটির কেমন সাড়া পাচ্ছেন?

মনির খান: ‘লীলাবতি’ আমার ৪১তম অ্যালবাম। ১০টি গান দিয়ে সাজানো হয়েছে অ্যালবামটি। সবগুলো গানের কথা ও সুর মিলটন খন্দকারের। সংগীতায়োজন করেছেন আলী আকবর রুপু, বিনোদ রায় ও লিপন। বিরহ, প্রেম, ফোক, মা প্রভৃতি বিষয়ের ওপর গানগুলো করা। আমার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল থেকে ‘লীলাবতি’ অ্যালবামটি প্রকাশ করেছি। গানগুলোর জন্য ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি।

আনন্দ আলো: মাঝে চারবছর গানে বিরতি দিয়েছিলেন কেন?

মনির খান: অডিও ইন্ডাস্ট্রি খুব খারাপ সময় পার করেছে। গান প্রকাশের মাধ্যমেও পরিবর্তন আসে। বুঝতে পারছিলাম না কিভাবে গান প্রকাশ করব। কোথা থেকে টাকা রিটার্ন আসবে। প্রযুক্তির সঙ্গে দৌড়ঝাপ, কী ধরনের গান করা উচিত? সবকিছু মিলিয়ে গুছিয়ে উঠতে পারছিলাম না। এখন বিষয়গুলো অনেকটাই আয়ত্তে এসেছে। তাই অ্যালবামও করছি।

আনন্দ আলো: আপনার সব অ্যালবামেই অঞ্জনাকে নিয়ে একটি করে গান থাকে। আসলে অঞ্জনাটা কে?

মনির খান: অঞ্জনা একান্তই আমার নিজের সুখ। নিজের কষ্ট। যা আমি গানে গানেই বিস্তারিত বলার চেষ্টা করেছি। প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে এমন একটি মুহূর্ত আসে যখন মুহূর্তটাকে পরিপূর্ণ করতে আরেকজন মানুষের প্রয়োজন হয়। সেই তাগিদেই অঞ্জনার সন্ধান পেয়েছিলাম। অঞ্জনাকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছি। পরাজিত হয়েছি অর্থের কাছে। অঞ্জনাকে পেয়ে হারানোর বেদনায় কাতর হয়ে গানকে নিজের জীবনের সঙ্গে আরো সম্পৃক্ত করেছি তার বেদনাকে ভোলার জন্য। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে যথেষ্ট সহযোগিতাও করেছে আমাকে অঞ্জনা।

আনন্দ আলো: গায়ক হওয়ার পর কী অঞ্জনার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

মনির খান: গান শেখার আগে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, পরে আর হয়নি। যতটুকু জানি সে এখন সৌদি আরবে থাকে।

আনন্দ আলো: তাকে নিয়ে গান করে আপনি এত জনপ্রিয়। দেখা না পাওয়ায় কোনো আপসোস হয় না?

মনির খান: আগে হতো। এখন আর কোনো আপসোস হয় না। কারণ একজন অঞ্জনাকে হারিয়ে লাখ লাখ মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। এটা আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি।

আনন্দ আলো: চলচ্চিত্রের গানে আপনাকে আগের মতো দেখা যায় না কেন?

মনির খান: প্লেব্যাক এখন খুব ¯েøা। ছবি এখন কম হয়। ছবি বেশি না হলে তো বেশি গান গাওয়ার সুযোগ থাকে না। এছাড়া এখন নতুন ছেলে-মেয়েরাও গাইছে। এক সময় দিনে তিন চারটি গানে কণ্ঠ দিয়েছি। এখন গোটা মাসে হয়তো এক দুইটা গাইছি। সময়ের ব্যবধানে এটা হয়েছে। এটা মানতে হবে, বয়সও বেড়েছে। আগে আমি ছিলাম বাবার সন্তান, এখন আমি নিজেই সন্তানের বাবা। এভাবেই সবকিছু বদলে যায়।

আনন্দ আলো: চলচ্চিত্রের গানে পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করেন?

মনির খান: হ্যাঁ। অনেক পরিবর্তন এসেছে। সুর, কথা, কম্পোজিশন সবকিছুই পাল্টেছে। এ পরিবর্তনের মধ্যেও অনেক ভালো গান হচ্ছে। যা সময় উপযোগী বলে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

আনন্দ আলো: এখন গান ভিডিও নির্ভর হয়ে গেছে। আপনার অভিমত কী?

মনির খান: আমাদের অডিও শিল্পের পিঠ একদম দেয়ালে ঠেকে গেছে। আগে যেমন ক্যাসেট ও সিডির মাধ্যমে শ্রোতারা গান শুনতে পেত। মানুষ এখন সিডি কিনে না, অডিওতো দূরের কথা। তাই এখন যারা গান করছেন তারা দর্শক হৃদয়ে কীভাবে পৌঁছাতে পারবেন সেরকম একটা জায়গা তাদের দরকার। সেই জায়গাটার জন্য এই সময়ে সবচেয়ে বেশি উপযোগী হলো মিউজিক ভিডিও। ভিডিওটি যখন সুন্দর হয় এবং গান ভালো হয় তখন খুব সহজেই দর্শকের হৃদয়ে ছুঁয়ে যায়। তখন গানটিও দর্শকের কাছে পরিচিত পায়, শিল্পীও পরিচিতি পেয়ে যান। গানটিও জনপ্রিয় হয়। সেজন্যই আমি মনে করি মিউজিক ভিডিও এখন সবচেয়ে জরুরি। কারণ এখন গান শোনার চেয়ে দেখার বিষয়টা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা গান শুনতেই চাই, দেখতেও চাই। এটাই সময়ের দাবি।

আনন্দ আলো: এখন আর কেউ ১০/১২ টি গান দিয়ে অ্যালবাম প্রকাশ করছে না। একটি দুটি সিঙ্গেল করে প্রকাশ করেছে। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?

মনির খান: বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে আমাদের। তাই আমরা সেই পথে এগুচ্ছি। কারণ সারা বিশ্বেই এখন শ্রোতারা ইউটিউবে অথবা মোবাইলে গান শুনছে। আমরা দুই বছর আগে এ ধারাটিতে অভ্যস্ত বেশি হয়েছি। প্রথম বেশির ভাগ গানই ডিজিটালি প্রকাশ হয়। সংগীতে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও এগিয়ে যাচ্ছি।

আনন্দ আলো: স্টেজ, টেলিভিশন, অডিও এবং চলচ্চিত্র কোন মাধ্যমে গান করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন সবচেয়ে বেশি।

মনির খান: একেকটি মাধ্যমের গুরুত্ব একেক রকম। একেকটি মাধ্যমের রেজাল্ট একেক রকম। টেলিভিশনে যখন আমরা গান গাই সেটার ধরন এক রকমের হয়, যখন আমরা অডিওতে গান করি সেটার ধরন আরেক রকম হয়, যখন চলচ্চিত্রের গান করি সেটার ধরন আরেক রকম। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে মঞ্চ। মঞ্চে আমরা যখন গান গাই তাৎক্ষণিকভাবে রেজাল্ট পেয়ে যাই। একটি রেকর্ডিং অনুষ্ঠানের সুবিধা হলো যদি ভুল হয়ে যায় সেটি শুধরানোর সুযোগ আছে। মঞ্চে ভুল হলে সেটি শুধরানোর সুযোগ নেই। সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে রেজাল্ট নিতে হবে। ভালো করলে বাহবা পাবেন, খারাপ করলে মানুষের অসন্তুষ্টি প্রকাশ পাবে।

আনন্দ আলো: এখন নতুন প্রচুর শিল্পী আসছে। প্রচুর গান হচ্ছে। গানের মানের ব্যাপারে আপনার কী কোনো বক্তব্য আছে?

মনির খান: এখন শ্রোতাদের মনে একটা দারুণ হতাশা কাজ করছে। আগের মতো গান হচ্ছে না। আগে আমরা বাবাকে বাবা বলতাম। এখন বাবাকে আমরা ড্যাডি বলি। আমরা অনেক বেশি আধুনিক হয়ে গেছি। যান্ত্রিক যুগের কতইনা সুবিধা। ঘরে বসেই ইন্টারনেটে শাহরুখ খানের সঙ্গে কথা বলা যায়। সবকিছুই যেন সস্তা, সবকিছু যেন নিজের আয়ত্তে। কারো সহযোগিতা ছাড়া নিজেই অনেক কিছু করে ফেলতে চাই। দারুণ একটা সুযোগ। এই সুযোগের কারণে সৃজনশীলতা থেকে আমরা দূরে সরে গেছি। এই সুযোগের কারণে ওস্তাদদের কাছে ধরনা দিয়ে শেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। বছরের পর বছর সাধনা থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি। খুব সহজেই নিজেকে প্রমাণ করতে চাই, খুব সহজেই শ্রোতাদের ভালোবাসা অর্জন করতে চাই, খুব সহজেই টাকার পেছনে ছুটতে চাই। যার কারণে সত্যিকার অর্থে ভালো গান হচ্ছে না। আমি কাউকে দোষ দিচ্ছি না। সময়ের দাবি মিটাতে গিয়ে মনের শান্তি দূরে চলে যাচ্ছে। যন্ত্রকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে অন্তরটাকে বিষিয়ে তুলব এই কাজটি যেন আমরা না করি।

আনন্দ আলো: সংগীত জীবনের কোনো স্মরণীয় ঘটনার কথা বলবেন?

মনির খান: একদিন আমি গান গাইবার জন্য হারমোনিয়াম বাজানো শুরু করেছি। মসজিদের পাশেই ছিল আমাদের বাসা। মসজিদ থেকে এশার নামাজ পড়ে হুজুররা এসে আমাদের বাড়িতে আক্রমণ করল। আমার বাবা তখন পাশের রুমেই ছিলেন। তিনি স্কুল শিক্ষক ছিলেন। হুজুরদেরকে জিজ্ঞাসা করলেনÑ আমার ছেলের অপরাধটা কোথায়? তারা বললেন, এখানে গান বাজনা করা যাবে না। আমরা এখানে নামাজ কালাম পড়ি। গান করতে হলে এখান থেকে চলে গিয়ে অন্য জায়গায় করতে হবে। তখন বাবা বললেন, আল্লাহপাক তাকে গলা দিয়েছেন। আল্লাহ পাক তাকে যদি সেটা দেন আপনাদের বাধা দেয়ার কী আছে? অনেক বাদানুবাদের এক পর্যায়ে তারা চলে গেলেন। তখন বাবা আমাকে বললেন, যেহেতু তোমার গানবাজনার কারণে আমি অপদস্ত হলাম, কাজেই তোমাকে ভালোভাবে গান গাইতে হবে। মূলত বাবারশান্তির জন্য, স্বস্তির জন্য গানকে জয় করতে এখন সংগ্রাম করছি।

আনন্দ আলো: আপনি গান গেয়ে মানুষকে বিনোদিত করেন। আপনার বিনোদন কী?

মনির খান: বিনোদন আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। আমি বিনোদিত হই যখন মানুষ আমাকে ভালোবাসে, আমার গান শোনে। মানুষের ভালোবাসার চেয়ে বড় বিনোদন আমার কাছে নেই।

আনন্দ আলো: অবসর সময় আপনি কীভাবে কাটান?

মনির খান: অবসর সময়ে দেশ- বিদেশের বিভিন্ন শিল্পীর গান শুনি। আর স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঘুরতে বের হই।

আনন্দ আলো: আপনার পরিবার সম্পর্কে কিছু বলুন?

মনির খান: আমার স্ত্রীর নাম তাহমিনা আক্তার ইতি। এক মেয়ে এক ছেলেকে নিয়ে আমার সংসার। মেয়ে মৌনতা ভিকারুননিসায় ক্লাস সেভেনে পড়ছে। আর ছেলে ওয়ানে। পরিবার আর গান নিয়েই তো আমার জীবন। এই দুটোকেই সমান সময় দেয়ার চেষ্টা করছি।