Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

ভালোবাসার চেয়ে আর কোন বড় শক্তি নাই

গভীর রাত। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে বাসার সবাই চমকে উঠলো। এত রাতে কে এলো? বাসার কর্ত্রী মিনারা সবাইকে সাবধান করে দিয়ে বললেনÑ খবরদার কেউ দরজা খুলবে না। বাসার কর্তা আব্দুল গফুর স্ত্রীর কথায় মৃদু প্রতিবাদ করলেনÑ হয়তো কেউ বিপদে পড়েছে। আত্মীয়-স্বজন কেউ হতে পারে। যাই দরজা খুলে দেই। বলেই জাহিদকে দরজা খোলার জন্য যেতে বললেনÑ জাহিদ যাতো দরজা খুলে দে। আগে নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করিস। তারপর…

মিনারা স্বামীকে ধমক দিলেনÑ আমার কথা তোমার পছন্দ হচ্ছে না, না? দিনকাল এমনিতেই খারাপ। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। যে কলিং বেল বাজাচ্ছে সে তো সন্ত্রাসীও হতে পারে। দরজা খোলার পর যদি সবার বুকে ছুরি ধরে বলেÑ যা যা আছে দিয়ে দাও। তখন কি হবে? কে আমাদেরকে রক্ষা করবে?

সম্পর্কিত

বাইরে প্রচন্ড শব্দ করে বাজ পড়ার শব্দ হলো। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দটা থেমে থেমেই আসছে। বাজ পড়ার শব্দ হতেই কড়া নাড়ার শব্দটা আগের চেয়ে বেড়ে গেল। মিনু বললÑ যা কেউ হয়তো বিপদে পড়েছে। যাই দরজাটা খুলে দেই।

মিনারা এবার মেয়েকে ধমক দিলেনÑ লাউয়ের ডগার মতো গায়ে গতরে শুধু বড়ই হচ্ছিস। তোর বুদ্ধি শুদ্ধি কবে হবে? কড়া নাড়ার শব্দ শুনে কি করে বুঝলি কেউ বিপদে পড়েছে? মা, নিজের ঘরে যা। ঘুমা গিয়ে।

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ এবার আরও জোরে হচ্ছে। আবার একটা বাজ পড়ার শব্দ হলো। আব্দুল গফুর এবার আর স্ত্রীর কথার জন্য অপেক্ষা করলেন না। দরজা খোলার জন্য এগিয়ে গেলেন। মিনারা হৈ চৈ করে উঠলেনÑ আমার কথা শোনো, যেও না। এত রাতে কে না কে? সন্ত্রাসীও তো হতে পারে… মিনুর বাবা শোনে…

সদর দরজা খোলার শব্দ হলো। কি ঘটতে যাচ্ছে এই ভেবে সবার চোখে মুখে ভয় আর উৎকণ্ঠা। মিনারা আপন মনে গজরাতে থাকলেন। গরিবের কথা বাসি হলেই ফলে। নির্ঘাত কোনো সন্ত্রাসী দরজায় কড়া নাড়ছিল। জাহিদ দ্যাখতো কি হলো? তোর বাবার কথাবার্তাতো কিছুই শোনা যাচ্ছে না। সন্ত্রাসী নিশ্চয়ই তার মাথায় পিস্তল তাক করেছে। হায় আল্লাহ আমি এখন কি করি? এত রাতে কে আসবে আমাদেরকে হেল্প করতে। জাহিদ দাঁড়িয়ে আছিস কেন? একটু এগিয়ে যা… দ্যাখ না কি হলো…?

জাহিদকে যেতে হলো না। এক মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন আব্দুল গফর। মহিলা বৃষ্টিতে ভিজে জুবুথুবু। তার মুখটা ভেজা আঁচলে ঢাকা। গফুর সবার দিকে তাকিয়ে বললেনÑ বাইরে বৃষ্টি। উনি বিপদে পড়েছেন। একটু আশ্রয় চান। তাই…

মিনারা সন্দেহ ভরা চোখে মহিলার দিকে তাকালেন। বৃষ্টি ভেজা শরীরের সৌন্দর্য যেন ঠিকরে পড়ছে। এই মহিলাকে আশ্রয় দিলে বিপদ হতে পারে। গম্ভীর কণ্ঠে মহিলাকে প্রশ্ন করলেনÑ কি নাম?

সূচিত্রা।

হিন্দু?

জি…।

এত রাতে কোত্থেকে আসছেন?

ঠিক মনে করতে পারছি না কোত্থেকে এসেছি।

আব্দুল গফুর মেয়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেনÑ মিনু যাতো উনাকে তোর ঘরে নিয়ে যা। আগে কাপড় চেঞ্জ করুক। তারপর না হয় কথা বলা যাবে। মিনু মহিলাকে বললÑ আপনি আসেন। আমার সঙ্গে।

মেয়েকে ধমক দিলেন মিনারাÑ অ্যাই দাঁড়া। উনার সঙ্গে আমার কথা আছে। আগে নাম পরিচয় ঠিকানা জানা দরকার। তারপর অন্য কথা।

এবার স্ত্রীর কথার প্রতিবাদ করলেন গফুরÑ সেটাতো পরেও করা যায়। দেখছো না উনি ভিজে একসার। কাপড় ছাড়–ক। ফ্রেস হয়ে আসুক তারপর না হয় কথা বলা যাবে। মিনু যাতো উনাকে তোর ঘরে নিয়ে যা। মিনারা এবার কিছু বললেন না। মিনুর সঙ্গে সঙ্গে সূচিত্রা নামের মহিলাটি ড্রয়িংরুম থেকে বেড়িয়ে গেল। আর তক্ষুনি স্বামীর মুখোমুখি দাঁড়ালেন মিনারা- তোমার কি মনে হয় এই মহিলা ভালো, চরিত্রবান? রাত কয়টা বাজে? এত রাতে ভদ্রঘরের কোনো মেয়ে বাসার বাইরে থাকে। আমার তো মনে হয় এই মহিলা রাস্তায় থাকে। তাকে তুমি বাসার ভেতর নিয়ে এলে?

আব্দুল গফুর কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। স্ত্রীর কথায় শুধুই আমতা আমতা করতে থাকলেন। গফুরের পক্ষে কথা বলার চেষ্টা করলো জাহিদÑ মা আমার মনে হয় তুমি যা ভাবছো তা ঠিক না। কোনো কারণে এই মহিলা বিপদে পড়েছে। ঝড়ের রাতে… এমন তো হতেই পারে… কাজেই…

ছেলেকে ধমক দিলেন মিনারাÑ অ্যাই, এই পৃথিবীতে কে আগে এসেছে? আমি না তুই? নিশ্চয়ই আমি। তাহলে তোর চেয়ে পৃথিবীর মানুষকে আমি একটু বেশীই দেখেছি ঠিক কি না? কাজেই মানুষ সম্পর্কে তোর চেয়ে আমার অভিজ্ঞতাও বেশি হওয়া উচিত, ঠিক কি না? কাজেই আমাকে জ্ঞান দিবি না। আমার একটাই কথা। বৃষ্টি থেমে যাচ্ছে। ঐ মহিলাকে রাখা যাবে না। তাকে চলে যেতে হবে। বাইরে আবার বাজ পড়ার শব্দ হলো। আব্দুল গফুর স্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, শোনো এত রাতে মাথা গরম করো না। আমরা তার সঙ্গে কথা বলি। সকাল হোক। তারপর না হয় সে চলে যাবে।

স্বামীর কথা শেষ করতে দিলেন না মিনারা। প্রতিবাদের সুরে বললেনÑ আমার কথার বাইরে কোনো কথা নাই। আমি বলেছি এই মহিলা চলে যাবে… কাজেই তাকে যেতে হবে। আমার কথাই ফাইনাল।

মায়ের কথার প্রতিবাদ করতে চাইল জাহিদ। মিনারা তাকেও ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল। এমন সময় হন্তদন্ত চেহারায় সবার সামনে এসে দাঁড়াল মিনু। সে রীতিমত কাঁপছে। অমঙ্গল কিছু কি ঘটেছে? এমন আশঙ্কায় মিনারা মেয়েকে প্রশ্ন করলেনÑ কি হয়েছে। ঐ মহিলা তোকে আক্রমণ করেছে। নিশ্চয়ই সন্ত্রাসী? সঙ্গে পিস্তল আছে? হায় আল্লাহ আমি এখন কি করি… হায় আল্লাহ…

এবার মিনু মাকে মৃদু ধমক দিলÑ মা তুমি যা ভাবছো তা না।

মিনারা কিছুটা শান্ত হয়ে বললেনÑ আমি যা ভাবছি তা নয়? তাহলে ঘটনা কি? তুই এভাবে হাঁফাচ্ছিস কেন?

মিনারা এবার মুখে হাসি ছড়িয়ে বললÑ ঐ মহিলা কে জানো?

কে? সমস্বরে সবাই জানতে চাইল।

মিনু রহস্য করার ভঙ্গিতে বললÑ মহিলা একটু আগে ড্রয়িংরুম থেকে যাবার সময় তার নাম বলেছে। নামের মধ্যেই তার পরিচয় লুকিয়ে আছে। মিনারা সত্যি সত্যি রহস্যের মধ্যে পড়ে গেলেন। নামের মধ্যেই পরিচয় লুকিয়ে আছে? মহিলা তার নাম বলেছে সূচিত্রা। সূচিত্রাতো কত মেয়েরই নাম। এটা কোনো পরিচয় হলো। মেয়েকে ধমক দিলেন মিনারা Ñএত রাতে আর রহস্য করিস না তো। আসল ঘটনা খুলে বল। কে এই মহিলা?

বললাম তো নামের মাঝেই তার পরিচয় লুকিয়ে আছে। তার নাম সূচিত্রা। এবার বলো তার পরিচয় কি?

আব্দুল গফুর মেয়ের মুখের দিকে তাকালেনÑ সূচিত্রাতো অনেক মেয়েরই নাম। এই মহিলার নামের সঙ্গে চমকটা কি? রহস্য করিস না তো মা। আসল ঘটনা বল। উনি নিশ্চয়ই কাপড় চোপড় পড়ে ফ্রেস হয়েছেন। যা ডেকে নিয়ে আয়। আমরা কথা বলি। যা…

মিনু চলে যাচ্ছিল। মিনারা মেয়েকে ডাক দিলেনÑ মিনু শোন।

ঘুরে দাঁড়াল মিনু। মিনারা বললেনÑ রহস্য টা ক্লিয়ার কর। তারপর মহিলাকে নিয়ে আয়। কে এই মহিলা?

মিনু এবার আর রহস্য করলো না। বাবা মা ও ভাইকে কাছে ডেকে নিয়ে বললÑ জানো এই মহিলা কে?

বাবা জানতে চাইলেনÑ কে?

মাও জানতে চাইলেনÑ কে?

ভাই বললÑ উনি কি কোনো সেলিব্রিটি?

ভাইয়ের কথায় সমর্থন করে মিনু বললÑ হ্যাঁ, উনি একজন সেলিব্রিটি। উনি কে জানো? উনি বিশ্বজয়ী চিত্র তারকা সূচিত্রা সেন।

মেয়ের কথা শুনে অবাক হলেন মিনারা। মেয়েকে প্রশ্ন করলেনÑ কি বললি তুই? উনি সূচিত্রা সেন?

হ্যাঁ।

এটা কি করে হয়? সূচিত্রা সেন তো মারা গেছেন।

মিনু জোর দিয়ে বললÑ মা উনিই সূচিত্রা সেন। কি সুন্দর চেহারা। আমার একটা লাল শাড়ি পরেছেন। শরীরে কোনো অলংকার নাই। তবুও যেন রূপের আলো ঠিকরে পড়ছে। মুখের হাসিটা কি যে মিষ্টি। যাই তাকে ডেকে নিয়ে আসি।

মিনু পাশের ঘরের দিকে চলে যাচ্ছিল। মিনারা তাকে ডাকলেন। তার অস্থির লাগছে। এটা কি করে হয় মৃত মানুষ পৃথিবীতে এভাবে আসে কি করে? স্বপ্ন দেখছেন নাতো? হাতে চিমটি কেটে দেখলেন। না, স্বপ্ন নয়। বাস্তব। নাকি ভূত ঢুকেছে বাসায়। ঝড়ের রাত। গাছের ডাল ভেঙে গেছে। গাছে আশ্রয় হারা ভ‚ত ঢুকে পড়েছে মানুষের বাসায়। মিনু জিজ্ঞেস করলোÑ মা তোমার কি খারাপ লাগছে?

হ্যাঁ। মাথা ঘুরছে। তুই কীভাবে বুঝলি ঐ মহিলাই সূচিত্রা সেন?

তুমি তার চেহারা দেখলেই চিনে ফেলবে। হাসিটা যে কি সুন্দর…

মিনারা বললেনÑ সূচিত্রার ঐ হাসিটাই তো পৃথিবী মাত করেছে। তোদের বাবা সূচিত্রার দারুণ ভক্ত। আমরা তখন ফরিদপুরে থাকি। তোর বাবার সঙ্গে একটু একটু পরিচয় হয়েছে। একদিন কলেজে যাচ্ছিলাম। পিছন থেকে কেউ একজন বললÑ এই যে সূচিত্রা সেন একবার তাকাবেন। পিছন ফিরে দেখি একটা ছেলে। গট গট করে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। বললÑ অ্যাই, আপনি দেখতে অনেকটা সূচিত্রার মতো। আমি আপনার বন্ধু হতে চাই।

আমি সূচিত্রার মতো দেখতে এই একটা মন্তব্যই প্রেমের ফাদে ফেলল। তোর বাবাকে আমি ভাবতাম উত্তম কুমার। আর তিনি আমাকে ভাবতেন সূচিত্রা। তুই কি সত্যি বলছিস মিনু সেই সূচিত্রাই আমাদের বাসায় এসেছে?

হ্যাঁ মা সেই সূচিত্রা, সূচিত্রা সেন…

আব্দুল  গফুর মেয়ের কথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। মৃত মানুষ প্রকাশ্যে আসে কি করে? এও কি হয়? স্বপ্ন দেখছে না তো। তিনিও শরীরে চিমটি কাটলেন। ব্যথা পেলেন। তারমানে জেগেই আছেন। মিনু বললÑ মা উনাকে ডেকে আনবো?

মিনারা বললেনÑ তোর বাবা কি বলে শোন।

বাবা, উনাকে ডাকবো?

আব্দুল গফুর আবারও সিওর হতে চাইলেনÑ তুই ঠিক বলছিস, ঐ মীহলাই সূচিত্রা সেন?

মিনু বললÑ হ্যাঁ বাবা উনিই সূচিত্রা সেন।

উনি তো মারা গেছেন। মৃত মানুষ কিভাবে… নিজেই নিজেকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে মেয়ের দিকে তাকালেন আব্দুল গফুর। জানিস রে মা সূচিত্রা সেনের একটা সিনেমা আমি ২৫ বার দেখেছি। সিনেমার নাম সাগরিকা। কি তার অভিনয়। কি তার ব্যক্তিত্ব, কি তার মুখের হাসি। যা তাকে ডেকে আন।

মিনু তার ঘরের দিকে চলে গেল। আব্দুল গফুর ও মিনারা মুখোমুখি দাঁড়ালেন। জাহিদ তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মা বাবার পরিবর্তন দেখে সে কিছুটা বিব্রত। জাহিদকে অবাক করে দিয়ে বাবা-মা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেন।

মা বাবাকে বললেনÑ তুমি আমার উত্তম।

বাবা মাকে বললেনÑ তুমি আবার সূচিত্রা।

 

শুধু একটা লাল শাড়ি পরেছেন সূচিত্রা। তাতেই সৌন্দর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে। একটা চেয়ারে বসে আছেন। তার সামনে মেঝেতে বসে আছেন মিনারা, মিনু। দূরে সোফায় বসে আছেন আব্দুল গফুর। সোফার হাতল ধরে দাঁড়িয়ে আছে জাহিদ।

বাইরে বৃষ্টি থামেনি। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে এখনও। ড্রয়িং রুমে কেউ কোনো কথা বলছে না। সবাই সূচিত্রার দিকে তাকিয়ে আছে। সূচিত্রাই মুখ খুললেন। গফুর সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেনÑ আপনাদেরকে অনেক ঝামেলায় ফেললাম।

মিনারা বিনীত ভঙ্গিতে বললেনÑ ছি: ছি: আপনি এসব কি বলছেন? আপনার পায়ের ধুলো আমাদের বাসায় পড়েছে। আমরা ধন্য। একটা কথা বলব.. দিদি…

জ্বি বলেন।

মিনারা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমরা কিন্তু আপনার সিনেমা দেখে দেখে বড় হয়েছি। ও আমাকে বলতো সূচিত্রা, আমি ওকে বলতামÑ উত্তম।

সূচিত্রা একটু হাসলেনÑ এখন পরস্পরকে কি বলেন?

আব্দুল গফুর বললেনÑ এখনও আড়ালে আবডালে উত্তম-সূচিত্রাই বলি।

সূচিত্রা আগের মতোই মৃদু হেসে বললেনÑ আড়ালে আবডালে কেন, কিসের ভয়…

মিনারা ইতস্তত ভঙ্গিতে বললেনÑ বয়স হয়েছে না দিদি। এখন কি আর…

সূচিত্রা আগের মতোই হেসে বললেনÑ ভালোবাসার কোনো বয়স থাকে না। তবে ভালোবাসাকে সব সময় পবিত্র রাখতে হয়।

আবার সারা ঘরে পিন পতন নীরবতা। সবাই সূচিত্রার দিকে তাকিয়ে আছে। এক পর্যায়ে নীরবতা ভাঙলেন আব্দুল গফুর। দিদি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই…

আপনি একজন অভিনেত্রী। আপনার অভিনয় দেখে দর্শক হাসে কাঁদে। অসংখ্য যুবকের কথা জানি যারা শুধু  আপনাকে এক নজর দেখার জন্যই সিনেমা হলে যেত। এটা কীভাবে সম্ভব। কোন শক্তি বলে আপনি সিনেমা হলে দর্শককে টেনে আনতেন।

সূচিত্রা মুখে স্বভাব সুলভ হাসি ছড়িয়ে বললেনÑ শক্তিতো একটাইÑ ভালোবাসা। আপনারা স্বামী-স্ত্রীই তো তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ভালোবেসেই না বিয়ে করেছেন। একটা কথা মনে রাখবেন ভালোবেসে শত্রæকেও বস করা যায়। আর তাই ভালোবাসার চেয়ে বড় শক্তি পৃথিবীতে এখনও কেউ দেখাতে পারে নাই, আবিষ্কারও হয় নাই।

জাহিদ আগ্রহ ভরে সূচিত্রা সেনের কথা শুনছিল। ফিল্মের ওপর পড়াশোনা করে সে। সূচিত্রার একটা ইন্টারভিউ করলে কেমন হয়? কিন্তু কেউ কি বিশ্বাস করতে চাইবে? সূচিত্রা সেনের ইন্টাভিউ করেছিস? গুল মারার আর জায়গা পেলি না বাবা…

বন্ধুরা হয়তো এভাবে টিপ্পনী কাটবে। কাটুক। সুযোগ যখন পাওয়া গেছে তখন ইন্টারভিউটা সেরে ফেলা যাক। সূচিত্রা সেনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলো সে। আমার নাম জাহিদ নেওয়াজ। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্মের ওপর পড়াশোনা করছি।

সূচিত্রা খুশি হয়ে বললেনÑ ফিল্মের ওপর পড়াশোনা করো, গুড, ভেরিগুড। তোমাদের এখানে ফিল্মের অবস্থা কেমন? দর্শক সিনেমা হলে যায়?

জাহিদ মন খারাপ করে বললÑ না, দর্শক সিনেমা হলে তেমন একটা যায় না।

জাহিদের কথা শুনে সূচিত্রা আঁতকে উঠলেনÑ বলো কি! তোমাদের এতবড় একটা ইন্ড্রাস্ট্রি চলে কি করে? তোমাদের রাজ্জাক সাহেব, আলমগীর, কবরী, ববিতা এরা আছেন না?

সবাই আছেন কিন্তু তবুও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না।

কেন হচ্ছে না? নিশ্চয়ই ডেডিকেশনের অভাব আছে। কি করছি। কেন করছি? এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই স্পষ্ট ধারণা নাই। শোনো তোমাকে একটা কথা বলি, তুমি যে কাজই করনা কেন সেই কাজের ওপর শ্রদ্ধা থাকতে হবে। প্রেম থাকতে হবে। কাজটাকে ভালোবাসতে হবে। ধরো তুমি কাউকে ভালোবাসো। সকাল দশটায় তার সঙ্গে পার্কে অথবা কোনো রেস্তোরাঁয় দেখা করবে বলে কথা দিয়েছো। তুমি যদি তার সঙ্গে দশটার পরিবর্তে ১১ টায় দেখা করতে যাও তোমার প্রেম টিকবে? টিকবে না। কাজের ক্ষেত্রটাও তেমনি। সকাল ৮টায় কল টাইম। তুমি পৌঁছালে সকাল ১১ টায়। এই যে ইউনিটের এতগুলো মানুষ তোমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে, তোমার ওপর বিরক্ত হচ্ছে, গালি দিচ্ছে তোমাকে… এতে হবে কি ল²ী পালিয়ে যাবে। ল²ী বোঝোতো… ল²ী মানে সাফল্য… ল²ীর বর পেতে হলে নিয়মিত পূজো দিতে হয়। এই পূজোটাই, প্রেম, এটাই ভালোবাসা। তুমি বোধহয় আমাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাচ্ছ, করো। কঠিন প্রশ্ন করো না।

জাহিদ প্রশ্ন করার জন্য তৈরি হয়ে গেল।

আমার প্রথম প্রশ্নÑ আপনার অভিনীত প্রতিটি ছবিতে ভালোবাসার সুরই প্রাধান্য পেয়েছে। ভালোবাসা আপনার কাছে কি?

সূচিত্রা সেন: এই প্রশ্নের উত্তর আগে একবার দিয়েছি। আবারও বলি, ভালোবাসা আমার কাছে জীবন ধারণের বড় শক্তি। মন ভরে অন্যকে ভালোবাসো। দেখবে তোমাকেও সবাই ভালোবাসবে।

জাহিদ: আপনি মোট ৬২টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। তারমধ্যে ৩০টিরই নায়ক উত্তম কুমার। উত্তম সূচিত্রা জুটির মূল রসায়নটা কি ছিল?

সূচিত্রা: ঐ যে বললাম ভালোবাসা…

জাহিদ: তার মানে আপনারা কি পরস্পরকে ব্যক্তি জীবনেও ভালোবেসেছিলেন?

সূচিত্রা: (প্রশ্ন শুনে মৃদু হাসলেন) এই প্রশ্নেরও জবাব দিতে হবে। হয়তো ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু আমাদের কাছে সবার আগে ছিল সিনেমা। সিনেমার প্রতি ভালোবাসাই ছিল আমাদের কাছে প্রথম প্রায়োরিটি।

জাহিদ: অভিনয় ছেড়ে দেয়ার পর নিজেকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। পরিবারের সদস্য ছাড়া কারও সঙ্গে দেখা করতেন না, কেন?

সূচিত্রা: এই প্রশ্নের উত্তর এর আগে আমি আর কারও কাছে দেইনি। আজ তোমাকে উত্তরটা বলি। সিনেমার নায়ক-নায়িকারা কি করে? দর্শকের মনে একটা বিশ্বাস তৈরি করে। ভালোবাসার শক্তি তৈরি করে। ধরা যাক পর্দায় একজন তুখোর অভিনেতা, তিনি পর্দার অভিনয়ে মানুষকে অসম্ভব রকমের ভালোবাসেন। অথচ ব্যক্তি জীবনে তিনি তার উল্টো, অত্যাচারী, নীতিহীন মানুষ। তুচ্ছ কারণে কাউকে অপমান করতে ছাড়েন না। এই ধরনের মানুষের হয় অভিনয় ছেড়ে দেয়া উচিত না হয় অভিনয়ের জন্য প্রকাশ্য জীবনের একটা পরিবর্তন আনা উচিত। হ্যাঁ, এবার আমার কথা বলি, অভিনয় ছাড়ার পর কেন নিজেকে নির্বাসন দিয়েছিলাম। ঐ যে বললাম ভালোবাসা, দর্শকের প্রতি ভালোবাসার কারণে নিজেকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলাম। দর্শক ভালোবেসেছে ডাগর চোখের, মায়াময় হাসির সূচিত্রা সেনকে। সেখানে ভগ্ন স্বাস্থ্যের সূচিত্রা সেনকে দেখলে দর্শক হোঁচট খাবে। আমি সেটা চাইনি। সেজন্য নিজেকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলাম।

জাহিদ: আপনার ভক্তদের উদ্দেশে কিছু বলবেন।

সূচিত্রা: ভক্তদের উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলার আছে, ভালোবাসার চেয়ে আর কোনো বড় শক্তি নাই। কাজেই প্রিয় জনকে ভালোবাসুন। আর একটা কথা, আমি যেহেতু সিনেমার মানুষ তাই সিনেমাকেও ভালোবাসতে অনুরোধ করবো।

বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে। সূচিত্রা হঠাৎ যেন ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সবার দিকে তাকিয়ে বললেনÑ আমার যাবার সময় হয়েছে। আমি এখন যেতে চাই।

সূচিত্রার কথা শুনে সবাই না-না করে উঠল। মিনারা অনুরোধের ভঙ্গিতে বললেনÑ এই গভীর রাতে আপনার কোথাও যাওয়া হবে না। আব্দুল গফুর বললেনÑ ভোরের আলো ফুটুক তারপর আপনি যেতে চাইলে যাবেন। জাহিদ বললÑ আমরা কি আপনার সঙ্গে একটা সেলফি তুলতে পারি?

সূচিত্রা  বললেনÑ অবশ্যই। জাহিদের মোবাইলে সেলফি তোলা হলো। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। মিনারা মোমবাতির জন্য চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলেন। মোমবাতি পাওয়া যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ এবং মোমবাতি ছাড়াই ঘরের ভেতরের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এটা কি করে সম্ভব? জাদু নাকি! মনে হলো দূর থেকে কেউ একজন বলছেÑ জাদু নয় এটা হলো ভালোবাসার শক্তি। শব্দটা দূর থেকে ইকো হচ্ছে। ভালোবাসা… ভালোবাসা… ভালোবাসা….