Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

বিতর্ক | আবার তোরা মানুষ হ

আনন্দ আলো প্রতিবেদন:

সম্প্রতি সুদূর আমেরিকায় এক অনুষ্ঠানে দেশবরেণ্য চিত্র পরিচালক, নাট্যজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু কথা প্রসঙ্গে প্রয়াত চিত্র পরিচালক খান আতাউর রহমানকে ‘রাজাকার’ বলে অভিহিত করেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংগীত তারকা রুনা লায়লা সম্পর্কেও তিনি একটি মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু সেই মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল না হলেও খান আতাউর রহমান সম্পর্কে করা মন্তব্যটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। সেখানে দেখা যায়, গুণী নির্মাতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেছেন, খান আতা অনেক বড় শিল্পী। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু খান আতা রাজাকার। হ্যাঁ, হ্যাঁ… আমি না হলে খান আতা বাঁচতো না। আমি গৌরব করে বলি, আমি না হলে খান আতা একাত্তরে মারা যায়, ১৬ ডিসেম্বরের পরে। আবার তোরা মানুষ হ এটা নেগেটিভ ছবি। মুক্তিযোদ্ধাদের বলছে আবার তোরা মানুষ হ। আরে তুই মানুষ হ। তুই তো রাজাকার ছিলি।

দেশবরেণ্য মুক্তিযোদ্ধা, চিত্রপরিচালক নাট্যজন নাসির উদ্দিন ইউসুফের এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ঢাকায় চলচ্চিত্র পাড়ায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কিছু দুঃখের কথা বলবো’ শিরোনামে একটি সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিবার। মুক্তিযোদ্ধা, চিত্রনায়ক ফারুক, সোহেল রানা, চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা আমজাদ হোসেন, আজিজুর রহমান, মুশফিকুর গুলজার, সিবি জামানসহ খান আতার পরিবারের পক্ষে রুমানা ইসলাম ও আগুন বক্তব্য রাখেন। সভায় খান আতা সম্পর্কে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু যে বক্তব্য রেখেছেন তা প্রত্যাহার করে নেয়ার আহŸান জানান হয়।

এদিকে নিউইয়র্কে দেয়া বক্তব্যের প্রেক্ষিতে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পৃথকভাবে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। এই বিবৃতিতে তিনি খান আতাকে কেন রাজাকার বলেছেন তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। সার্বিক দৃষ্টিকোন থেকে বিষয়টি এখন দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচিত।

একটা বিষয় বলে নেয়া ভালো যারা মহান ৭১ সালকে গন্ডগোলের বছর বলতে চান আমরা তাদের পক্ষে নই। আবার যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টায় লিপ্ত তাদের প্রতি আমাদের তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করছি।

কথা হচ্ছিল একদল তরুণের সঙ্গে। যারা সবেমাত্র কলেজ পেরিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি। তথ্য প্রযুক্তি তাদের অপার আগ্রহের জায়গা। তাদের কাছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। তারা খুব একটা আগ্রহ দেখাল না। মনে হলো কিছুটা বিরক্ত। হঠাৎ একজন সরাসরি প্রশ্ন করে বসলÑ আপনিই বলেন তো ঘটনাটা কার মতো করে বলব? আমাদের পরিবারে আমার বাবা একভাবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা বলেন, আমার চাচা ঐ একই ঘটনা অন্যভাবে বলেন। আমার দাদার সঙ্গে নানার কথার মিল খুঁজে পাই না। আমি কাকে ফলো করবো? স্কুলের শিক্ষককে? তারাও তো গল্পটা অভিন্ন সুরে বলেন না। আমরা কার কথা শুনবো?

কথায় কথায় ওদেরই আরেকজন প্রায় প্রতিবাদী হয়ে উঠলোÑ এই যে নতুন করে একটা বিতর্ক শুরু হয়েছে খান আতাউর রহমানকে নিয়ে। আমার বাবার হতে ধরে পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে গিয়ে খান আতার জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটা আমি দেখেছি। তারপর থেকে খান আতার আমি ভক্ত হয়ে যাই। একই জায়গায় নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর গেরিলা’ দেখে আমি আবার মুগ্ধ হই। দু’জনই আমার অত্যন্ত প্রিয় চিত্র পরিচালক। হঠাৎ একদিন শুনলাম একজন অন্যজনকে রাজাকার বলছেন। রাজাকার’ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম এবং অবশ্যই একটি ঘৃর্ণিত চরিত্র। আমি এতদিন যাকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত করেছি হঠাৎ শুনি তিনি রাজাকার…

FDCবন্ধুর কথা টেনে নিয়ে আরেক তরুণ বলল, বাস্তব অবস্থা কি জানেন খান আতার বিষয়টিকে ঘিরে আমাদের পরিবারেও ভিন্নমত দেখা দিয়েছে। একদল খান আতার পক্ষে। অন্যদল নাসির উদ্দিন বাচ্চুর পক্ষে। অথচ আমি এই বিভাজনটা চাই না। যে ব্যক্তি মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে জীবন থেকে নেয়া’র মতো দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ অসাধারণ প্রেরণাদায়ী একটি ছবি বানাতে পারেন তিনি কি করে পরবর্তীতে রাজাকার হন এই চিন্তা আমার মাথায় আসে না। ওদেরই আরেক বন্ধু বলল, বাস্তব চিত্রটা কল্পনা করুন তো একবার। আমরা কার কথা শুনবো? নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু শুধু একজন চিত্র পরিচালকই নন তিনি একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাও বটে। জীবন বাজি রেখে দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। তার একাত্তরের যীশু, গেরিলা ছবি দেখে আমরা তরুণেরা মুগ্ধ। পাশাপাশি আমরা কিংবদন্তিতুল্য চিত্রনায়ক ফারুকেরও অন্ধ ভক্ত। ফারুক নিজেও মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। সোহেল রানা আমাদের আরেক কিংবদন্তিতুল্য তারকা। আমজাদ হোসেন শুধু অভিনেতা হিসেবেই নন চলচ্চিত্র পরিচালক ও কথাসাহিত্যিক হিসেবেও খ্যাতিমান। আমরা তো এই গুণীজনদেরকে নিয়েই এগিয়ে যেতে চাই। কিন্তু তারা যখন বিভক্তির কথা বলেন তখন বিভ্রান্তি দূর হয় না। আমরা তরুণেরা তখন হতাশা বোধকরি।

প্রিয় পাঠক, কয়েকজন তরুণের দৃষ্টিভঙ্গিই কোনো বিশেষ সংকটের অথবা বিতর্কের সমাধান দিতে পারে না। এটা সম্ভব নয়। কিন্তু এই তরুণদের বক্তব্যে কি কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি আমরা? অবশ্য এই কথার যুক্তি এই নয় যে, মহান একাত্তরে যারা ভুল করেছেন, দেশের বিরুদ্ধে ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত হয়েছিলেন তাদেরকে মাফ করে দিতে হবে। এত বছর এত পুরনো কথা কেন বাপু। আসো না সব ভুলে সামনে এগিয়ে যাইÑ যারা এ ধরনের মনোভঙ্গি প্রকাশ করেন আমরা তাদের পক্ষে নই। এই দেশে রাজাকারের ক্ষমা নাই। এটাই মূল কথা। কিন্তু খান আতাউর রহমান কি সত্যি সত্যি ‘রাজাকার’ ছিলেন?

ইতিহাস এ ব্যাপারে কি বলে? বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ কর্তৃক প্রকাশিত আমাদের চলচ্চিত্র’ শীর্ষক একটি গ্রন্থে উল্লেখ আছে ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় খান আতা চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতাঙ্গনে প্রচন্ড প্রভাব বিস্তার করেন সুরকার, গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে। গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তিনি আধুনিক গান, দেশের গান, চলচ্চিত্রের গান, প্রেমের গান ও বিদ্রোহের গান লিখে হয়েছেন নন্দিত। ১৯৬৭ সালে খান আতা টিএসসিতে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে লেলিন জন্মশতবার্ষিকীতে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউট মিলনায়তনে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয় খান আতার সার্বিক সহযোগিতায়। মুক্তিযুদ্ধের আগে সৈয়দ হাসান ইমাম, খান আতাসহ অন্যান্যরা ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’ নামে একটি প্রতিবাদী সংগঠন গড়ে তোলেন। খান আতা বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় ঢাকা শহরে গান, কবিতা আবৃত্তি ও নাটক করে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন। ১৯৭১ সালের ১০ মার্চ গণসংগ্রামের সাথে নিজেদের একাত্মতা প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সমবেত হয় বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ। ২৫ মার্চ পাকিস্তান চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় খান আতার নেতৃত্বে সংগঠনে পাকিস্তান নাম বদলে বাংলাদেশ প্রযোজক সমিতি গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষে খান আতার ভূমিকা ছিল আপোষহীন। তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার আহŸান জানিয়ে সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রদান করে খান আতা বিতর্কিত হন।

ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, সেদিন এই বিবৃতিতে খান আতার সাথে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, কবি শামসুর রাহমান, খন্দকার ফারুক আহমেদ, সৈয়দ আব্দুল হাদী, সাবিনা ইয়াসমিন, শহীদুল্লাহ কায়সারসহ আরো অনেকে সই করেছিলেন। কিন্তু তাদের ব্যাপারে কেউ কখনো বিরূপ মন্তব্য করেননি। সে কারনে হঠাৎ করে কেন খান আতার ব্যাপারেই প্রশ্ন তোলা হলো কেউ কেউ এমন প্রশ্নও তুলেছেন?

এদিকে দেশবরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বলেছেন, ২৫শে মার্চের পর দশ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানিরা। ২৬শে মার্চ যখন ঢাকার রাস্তার মানুষের রক্ত শুকায়নি তখন টেলিভিশন বন্ধ ছিল। ২৫শে মার্চ পর্যন্ত আমরা ভিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ টেলিভিশন চালাচ্ছিলাম। ২৭ মার্চ যখন প্রথম টেলিভিশন খুললাম তখন আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম, খান আতা একটা গান লিখে নিয়ে গেছেন। গানটি ছিল সাদায় সবুজ আমার পাকিস্তানি পতাকা’। বাচ্চাদের তিনি গানটি শিখিয়েছিলেন। পরে শুনলাম আর্মিদের জিপে করে বাচ্চাদের তুলে আনা হয়েছিল। এরপর তিনি আমাদের শিল্পীদের ধরে ধরে টেলিভিশনে নিয়ে যান। ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর খান আতা তার বোনের বাড়িতে চিলেকোঠায় লুকিয়ে ছিলেন।

খান আতার একজন সহকারী ছিল আমীর আলী। ২২ তারিখ আমি যখন মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরলাম তখন আমীর আলী একটা মোটর সাইকেল নিয়ে এসে আমাকে বলে, আতা ভাই আপনার খোঁজ করছেন, আপনি চলেন। আমি ওর সঙ্গে গিয়ে দেখি, ফুলবাড়ীয়ার একটি চিলেকোঠায় দরজা লাগিয়ে বসে আছেন আতা ভাই। আমরা যাওয়ার পরে তিনি বললেন, তুমি আমার সম্পর্কে কিছু বলছো না কেন? তোমরা মুক্তিযোদ্ধা। এখন কত কাজ করার আছে। আমি তাকে বললাম, আপনি এখন বের হবেন না। বের হলে কেউ আপনাকে বাঁচাতে পারবে না। কারণ মানুষের অনেক ঘৃণা জন্মেছে আপনার ওপর। তারপর প্রায় চারমাস লুকিয়ে থেকে পরিস্থিতি যখন ঠাÐা হয় তখন তিনি বের হন।’’

হাসান ইমাম আরো বলেন, ১৫ আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় তখন তিনি কাকরাইল মোড়ে শ্যাম্পেইন খুলে সেলিব্রেট করেন। সেদিন ১১:৩০টার দিকে রেডিওতে তিনি একটি গান নিয়ে যান- আঁধারের সীমানা পেড়িয়ে আজ এসেছি সীমানায়’। গানটি শিল্পীদের দিয়ে রেকর্ডিং করিয়ে রেডিওতে প্রচার করা হয়েছিল। পাকিস্তানের সঙ্গে কোলাবরেট করেছেন কারা এই তালিকায় খান আতার নাম এক নাম্বারে।’

দেশ স্বাধীনের পর আবার তোরা মানুষ হ নামে খান আতাউর রহমান একটি ছবি নির্মাণ করেছিলেন। যুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি ছবিটিতে তুলে ধরা হয়। যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধারাই ছিলেন এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র। ছবির নাম আবার তোরা মানুষ হ’। স্বভাবতই মনে হতে পারে খান আতা এই ছবির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আবার মানুষ হতে জ্ঞান দিয়েছেন? ছবিটির মূল সুর কি তাই? বিতর্ক যখন উঠেছে তখন বিতর্কের একটি সুষ্ঠু সমাধানও জরুরি।

আপনি কোন অধিকারে তাকে রাজাকার বলছেন?

ফারুক, অভিনেতা

Farukকিছু দুঃখের কথা বলবো, শীর্ষক চলচ্চিত্র পরিবার আয়োজিত যৌথ সভায় মুক্তিযোদ্ধা ও চিত্রনায়ক ফারুক বলেছেন, ১৯৭৩ সালে খান আতা পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’ সিনেমাটি মুক্তি পায়। ১১ জন সেক্টর কমান্ডার আর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে এই সিনেমাটি দেখেছেন। স্বাধীনতার পক্ষের সরকার এই সিনেমার ছাড়পত্র দিয়েছে উল্লেখ করে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর উদ্দেশে ফারুক বলেন, আপনি কে, এই সিনেমাটিকে নেগেটিভ বলছেন? আপনি স্বাধীনতার পক্ষের সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। আমরা স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ এটা মানতে পারি না। আমরা এর বিচার চাই। এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ফারুক। কাঁদতে কাঁদতেই বলেন, আপনি কোন অধিকারে খান আতাকে রাজাকার বলছেন? রাজাকার কারা? আমরা জানি, রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাড়ি বাড়ি আগুন দিয়েছে। আমরা বর্তমান সরকারের কাছে বিচার চাই। কারণ ১৯৭৩ সালে এই সরকারই ক্ষমতায় ছিল।

বাচ্চু তুমি তো আমার ভাই…

আমজাদ হোসেন, চলচ্চিত্র পরিচালক

Amjad-Hossainসভায় গুণী পরিচালক আমজাদ হোসেনও কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু তুমি তো আমার ভাই। একজন মুক্তিযোদ্ধা। কেন এই ঢিলটা মারলে। দশ বছর আগে আতা ভাই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। তোমাদের তো কোনো ক্ষতি করেননি তিনি। এত বছর পর তাকে নিয়ে কেন এমন কথা বললে? আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গনে ঢোকার আগে এমন মন্তব্যের জন্য বাংলার মানুষের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। আমজাদ হোসেন আরো বলেন, আমরা চলচ্চিত্রকে ভালোবাসি। চলচ্চিত্রের মানুষকেও ভালোবাসি। কাজেই কারো ব্যাপারে অহেতুক নেতিবাচক মন্তব্য তো সহ্য করা যায় না।

আমি চাই ভিডিওটি আরও বেশি মানুষ দেখুক

আগুন

Agunপ্রখ্যাত অভিনেতা, সংগীত পরিচালক, গীতিকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার প্রয়াত খান আতাউর রহমানকে রাজকার বলে মন্তব্য করেছেন নাট্যব্যক্তিত্ব, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। আর সেই মন্তব্যের ভিডিও অনলাইন দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে গেছে।

সম্পতি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, খান আতা অনেক বড় শিল্পী। কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু খান আতা রাজাকার। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি না হলে খান আতা বাঁচত না। আমি গৌরব করে বলি, আমি না হলে খান আতা একাত্তরে মারা যায়, ১৬ ডিসেম্বরের পরে। ‘আবার তোরা মানুষ হ’ এটা নেগেটিভ ছবি। মুক্তিযোদ্ধাদের বলছে আবার তোরা মানুষ হ। আরে তুই মানুষ হ। তাই না! তুই তো রাজাকার ছিলি।”

তার এমন মন্তব্যে অনলাইন দুনিয়ায় ভক্তদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কোনো অনুষ্ঠানে সবার সামনে প্রয়াত সংস্কৃতি ব্যক্তিত্বকে নিয়ে এমন মন্তব্য কতটা যৌক্তিক তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে অনেকের মধ্যে। আবার কেউ-কেউ বাচ্চুর মন্তব্য সমর্থনও করেছেন।

খান আতাউর রহমানকে ‘রাজকার’ বলা প্রসঙ্গে তার পুত্র জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আগুন সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘বিশিষ্ট্য নাট্যব্যক্তিত্ব এবং আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু সাহেব আমার বাবা খান আতাউর রহমান সম্পর্কে কি যেন বলেছেন নিউইয়র্কের কোনো একটি অনুষ্ঠানে। আমি মনে প্রাণে চাইবো সেই ভিডিও ক্লিপটি ভার্চুয়াল মিডিয়ায় মাধ্যমে সারা পৃথিবীর বাংলাভাষাভাষীদের কাছে পৌঁছে যাক।’

আগুন বলেন, ‘যেহেতু আমার বাবা জনগণের কাছের একজন মানুষ, সেক্ষেত্রে তাদের প্রতিক্রিয়া জানার পরে প্রয়োজনে আমি প্রেস কনফারেন্স করবো এবং সঙ্গে থাকবে ভার্চুয়াল মিডিয়া। আমার কাছে সদুত্তর আছে। বাচ্চু সাহেবের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রতি আমার প্রাণঢালা অভিনন্দন।’

মুক্তিযুদ্ধকালে তার ভূমিকার সমালোচনা তো করতেই পারি

নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক

Nasir-uddin-usof-Baccoযুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেছেন, খান আতাউর রহমান একজন সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন। কিন্তু একাত্তরে তিনি পাকিস্তানের সমর্থক’ ছিলেন; দেশ ও মানুষের পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছিলেন’। ব্যক্তিগতভাবে তার বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নাই। শিল্পী হিসাবে তার প্রশংসা করি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালে তার ভূমিকার সমালোচনা তো করতেই পারি।”

খান আতাকে নিয়ে তার বক্তব্যকে ঘিরে ফেইসবুক ও অনলাইনে সংবাদ মাধ্যমে যে অহেতুক বিতর্ক’ চলছে, তার অবসান ঘটাতেই তিনি একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সংগীত পরিচালক খান আতাউর রহমান ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে অপারগ হয়েছিলেন। যে ৫৫ জন বুদ্ধিজিবী ও শিল্পী ১৯৭১ -এর ১৭ মে মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামী লীগের চরমপন্থিদের কাজ’ বলে নিন্দাসূচক বিবৃতি দিয়েছিলেন, দুঃখজনকভাবে খান আতাউর রহমান তার ৯ নম্বর স্বাক্ষরদাতা ছিলেন। ১৭ মে ১৯৭১ দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকা দ্রষ্টব্য।”

নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার চালাতে যারা বাধা দিয়েছিল, যারা পাকিস্তানপন্থি প্রচারে সহযোগিতা করেছিল, তাদের শনাক্ত করতে বাংলাদেশ সরকার শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক নীলিমা ইব্রাহীমকে প্রধান করে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করেছিল।

১৯৭২ এর ১৩ মে নীলিমা ইব্রাহীম কমিটি যে তালিকা সরকারকে পেশ করেন, সে তালিকায় ৩৫ নম্বর নামটি খান আতাউর রহমানের।”

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, খান আতা যে একজন গুণী শিল্পী, তা অনস্বীকার্য’। তার সৃষ্টিশীলতা নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই’। মুক্তিযুদ্ধের আগে তার অনেক সিনেমা মানুষকে উজ্জীবিত করেছে ।

“কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন এবং তা তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। আবার আলতাফ মাহমুদ, জহির রায়হান, শহীদুল্লাহ কায়সারের মতো শিল্পী-সাহিত্যিকরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাদের স্বীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এবং শাহাদাত বরণ করেছেন।

“অনেকের মনে প্রশ্ন উদ্রেক হয়েছে যে, ৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর অব্যাহতিতে কেন আমি বা আমরা তাকে রক্ষা করেছিলাম। কারণ খান আতাউর রহমান কোনো প্রকার মানবতাবিরোধী কর্মে লিপ্ত ছিলেন না; যদিও পাকিস্তানিদের সমর্থনে রেডিও-টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করেছেন।”

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আমরা এও ভেবেছি, ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, অনেকে পাকিস্তানিদের পক্ষাবলম্বন করেছে। আমরা তা বিচারের এখতিয়ার রাখি না।

“তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের এ কথা বাধ্যতামূলক মানতে হয়েছিল যে, কোনো অবস্থাতেই যুদ্ধোত্তর সময়ে কারো ক্ষতি বা আঘাত করা যাবে না। বিচারিক প্রক্রিয়ায় দোষী সাব্যস্তদের বিচার করা হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে। মুক্তিযোদ্ধারা সেই আদেশ পুরোপুরিভাবে মেনেছিল বিধায় যুদ্ধোত্তরকালে প্রাণহানির ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কম হয়েছিল।”

মুক্তিযোদ্ধারা জেনেভা কনভেনশন পুরোপুরি মানলেও পাকিস্তানিরা জেনেভা কনভেনশনের তোয়াক্কা করেনি বলে মন্তব্য করেন বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। বিবৃতিতে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, ইতিহাসের দায় থেকে আমি খান আতাউর রহমান সম্পর্কে উক্তিটি করেছিলাম। আশা করি আমার এ বক্তব্য সকল তর্ক-বিতর্কের অবসান ঘটাবে।”