সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
সৈয়দ ইকবাল: বিষয়টা শুধু আনন্দদায়কই নয়, স্বপ্নের মতোই বলা যায়। একশত জনের একটি তরুণ দল, যারা কিনা ভারত সরকারের আমন্ত্রণে আট দিনের সফরে ঘুরেছেন দেশটির গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি জায়গা। বাংলাদেশের তরুণদের জন্য ২০১২ সাল থেকে ভারত সরকার এই উদ্যোগটি হাতে নিয়েছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিৎসা, প্রকৌশল শাখা কিংবা সাংবাদিকতা পেশায় কাজ করা এসব তরুণ তরুণীরা ভারতের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ঘোরার পাশাপাশি অর্জন করেছেন দেশটির সম্পর্কে বেশ অভিজ্ঞতাও। দেশের ভবিষ্যৎ এই তরুণ তুর্কিদের কাছে সফরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিলো ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ সহ চারটি প্রদেশে ভ্রমণ। দিল্লি রাষ্ট্রপতি ভবনের দরবার হলে সাক্ষাৎকালে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশি তরুণ প্রজন্মের একালের ভাবনার কথা শুনেছেন। তিনি বক্তব্য রেখেছেন তরুণ সমাজের উদ্দেশে। ৪ অক্টোবর দিল্লিতে পা রেখেই শুরু হয় আট দিনের ভারত দর্শন বাংলাদেশি শত তরুণের। ১১ অক্টোবর শেষ হয় আটদিনের বিরামহীন পথচলা। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ছিল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ অনুষ্ঠান। যেখানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ভারতের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রনালয়ের সচিব রাজীব গুপ্তা। যুব প্রতিনিধি দলের পক্ষে বাংলায় বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান ও ইংরেজিতে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ঊর্মি রহমান সিলভী। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির হাতে শুভেচ্ছাস্বরূপ নৌকা, রিকশা ও অটোরিকশার রেপ্লিকা তুলে দেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনের প্রথম সচিব (রাজনৈতিক ও তথ্য) রাজেশ উইকে ও যুব প্রতিনিধি দলের নারী প্রতিনিধি সাংবাদিক কাবেরী মৈত্রেয়। প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে প্রতিনিধি দলটি রাষ্ট্রপতি ভবনের ব্যাংকুয়েট হল ঘুরে ঘুরে দেখেন। এর আগে প্রতিনিধি দলটি ৪ অক্টোবর ইন্ডিয়া গেট পরিদর্শন করেন। এরপর ছিল জাতীয় জাদুঘর, কুতুব মিনার, ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব ফরেন ট্রেড কার্যালয় এবং সে দেশে সর্বাধিক মোটরবাইক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মটরকপের কার্যালয় ঘুরে দেখা। ওইদিন রাতে স্হানীয় হোটেলের বলরুমে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। সেখানে কত্থক ও ভরত নাট্যমসহ বিভিন্ন পরিবেশনা উপহার দিয়েছিলেন ভারতের বন্ধুরা। বাংলাদেশি বন্ধুরাও পরিবেশন করেছিলেন দেশাত্ববোধক-লোকজ গান, নাচ। পরের দিন ৭ অক্টোবর আগ্রার তাজমহল ও আগ্রা ফোর্ট ঘুরে দেখেন প্রতিনিধি দলটি। আগ্রা থেকে রাজস্হানের রাজধানী জয়পুরে যাওয়ার পথে তাদের বিশেষ পাওয়া ছিল উত্তর প্রদেশের ফতেপুর সিক্রির বুলন্দ দরজা দর্শন। ওইদিন বিকেলে জয়পুরে প্রতিনিধি দলটি পৌঁছালে সাক্ষাৎ হয় রাজস্হানের যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী গজেন্দ্র সিং খিসার সঙ্গে। তার উষ্ণ অভ্যর্থনায় সবাই মুগ্ধ। ছিল কালচারাল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম। এই অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া ও ‘জয়বাংলা’ োগান দেয়া ছিল যুব প্রতিনিধি দলের অন্য রকম অনুভূতি। জয়পুরে পিংক সিটি থেকে ফেরার পথে প্রতিনিধি দল ঘুরে আসে বলরাম আদর্শ বিদ্যামন্দির। সেখানে ছিল রাজস্হানীয় কায়দায় অতিথি বরণ, লোকজ নৃত্য ও গান। তার আগে রাতে রাজস্হানীয় আর্টিসান ভিলেজ ‘চক্কি ধানি’ ঘুরে দেখা ছিল বিশেষ মুহূর্ত। মরবুকে উটের পিঠে চড়া থেকে শুরু করে সাপের খেলা, পুতুল নাচ, সার্কাস আরও কত কি আয়োজন ছিল এই আর্টিসান ভিলেজে। ‘চক্কি ধানি’ হচ্ছে রাজস্হানের প্রতিচ্ছবি। এটি ঘুরে দেখলে পুরো রাজস্হান দেখা হয়ে যায়। চক্কি ধানি ঘুরের দেখার পর্ব শেষ হয় রাজস্হানী খাবারের থালি উপভোগ করার মধ্যদিয়ে। পাতার প্লেটে পরিবেশন করা হয় ২৫ রকমের খাবার। এরপর প্রতিনিধি দলটি জয়পুরের বিমান বন্দর থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। কলকাতার দর্শন পর্ব শুরু হয় রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত শান্তি নিকেতন ঘুরের দেখার মধ্যদিয়ে। সফরের শেষ দিন ঘুরে দেখা হয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, জাতীয় জাদুঘর ও ইডেন গার্ডেন আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম। একশতএই তরুণের মধ্যে ছিলো দেশের টিভি মিডিয়া ও প্রিন্ট মিডিয়ায় কাজ করা ১৪জন সংবাদকমর্ী। তাদের মধ্যে থেকে সাত তরুণ এসেছিলেন ‘আনন্দ আলো’র কার্যালয়ে। আড্ডা আর গল্পে তারা বলেছেন এই ভ্রমণের নানান অভিজ্ঞতার কথা। এই সাত তরুণ হলেন- দৈনিক সমকাল পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার এসএম মুন্না, যমুনা টিভির সিনিয়র রিপোর্টার কামরুল ইসলাম রিফাত, ডকুমেন্টারি মেকার-সিনে ফটোগ্রাফার এবং দৈনিক কালের কণ্ঠের ফটোগ্রাফার তারেক আজিজ নিশক, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের মুহম্মদ রিশাদ হুদা, মাছরাঙা টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার নূর-উন-নাহার উইলি, চ্যানেল টুয়েন্টিফোর-এর নিউজরুম এডিটর এন্ড প্রেজেন্টার নুসরাত ইম্পা, বৈশাখী টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার অপূর্ব অপু।
আড্ডার শুরুতে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন দৈনিক সমকাল পত্রিকার রিপোর্টার এসএম মুন্না। তিনি বলেন, ‘এই ভ্রমণ আমার ক্যারিয়ার তথা সাংবাদিকতা জীবনে ভিন্ন এক অভিজ্ঞতার সঞ্চার করেছে। শুধু তাই নয় ভারতের রাষ্ট্রপতির বক্তব্য এতো কাছ থেকে শুনতে পাবো কখনো হয়তো ভাবিনি। সবচেয়ে অবাক হয়েছি বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর ইতিবাচক মন্তব্যে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে সোনার বাংলা গড়তে এ দেশের যুব সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। দেশের কল্যাণে যুব সমাজকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শও দিয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি। ’ এসএম মুন্নার কথার রেশ ধরে যমুনা টিভির কামরুল ইসলাম রিফাত বলেন, ‘সাধারণভাবে ভাবলে এই সফর হয়তো অনেকের কাছে একেবারেই সাদামাটা লাগবে। কিন্তু একশজন তরুণের কাছে এই সফর একেবারেই অন্যরকম। এটি ছিলো ভারত সরকারের নিমন্ত্রণে আটদিনের একটি সফর। সফরের উদ্দেশ্য চারটি প্রদেশ ভ্রমণের পাশাপাশি ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মূখার্জির সাথে সাক্ষাতকরা, আর সেই সাথে বাড়তি পাওনা ছিলো বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্হান পরিদর্শন। প্রথমে দিল্লি, তারপর আগ্রা, রাজস্হান হয়ে কলকাতা। ব্যক্তিগতভাবে আমাকে মুগ্ধ করেছে জয়পুর ও রাজস্হান। রাজস্হানের পরিবেশ, মানুষ, প্রকৃতি, সংস্কৃতি এমনকি খাবার-দাবারসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে ভিন্নতার ছোঁয়া। ’ কামরুল ইসলাম রিফাতের কথার সঙ্গে মিল রেখে কালেরকণ্ঠের ফটোগ্রাফার তারেক আজিজ নিশকও রাজস্হানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তিনি বলেন, ‘পুরো ভ্রমণে রাজস্হানের সংস্কৃতিটাই আমাকে বেশি আলোড়িত করেছে। রাজস্হান দেখার পর থেকেই ডকুমেন্টারি তৈরির আগ্রহ অনেকাংশে বেড়ে গিয়েছিল। পুরো রাজস্হানের প্রত্যেকটি ফ্রেমই আমার কাছে একেকটি গল্প মনে হয়েছে। রাজস্হানের মানুষের আচার-আচরণ, পোশাক-আশাক এবং খাবার-দাবারের আলাদা একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ’ ইনডিপেনডেন্ট টিভির মুহম্মদ রিশাদ হুদা এই ভ্রমণের কথা একটু অন্যভাবে বললেন। তিনি বলেন, ‘ভারতের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ভারতকে দেখা আর নিজের চোখে দেখা ভারত অভিজ্ঞতা একেবারেই আলাদা। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে আমি এই ভ্রমণে ভারতীয় বেশকিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। বিশেষ করে দিল্লি, জয়পুর ও রাজস্হানের মানুষের কাছে বাংলাদেশ মানে উদীয়মান ক্রিকেট টিমের দেশ। বাংলাদেশের অন্যান্য ক্ষেত্রের সাফল্য কিংবা উন্নয়ন সম্পর্কে তারা তেমনকিছুই জানেন না। আমার মতে, বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতীয়দের জানানোর উদ্যোগ নেয়া উচিত। এটা হতে পারে তাদের মতো আমাদের সরকারও এমনিভাবে ভারতের তরুণদের এই দেশে ভ্রমণের উদ্যোগ নেয়া। ’ মাছরাঙা টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার নূর-উন-নাহার উইলি বলেন, ‘এই ভ্রমণে আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয় ছিলো রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাত এবং রাষ্ট্রপতির ভবন থেকে দিল্লির গেইট দেখা। সত্যিই এই ভ্রমণের ফলে ভারতে ঘোরার ব্যাপারে আমার ইচ্ছেকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আর সাথে বাড়তি পাওনা হিসেবে পেয়েছি ৯৯জন বন্ধু। যাদের মধ্যে থেকে নতুন অনেক বন্ধু পেয়েছি। ’ চ্যানেল টুয়েন্টিফোর-এর নিউজরুম এডিটর এন্ড প্রেজেন্টার নুসরাত ইম্পা জীবনে প্রথম এমন ভ্রমণ নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার জীবনে একদম ব্যতিক্রমধমর্ী অভিজ্ঞতা ছিলো এই সফর। কারণ ছাত্রজীবনের পাঠ চুকিয়ে চাকরিজীবনে প্রবেশ করার ফলে ঘোরাঘুরি একদমই হয় না বললেই চলে। সেই জায়গা থেকে এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি ভ্রমণে যেতো পারবো এটা একেবারেই কল্পনাতীত ছিলো। তাই এই ভ্রমণ অন্যরকম স্বপ্নের বাস্তবায়ন বলা যায়। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে এই ভ্রমণের মাধ্যমে আমি জীবনে প্রথমবার তাজমহল দেখার সুযোগ পেয়েছি। আটদিনের ভ্রমণের সবচেয়ে বড় আকর্ষণীয় দিক ছিলো সফরের তৃতীয় দিন রাষ্ট্রীয় ভবনের আতিথেয়তা গ্রহণের সুযোগ। হয়তো এই ধরনের ভ্রমণের সুযোগ না পেলে এমন একটি সুন্দর জায়গায় কখনোই যাওয়া হতো না। বৈশাখী টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার অপূর্ব অপু এই সফরের অভিজ্ঞতা একটু অন্যভাবেই ব্যাখ্যা করলেন। বললেন, ‘দেশের বাইরে তো বটেই, অনেকের সাথে পাখা মেলে আকাশে উড়াই ছিল প্রথম অভিজ্ঞতা। ভারত সফরের শুরু থেকে শেষ অবধি প্রতিটাক্ষণ ছিল আমার কাছে অনন্য এক মূহুর্ত। যাবার আগে যা ছিল জল্পনা-কল্পনা। সে দেশের মাটিতে পা রাখার পর তা ধরা দেয় বাস্তবে। ইতিহাস ঐতিহ্য সমৃদ্ধ নানা স্হান দর্শনের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি অভিভূত হই যখন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশ করি। খুব কাছে গিয়ে মুগ্ধ হই রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখাজর্ীকে দেখে, তার ভাষণ শুনে। অনেকের সাথে আমিও আবেগে আপ্লুত হই বিদেশের মাটিতে যখন বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে গাই আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। ’