Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

ভালোবাসায় মোড়া এক জন্মদিনের গল্প

আনন্দ আলো প্রতিবেদন

স্টুডিওতে বসে আছেন নায়করাজ রাজ্জাক। তার পাশে বসা নায়ক ফারুক, গীতিকার, চলচ্চিত্রকার, প্রযোজক গাজী মাজহারুল আনোয়ারসহ অনেকে। নায়করাজের ৭৬ তম জন্মদিন উপলক্ষে চ্যানেল আইণ্ডএর তারকাকথন অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছিল। নায়করাজকে দেশ-বিদেশ থেকে অনেকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন। হঠাৎ এলো একটি ফোন।

হ্যাঁলো, জন্মদিনের শুভেচ্ছা…

কে ফোন করেছেন এই নিয়ে সবার মাঝে মৃদু জল্পনা-কল্পনা। তবে তা কিছু সময়ের জন্য। সবাই বুঝে ফেলেছেন ফোন করেছেন চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে বিশিষ্ট অভিনেত্রী কবরী।

রাজ্জাক খুশি হয়ে কবরীকে বললেনণ্ড অ্যাই আপনি কোথায়ণ্ড…?

কবরী মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে বললেনণ্ড কোথায় মানে…?

এই তো আমি আছি আপনার মনের ভেতর…

কবরীর মন্তব্য শুনে রাজ্জাক মৃদু হেসে রসিকতা করে বললেনণ্ড

এভাবে বলবেন না, ঘুম হয় নারে ভাই…

পাশেই বসা নায়ক ফারুক টিপ্পনী কাটলেন-ঘটনা কী? এখনও এই অবস্থা…?

কবরী হাসতে হাসতে একটি জনপ্রিয় গানের সুর তুললেনণ্ড চোখ যে মনের কথা বলে…

কবরী গান গেয়েই চলেছেন। রাজ্জাক মৃদু হেসে বললেনণ্ড আর মনে করাইয়েন না। ঝামেলা হয়ে যাবে…

কবরী তখনও গানটি গাইছিলেন। রাজ্জাক বললেনণ্ড

অ্যাই… শোনেন  ফোনের লাইনটা কাটবেন না। আপনার সঙ্গে কথা আছে।

Razzak-2কবরীকে ফোনের লাইনে রেখে নায়করাজ স্টুডিওতে বসা অতিথিদের উদ্দেশে বললেনণ্ড অ্যাই যে গানটা শুনলেন এর একটা ইতিহাস আছে। গানটির যেদিন শুটিং হচ্ছিল সেদিন কি এক কারণে আমাদের দুজনের মাঝে ঝগড়া হয়েছে। ঝগড়া মানে মন কষাকষি। অনেকে ভেবেছিল নায়ক নায়িকার মন খারাপ কাজেই গানের দৃশ্যের অবস্থা না জানি কি হয়। কিন্তু গানের শুটিং দৃশ্যে আমরা ছিলাম বেশ স্বাভাবিক। আমার ধারণা সেদিন অনেক ভালো কাজ হয়েছে বলেই কবরীর মনোযোগ আকর্ষণ করলেন নায়করাজণ্ড অ্যাই আপনি কি ফোনে আছেন?

কবরী মৃদু হেসে বললেনণ্ড  হ্যাঁ আছি।

রাজ্জাক: আপনাকে আজকাল দেখা যায় না কেন?

কবরী: এই তো আছি… ভাইবেন না। ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পেয়ে যাবেন…

কবরীর কথা শুনে ঈর্ষাকাতর ভঙ্গিতে কৌতুকের ঢঙে ফারুক বলে উঠলেনণ্ড এখনও… এই অবস্থা…?

রাজ্জাক: ভাইরে সবকিছু কি ভোলা যায়?

প্রিয় পাঠক, এটাই হলো বন্ধুত্ব! আর যাই হোক বন্ধুত্বের মধুর সম্পর্ক কখনই ভোলা যায় না। ইচ্ছে করলে সে সম্পর্ক ছেদও করা যায় না। আমরা যে যাই বলি না কেন বন্ধুত্ব না থাকলে, কাজের প্রতি, প্রেম-ভালোবাসা না থাকলে সৃষ্টিশীল কোনো কাজই সফলতা পায় না। একথাতো সত্য আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গন খুব একটা সমৃদ্ধ অবস্থানে নাই এখন। অথচ এক সময় আমাদের চলচ্চিত্র দেশ-বিদেশে অনেক আলো ছড়িয়েছে। এর মূলে বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার অসীম প্রেরণা ছিল। চলচ্চিত্র ছিল একটি পরিবার। সুখে দুঃখে পরিবারের মানুষগুলো একসঙ্গেই থাকতেন। আর তাই সেই সময় চরম সংকটেও চলচ্চিত্র তার গতিপথ হারায়নি। বরং হোঁচট খেয়েও বারবার উঠে দাঁড়িয়েছে।

এবার নায়করাজ রাজ্জাকের ৭৬ তম জন্মদিনে তাঁর প্রতি চলচ্চিত্র পরিবারের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ফেলে আসা দিনগুলোর ছবি বার বার ভেসে উঠছিল। মনে হচ্ছিল- এই তো সেদিনের কথা। সবই ছিল আমাদের। মাত্র ৫ হাজার টাকার সম্মানীতে নায়করাজ ছবিতে নায়কের চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন। তারপরের ইতিহাস তো শুধুই ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় মোড়া। চলচ্চিত্রকে ভালোবেসেছিলেন বলেই আজ তিনি হয়েছেন নায়করাজ। আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তি।

Razzak-3অনেকে বলেন, চলচ্চিত্রাঙ্গনে পারস্পরিক ভালোবাসা আর মায়া-মমতার জায়গাটা এখন আর অতীতের মতো উজ্জ্বল নয়। আসলে তারা ভুল বলেন। তরুণ তারকাদের মধ্যে যোগাযোগ ও সমঝোতার জায়গাটা ততটা উজ্জ্বল না হলেও প্রবীণদের মধ্যে তা বেশ উজ্জ্বল। নায়করাজের জন্মদিনে সেদিন চ্যানেল আইতে ফোন করেছিলেন চিত্র নায়ক রিয়াজ। রাজ্জাক খুশি হয়ে রিয়াজকে প্রশ্ন করলেনণ্ড

রাজ্জাক: বাবা কোথায় তুমি? তোমার সঙ্গে আমার ঝগড়া আছে।

রিয়াজ: (হাসতে হাসতে) ঝগড়া, আমার সঙ্গে? কেন আংকেল?

রাজ্জাক: তুমি আজকাল একা একা মাছ ধরে বেড়াচ্ছ। আমাকে সঙ্গে নিচ্ছ না কেন?

রিয়াজ: (হাসতে হাসতে) ভুল হয়ে গেছে আংকেল। এবার আপনাকে অবশ্যই সঙ্গে নিব। ভালো থাকবেন।

রাজ্জাক: তুমিও ভালো থেকো। বাসায় এসো বাবা…

রিয়াজ ফোন ছেড়ে দিতেই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলেন নায়করাজ রাজ্জাক। খুউব ভালো ছেলে। রিয়াজের পর পরই ফোন করলেন বিশিষ্ট চিত্র নায়ক আলমগীর। সঙ্গে সঙ্গে নায়করাজের মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।

আলমগীর: ভাই  ামালেকুম…

নায়করাজ: ওয়ালাইকুম আসসালাম। কোথায় তুমি? তোমাকে আজকাল দেখি না কেন?

আলমগীর: ভাই দারুণ ব্যস্ততা যাচ্ছে। শুভ জন্মদিন! আপনার শরীর কেমন?

নায়করাজ: আছি মোটামুটি। ঠান্ডায় কষ্ট হয় এই আর কি!

আলমগীর: আজ আপনার জন্মদিন। আমার মায়ের মৃত্যুর দিন…

নায়করাজ: হ্যাঁ আমি জানি… বলেই নায়করাজ রাজ্জাক স্মৃতিময় এক ঘটনা তুলে ধরলেন। পুরনো দিনের ঘটনা। নায়করাজের জন্মদিনে তার বাসায় চলচ্চিত্রাঙ্গনের সর্বস্তরের মানুষ হাজির। নায়ক আলমগীরও ছিলেন। হঠাৎ রাজ্জাকের স্ত্রী লক্ষ্মী একটা টেলিফোন রিসিভ করে স্তম্ভিত হয়ে যান। নায়ক আলমগীরের মায়ের মৃত্যু সংবাদ নিয়ে ফোনের ওপাশে হাজির একজন আত্মীয়। লক্ষ্মী রাজ্জাককে ডেকে সবকিছু বললেন। তারপর লক্ষ্মীই শোক সংবাদটা দিলেন আলমগীরকে। মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে চলে যান আলমগীর। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রাজ্জাক বললেনণ্ড আলমগীর, ভাই ভালো থেকো…

আলমগীর: আপনিও ভালো থাকেন, সুস্থ থাকেন।

Razzak-1এপর্যায়ে আরেক মধুর সম্পর্কের খোঁজ পান সবাই। নায়ক ফারুক নিজে সেই সম্পর্কের কথা তুলে ধরেন। “আলমগীরের মাকে আমিও মা বলে ডাকতাম। তিনি আমাকে দারুণ স্নেহ করতেন”। সঙ্গে সঙ্গে ফারুকের কথা সমর্থন করে আলমগীর বলেন, “হ্যাঁ সত্যি কথা। ফারুক ছিল আমার মায়ের আরেক সন্তান। মা আমাকে বলতেন ফারুক তোর বড় ভাই…”

তুমি তো আর পুরনো হলে না

অনুষ্ঠান চলাকালে নায়করাজকে ফোন করেন চিত্র নায়িকা নতুন। তিনি ফোনে বলেই যাচ্ছিলেনণ্ড রাজ্জাক ভাই আমি নতুন, নতুন…

রাজ্জাক: (হাসতে হাসতে) ও নতুন… তুমিতো আর কোনো দিন পুরনো হবে না। হা: হা: হা…

নতুন: আপনার দোয়া। আপনার শরীর ভালো?

রাজ্জাক: হ্যাঁ, ভালো। শোন, শরীর ভালো না থাকলে কি আর চ্যানেল আইতে অনুষ্ঠান করতে আসতে পারতাম।নতুন: শরীর খারাপ থাকলেও আমি আপনাকে ধরে নিয়ে আসতাম। আমাদেরকে ভুলে যাবেন না, প্লিজ… একটু আগে কবরী ম্যাডাম বললেন চোখ যে মনের কথা বলে। আমিও তেমনি বলছি দিল যে মনের কথা বলে…

সেই থেকে তিনি আমার বাবা

নায়করাজের এবারের জন্মদিনে শিল্পীদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা আর মায়া মমতার স্পর্শই যেন গুরুত্ব পাচ্ছিল। স্টুডিওতে উপস্থিত ছিলেন চিত্র নায়িকা নিপুণ। মজার এক স্মৃতিকথা তুলে ধরলেন তিনি। “আমার প্রথম ছবি। নায়করাজকে বাবা ডাকতে হবে। আমার একটাই সংলাপণ্ড বাবা! কিন্তু আমি কোনোভাবেই তা পারছিলাম না। পরিস্থিতি বুঝে নায়করাজ পরিচালককে বললেনণ্ড ওকে একটু সময় দাও। তারপর তিনি আমাকে দৃশ্যটা বোঝালেন। তোমার বাবাকে যে ভাবে বাবা বলে ডাকো। সেভাবেই আমাকে ডাকো। চেষ্টা কর তুমি পারবে।

হ্যাঁ এবার আমি সত্যি সত্যি ‘বাবা’ বলে সংলাপটা দিতে পারলাম। এক টেকেই দৃশ্যটা ওকে হলো। তখন থেকে নায়করাজ আমার বাবা। আমি তাকে বাবা বলে ডাকি!

উল্লেখ্য, চ্যানেল আই-এর অনুষ্ঠানটিতে নায়করাজের সঙ্গে আরও উপস্থিত ছিলেন নায়করাজের কনিষ্ঠপুত্র সম্রাট ও নবাগতা নায়িকা ঋতু। উপস্থাপনায় ছিলেন দিলরুবা সাথী। অনুষ্ঠানের প্রযোজক ছিলেন অনন্যা রুমা।