Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

ভালোবাসার রাজপুত্র

আনজীর লিটন:

এক তরুণীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে। বাবা-মা তাকে ডেকে নিয়ে বললেনণ্ড মা,  আমরা তোমার বিবাহ ঠিক করেছি। পাত্র দেখতে সুন্দর, শিক্ষিত। দেখলে তোমার পছন্দ হবে। তোমার মতামত প্রয়োজন। তোমার মতামত  পেলেই আমরা আগাব…

মেয়ে তাৎক্ষণিক ভাবে বাবা মাকে কিছুই বলল না। তবে একদিন পর বাবা-মাকে সাফ জানিয়ে দিল এই বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ সে উত্তমকে ভালোবাসে। বিয়ে যদি করতেই হয় তাহলে উত্তমকেই করবে। আর কাউকে নয়।

বাবা-মা মেয়ের প্রতি যার পর নাই রুষ্ট হলেন। মেয়ে নিজের ইচ্ছায় পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাও আবার হিন্দু ছেলেকে। না, এটা কখনই হতে পারে না।

মেয়েকে এবার কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন বাবা-মা। বললেনণ্ড তোমার এত অধঃপতন হয়েছে? কোন সাহসে তুমি আমাদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছ? আমাদের মতামতের কী কোনোই মূল্য নাই তোমার কাছে? উত্তমটা কে? নিশ্চয়ই হিন্দু ছেলে? হিন্দু ছেলের সঙ্গে তোমার বিবাহ অসম্ভব! নিজেকে বদলাও। সিদ্ধান্ত পাল্টাও। তা নাহলে তোমার সঙ্গে আমরা নাই…

তবুও মেয়ের একই কথা। বিবাহ করলে আমি উত্তমকেই করব। আমার সিদ্ধান্তের কোনোই নড়চড় হবে না। মেয়ের অনড় সিদ্ধান্তে বাবা-মা বিচলিত হয়ে উঠলেন। মা তো কেঁদে কেটে অস্থির। স্বামীর কাছে আবদার করলেনণ্ড শোনো, এককাজ করো। মেয়ে যে ছেলেকে বিয়ে করতে চায় তাকে একবার দেখো। কথা বল। হোক হিন্দু ছেলে। মেয়ের সুখেই আমাদের সুখ।

বাবা মেয়েকে কাছে ডাকলেন। নরম সুরে বললেনণ্ড ঠিক আছে আমরা তোমার কথায় রাজি। কিন্তু একটা শর্ত আছে। আমরা আগে ছেলেকে দেখব। তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিব।

বাবার কথা শুনে মেয়ে খুশি হয়ে বললণ্ড ছেলেটাকে দেখতে হলে সিনেমা হলে যেতে হবে।

মেয়ের কথা শুনে বাবা আঁতকে উঠলেন। মেয়ে বলে কী? শেষ পর্যন্ত সে কি সিনেমা হলের ম্যানেজারকে বিয়ে করবে? নাকি লাইটম্যান অথবা টিকেট চেকার? পরের দিন মেয়ের সঙ্গে বাবা-মা সিনেমা হলের দিকে ছুটলেন। ম্যাটিনি শো চলছে। বাবা-মা মেয়েকে বললেনণ্ড কোথায় তোমার পছন্দের পাত্র? তাড়াতাড়ি সাক্ষাৎ করাও…

মেয়ে বললণ্ড আসো আগে আমরা সিনেমা দেখি তারপর পাত্রের সঙ্গে তোমাদের দেখা করাব।

সিনেমা দেখে মা-বাবা তৃপ্ত। তাদের পছন্দের নায়ক-নায়িকা উত্তম-সূচিত্রার অভিনয় দারুণ লেগেছে। বিশেষ করে উত্তমের অভিনয়, ফাশক্লাশ!

বাবা মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেনণ্ড হ্যাঁ এবার তোমার পছন্দের পাত্রকে দেখাও।

মেয়ে হাসতে হাসতে বললণ্ড বাবা আমার পছন্দের পাত্রের নাম তোমাদেরকে বলেছিলাম খেয়াল আছে?

বাবা মনে করার চেষ্টা করে বললেনণ্ড হ্যাঁ মনে আছে তার নাম উত্তম।

মেUttam-Suchitraয়ে মৃদু হেসে বললণ্ড বাবা একটু আগে তো তোমরা সিনেমায় উত্তমকেই দেখলে। আমি উত্তম কুমারের মতো একটা ছেলেকে বিবাহ করতে চাই।

দুই.

প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে কথা হচ্ছে।

প্রেমিকা: অ্যাই তোমাকে না বলেছিলাম রাজ্জাকের মতো চুলের স্টাইল করতে…

প্রেমিক: আমার চুল তো সজারুর কাটার মতো। রাজ্জাকের মতো হবে না।

প্রেমিকা: ইস্‌ তোমার হাসিটা যদি রাজ্জাকের মতো হতো…

প্রেমিক: তুমি কি আমাকে চাও? নাকি রাজ্জাককে?

প্রেমিকা: (মন্ত্র মুগ্ধের মতো) ইস্‌ রাজ্জাকের সঙ্গে যদি প্রেম করতে পারতাম… জীবন ধন্য হয়ে যেতো।

তিন.

যদিও যুগ পাল্টেছে। এখন ভালোবাসার কথা হয় মোবাইল ফোনে, ফেসবুকে, ভাইবারে। অনেক ক্ষেত্রে সকালের ভালোবাসা দুপুর পর্যন্ত টিকে না। কিন্তু ভালোবাসার কথা উঠলে ওপারের মহানায়ক উত্তম কুমার আর এপারের নায়করাজ রাজ্জাকের কথা অজান্তে গুরুত্ব পায়। এর একটাই কারণ কিংবদন্তি তুল্য এই দুই অভিনেতা সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে ভালোবাসার রাজপুত্রের ভূমিকা পালন করেছেন। সে কারণে এখনও বাঙলি তরুণদের মাঝে ভালোবাসার ক্ষেত্রে অনুকরণীয় আইডল ওপারের উত্তম আর এপারের রাজ্জাক। শুধু সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শক মনে কতটা জায়গা করে নেয়া যায় তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ মহানায়ক উত্তম কুমার। পাশাপাশি নায়করাজ রাজ্জাকের ভূমিকাও এক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বলা যায় দুজনই আমাদের ভালোবাসার রাজকুমার।

প্রশ্ন উঠতে পারে ভালোবাসা আসলে কী? কাউকে দেখে ভালো লাগলো সেটাই কী ভালোবাসা? হেঁটে যাচ্ছে একটি মেয়ে অথবা একটি ছেলে তাদেরকে এক ঝলক দেখেই মন ভালো হয়ে গেল। এটাই কী ভালোবাসা? একটি ছেলে প্রতিদিন সকাল, বিকাল যখনই সময় পায় বাড়ির ছাদে ওঠে। পাশের বাড়ির ছাদে কাউকে খোঁজে। যেদিন তাকে দেখতে পায় সেদিন তার মনের ভেতর আনন্দ উৎসবের ঢেউ ওঠে। আর যেদিন দেখতে পায় না সেদিন কষ্টের ঢেউ উথাল-পাতাল করে মনের ভেতর। এটাও এক ধরনের ভালোবাসা। আবার এমনও হয় সেই ছোটবেলা থেকে পাশাপাশি-কাছাকাছি বেড়ে উঠছে দুজন। কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্য। কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় প্রতিদিনই কাছাকাছি, পাশাপাশি কেটেছে দুজনের। ‘তুই’ সম্মোধনে কথা বলে দুজন। একে অপরকে ভালোবাসে। অথচ একদিনও মুখ ফুটে বলা হয়নি। অতঃপর একদিন মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়। তখন দুজন বুঝতে পারে ভালোবাসার রং কেমন, ভালোবাসার শক্তি কেমন। আবার এমনও হয় অসম্ভব রকমের ভালোবাসায় জড়িয়েছে দুজন। একজনকে ছাড়া অন্যজনের যেন চলেই না। সকালে দেখা হয়েছে। তবুও বিকেলে দেখা হতেই হবে। হয়তো সারাদিন একসঙ্গে থাকার পরও ছেড়ে যেতে মন চায় না। শুধুই মনে হয় আরেক দণ্ড থাকি। হাতে হাত রেখে বসে থাকা ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কথা নাই। মাঝে মাঝে চোখ ফেলে তাকানো। মৃদু হাসি। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আদর করা। অজান্তে মনের ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসে সেই প্রচলিত প্রেমের বাণীণ্ড তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। বলো… আমাকে ছেড়ে তুমি চলে যাবে না… বলো…

Razzak-Koboriপ্রতিদিন নতুন করে প্রতিজ্ঞা। না, না তোমাকে ছেড়ে আমি কোথায় যাব? তুমিই তো আমার পৃথিবী। আমার সাহস, আমার চলার পথের সঙ্গী। অসম্ভব তোমাকে ছাড়া আমি একদণ্ডও কল্পনা করতে পারি না।

অথচ হঠাৎ একদিন… অকস্মাৎ… ভেঙে যায় সম্পর্কের বাঁধন। ছোট ঘটনা অথবা তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে মন কষাকষিণ্ড তুমি এটা করতে পারলে… তুমি…? আমি থাকবো না তোমার সঙ্গে… গুডবাই…

এভাবেও ভালোবাসা ভেঙে যায়। আবার এমনও হয় যাকে ভালোবেসেছি তাঁকে আর ছাড়বো না। শতকষ্টেও তার সঙ্গে থেকে যাব। ভালোবাসার এমন নজীর ভূরি ভূরি। এক দম্পতির কথা জানি। ভালোবেসে বিয়ে করেছে। সংসার শুরু করার পর এক পর্যায়ে মতের অমিল দেখা দেয়। তাই বলে নিজেদেরকে ছেড়ে যায়নি তাঁরা। তাঁদের সংসারে এখন ছেলে বউ, নাতি নাতনিদের রাজত্ব। এতবড় সংসার অথচ কেউ জানে না সংসারের শেকড়ে একটা ব্যথা হয় মাঝে মধ্যে। ব্যথাটা বুঝতে দেয় না বড়োবুড়ি। কেন দেয় না জানেন? সংসারের প্রয়োজনেই। তারা প্রতিদিনই চেষ্টা করে সংসারের উত্তম ভালোবাসার শক্তি ছড়িয়ে দিতে। কারণ ভালোবাসাই একটি সংসারের অগ্রগতির মূলমন্ত্র। আর সেটা যদি হয় উত্তম ভালোবাসা তাহলে তো কথাই নেই।

আবারও সেই প্রশ্নটাই করিণ্ড ভালোবাসা আসলে কী? ভালোবাসার কী কোনো রং আছে। নাকি আছে কোনো বিশেষ ফর্মুলা? এই যে আমরা উত্তম ভালোবাসার কথা বলছি সেটাই বা কেমন?

ভালোবাসা নিয়ে হেলাল হাফিজের একটা কবিতার লাইন এরকমণ্ড তোমার জন্য সকাল, দুপুর তোমার জন্য সন্ধ্যা, তোমার জন্য সকল গোলাপ এবং রজনীগন্ধা। তার মানে কী! তোমার জন্য সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, রাত্রি… তোমার জন্যই তো সব… এটাই কী উত্তম ভালোবাসা? হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেনণ্ড ভালোলাগা এমন এক জিনিস যা একবার শুরু হলে সবকিছুই ভালো লাগতে থাকে…

তার মানে এটাই কী উত্তম ভালোবাসার লক্ষণ? নির্মলেন্দু গুণের মতে, ভালোবাসি বলে দেব স্ট্রেটকাট, আবার যখনই দেখা হবে…

এটাকে কী বলব? ভালোবাসা এখনও উত্তম হয়ে উঠেনি। অর্থাৎ ভালোবাসা তার শক্তি পায়নি এখনও। আবার যদি সুনীলের কবিতার সেই লাইন ক’টি পড়ি তাহলে কী উত্তম ভালোবাসাকে উপলব্ধি করা যাবেণ্ড দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়, বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টি নীলপদ্ম। তবুও কথা রাখেনি বরুনা…

এই যে ‘কথা রাখা না রাখা’ এটাই আসলে উত্তম ভালোবাসার প্রাণশক্তি। কথা দিয়েছি আমি তোমার সঙ্গে থাকব। কাজেই আমি আছি… বর্তমান যুগে কতজন কথা দিয়ে কথা রাখে? কতজন সঙ্গে থাকবে বলে সঙ্গে সঙ্গেই হাঁটে?

চলমান চিত্রটা ভালো না। মোটেই ভালো না এই যে সঙ্গে থাকা না থাকার চিত্রটা। তাই বলে কী ভালোবাসা হারিয়ে গেছে? কেউ কী কাউকে ভালোবাসছে না? কেজি মুস্তফার সেই গানের লাইনের মতোণ্ড তোমারে লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে, রাতের বাসরে দোসর হয়ে তাই সে আমার টানে… ভালোবাসার এমন শক্তি কী এখন নেই? আছে অবশ্যই আছে। তবে ভালোবাসার রং পাল্টেছে। প্রকাশের ভঙ্গি পাল্টেছে। আর তাই কোনটা উত্তম ভালোবাসা তা সহজেই বলে দেয়া যায় না।

ভালোবাসার কথা উঠলেই বাংলা ছবির মহানায়ক ওপারের উত্তম কুমার আর এপারের নায়করাজ রাজ্জাকের নাম সবার আগে উঠে আসে। একথাতো সত্য উত্তমকে ভালোবেসে বাংলা ছবি দেখার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে বাঙালি দর্শক। উত্তম ভালোবাসায় যুক্ত হন বাংলা ছবির কিংবদন্তি নায়িকা সূচিত্রা সেন। এক পর্যায়ে উত্তম-সূচিত্রার ছবি ভালোবাসার ‘উত্তম সূত্র’ অথবা প্রেরণা হয়ে ওঠে। ছবিতে উত্তম আর সূচিত্রাকে দেখে দর্শক বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা তাঁদের মতোই হবার চেষ্টা শুরু করে। তরুণেরা এক একজন উত্তম কুমার আর তরুণীরা এক একজন সূচিত্রা সেন হবার অদৃশ্য প্রতিযোগিতা শুরু করে। একসময় বাঙালির সমাজ জীবনে উত্তম- সূচিত্রার চলচ্চিত্র জুটি উত্তম ভালোবাসায় পরিণত হয়। ভালোবাসলে হয় উত্তমের মতো না হয় সূচিত্রার মতোই ভালোবাসব।

একই ভূমিকা পালন করেছেন আমাদের নায়করাজ রাজ্জাক। রাজ্জাক-কবরী, রাজ্জাক-ববিতা, রাজ্জাক-সুজাতা অথবা রাজ্জাক-সুচন্দা জুটিতো ভালোবাসারই অমর জুটি। জয় হোক ভালোবাসার।