Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

তারকাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু ফেসবুক ফ্যানপেজে আটকে গ্যাছে

তানভীর তারেক: দিনকে দিন আমাদের সামাজিক মর্যাদা’র অবক্ষয় হচ্ছে। আগে বুদ্ধিজীবী, কবি সাহিত্যিকদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি করা হতো । এখন প্রধান অতিথি করা হয় সমাজের সবচেয়ে শর্টকার্টে বড়লোক হওয়া অবৈধ মুনাফা ভোগীদের।

আগে সাহিত্য আড্ডা হতো… কিংবা তরুণদের ওপেন এয়ার কনসার্ট, এখন টিকেট কেটে মোটিভেশনাল স্পিচ এর কর্পোরেট ব্যবসা রমরমা।

সম্পর্কিত

তারকার ফেসবুক

তারকার ফেসবুক

মাত্র বছর কয়েক আগেও নির্মোহ আলোকিত মানুষ, সাদা মনের মানুষ খুঁজে তাদের পুরস্কার দেয়া হতো।

এখন শর্টকার্ট ডিজিটাল স্পিকার, যারা ডিজিটাল পীরদের মতো করে চটকদার কথা বলে… বিভিন্ন ডিজিটাল প্লাটফর্ম এ ব্যবসা করছে। তাদেরকে প্রমোট করছে কর্পোরেট উচ্চ পদস্থ সংস্থারা!

অথচ!

গ্রামের অগণিত নির্মোহ শিক্ষকরা আজো কত ছেলে-মেয়েদের আলোকিত করছে… সেখানে আলো ফেলছে না কর্পোরেট চাষীরা। কারণ তাদের ডিজিটাল ফলোয়ার নেই!

সামাজিক মর্যাদার এই ডাইভারশন আমাদের সন্তানদের কী শিক্ষা দেবে…?

নিজের কোনো অর্জন নেই। তবু মোটিভেশন স্পিকাররা সেটাকে চটকদার বাচনভঙ্গিতে বলছে

“কী করে আমি কিছু না জেনেও ঐ মিটিংটা সাকসেস করে এলাম”

এইসব চোরামি বুদ্ধি শুনে তরুণরা এসমার্ট হবার বাটপারি উপায় শিখছে।

অথবা এসব ডিজিটাল পীরদের বয়ান মাহফিলে এমন বালখিল্য কথাবার্তার চাষাবাদ হয়, শুনলে ভ্রম হয়…! যেন ছেলে-মেয়েরা তাদের পরিবার থেকে কিছু শিখে আসে নাই…!

এসব ডিজিটাল পীরদের অন্ধ মুরিদ অনেক.. যত মুরিদ তত স্পন্সর। অনেকে নিজের এসব বয়ান ভিডিও আপলোড করে.. নিজেই ক্রেডিট কার্ড ঘষে বুস্ট মেরে দিচ্ছে…

আহা! ডিজিটাল পীরবাবা এ কী বললেন…! দেখুন ভিডিওসহ…!

আমরাই এসব ডিজিটাল পীরদের ক্রমান্বয়ে মাথায় তুলছি । আগে শহরে শহরে টাকা খরচা করে ওয়াজ চলতো। এখন চলে ডিজিটাল পীরদের বয়ান।

কী করে এসমার্ট হবেন। ফরমুলা একটাই… বাণিজ্য।

“হাউ টু আর্ন মানি!” হ্যাশট্যাগটা নাকি বাজারে খুউব খাচ্ছে…!

ডিজিটাল মশলাদার এসব কথার বাণিজ্যে আজকাল যে আর স্পন্সরদের অভাব হয় না!

অথচ গ্রামের শিক্ষক, নির্মোহ পরোপকারী (যারা প্রকৃত মোটিভেটর) তারা নিজেদের স্বপ্ন বুনতে পয়সা পান না!

আমিও ডিজিটাল ভিডিও আপ করার জন্য কিছু বাংরেজী বলার প্র্যাকটিস করছি। মেকআপ বক্স, লিপস্টিকও কিনে নিয়েছি… এগুলো ভিডিও করতে আবার একটু লাল্টু ভুল্টু না সাজলে নাকি ভিউ বাড়ে না…!

ওপরের এসব কথা আমি কয়েকবার ফেসবুকে রিপোস্ট করেছি। তাতে বেশ কিছু তরুণ, এমনকি শোবিজের অনেকেই সহমত জানালেও কিছু তরুণ ইনবক্সে হুমকিও দিলেন। আপনি এতসব লেখার কামকি। গানবাজনা করছেন, সেইটা করেন না। আপনার গানেরও তো দেখি তেমন ভিউ নাই। আমরা হেল্প করলে আপনার গানেরও ভিউ বাড়ায়ে দেবো অনায়াসেই!

আমি ভয় পেয়ে যাই। এটা খুবই সত্য কথা যে ইউটিউব ভিউ বা বিভিন্ন ডিজিটাল অ্যাপস-এর সাবস্ক্রাইবার বাড়ানোর যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, তাতে মূল শিল্পীরা এখন অনেকেই পিছিয়ে থাকবেন। কারণ তাদের তো ফেসবুক ফ্যান পেজের ফলোয়ার নেই।

২০১৮ হবে মূলত নাটক-গান বা সিনেমার মানুষদের এইসব ফ্যান ফলোয়ার ব্যবসা বৃদ্ধির বছর। সেটারই উচ্চলম্ফ চলছে। আজকের লেখাই এই ডিজিটাল মোটিভেটরদের কথা বলছি কারণ একসময় একটি প্রচলিত তর্ক ছিল যে মঞ্চের বাইরে, বিভিন্ন চেহারা সর্বস্ব ছেলে-মেয়েদের কেন একাধিক নির্মাতারা কস্টিং করছেন। কারণ তাদের মঞ্চে যে কর্মী ৭/৮ বছর নির্মোহ শ্রম দিয়ে গেলেন , সে তো হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে!

অথচ টিভি খুললেই এখন বিভিন্ন সো কলড পপুলার ইউটিউবারদের ভিড়। তাহলে আমরা কাদের প্রমোট করছি। কোনো কিছু না জানলেও আমাদের ফ্যান পেজের ফলোয়ার থাকলেও চলবে!

এটা একটা ভয়ঙ্কর দিকে রূপ নিচ্ছে কারণ, সমাজের সবচেয়ে গুণী মানুষটি, যার কথা শুনলে আমরা আলোকিত হবো, তিনি কিন্তু ডিজিটাল প্লাটফর্মে নেই! কিংবা থাকলেও তিনি অনেক পরে হয়তো ফেসবুক বা ইউটিউব অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। কিন্তু তার আগেই তো ইন্ডাস্ট্রিতে সয়লাব হয়ে আছে এসব না জানা চটকতার তরুণেরা। সংকট টা এখানেই তৈরি হচ্ছে।

একই সাথে স্পন্সর বা বাণিজ্যের সাথেও এটি সহায়কভাবে সম্পৃক্ত।  ফলে দ্ব›দ্বটা আরো বেশি মাত্রায় বেড়ে চলেছে। শোবিজে এর প্রভাবটা প্রকট। আমরা নিয়ম মেনে বা নিয়মের বাইরে চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে যৌথ প্রযোজনার যে মিশেল ককটেল বাণিজ্য শুরু করেছি তা হয়তো অনেকের কাছেই প্রাসঙ্গিক অনেকের কাছে না।

কিন্তু একজন গৌতম ঘোষকে নিয়ে এনে দুই বাংলার চলচ্চিত্র শিল্পীদের দিয়ে ছবি করালে তার যে সামাজিক মর্যাদা তৈরি হয়, চটকদার বাণিজ্যের স্বার্থে শুধুই বাণিজ্য করলে কিন্তু সেই শিল্পীর ব্্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি হয় না। আমি শুধু গৌতম ঘোষের বিষয়টিই হয়তো বললাম। কিন্তু এমন অনেক রকম কোলাবরেশন করে বাংলাদেশি শিল্পীদের ব্র্যান্ড ইমেজ বাড়ানো সম্ভব। নয়তো যে অভিনয় জানে না। জানে শুধু আলগা ঢং তাকে আমরা যৌথ বাণিজ্যের চলচ্চিত্রের বারবার রিপ্রেজেন্ট করে বাংলাদেশকে ঐ ক্যাটাগরিতেই বন্দি রাখছি। যেন ঐরকম না জানা  ছেলে-মেয়েগুলোই বাংলাদেশের শিল্পীর মাপকাঠি।

যে নব্বই দশকেও একাধিক মডেল, কণ্ঠশিল্পী, চলচ্চিত্র তারকা ছিল যাদের কাভার শুটের শিডিউল কোনো ম্যাগাজিন পেলে, সেই সংখ্যার বাড়তি কাটতি হতো। একে বলা হয় ‘সেলিব্রিটি ক্রেজ’।

কিন্তু এই সেলিব্রিটি ক্রেজ এখন অ্যাভারেজেরও নিচে অবস্থান করছে। ক্রিকেট প্লেয়ারদের আজকের যে ক্রেজী অবস্থান, একসময় সেই বালিঘড়ি ছিল শোবিজে। আমাদের এই কালচারাল ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি করার জন্য প্রয়োজন সঠিক আর্টিস্ট ম্যানেজমেন্ট। যারা শোবিজে সত্যিকার অর্থেই মেধাবী, মোটিভেটর তাদেরকে ডিজিটাল প্লাটফর্মে আনতে হবে। আনাতে হবে।

লেখক: সংগীত পরিচালক, উপস্থাপক ও সংবাদকর্মী