Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

গহীন বালুচর আমাদের ব্যক্তি জীবনকেও অনেক কাছে এনেছে

গুণী অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা ও নির্মাতা বদরুল আনাম সৌদ জুটির প্রথম সিনেমা গহীন বালুচর সারাদেশে মুক্তি পেয়েছে। ছবিটির নির্মাণ ভাবনা, শোবিজের বর্তমান চিত্র সহ নানা বিষয়ে তারা যৌথভাবে কথা বলেছেন একটি অন লাইন মিডিয়ায়। তারই চুম্বক অংশ আনন্দ আলোর পাঠকদের জন্য।

প্রশ্ন: গহীন বালুচর নির্মাণ-এর গল্পটা কেমন?

সৌদ: অনুদান প্রাপ্তির পরই মূলত গহীন বালুচর নির্মাণ নিয়ে আমাদের সংগ্রাম শুরু হয়। যখন আমরা পার্টনার খুঁজছিলাম তখন যুক্ত হয় ফ্রেন্ডস মুভিস ইন্টারন্যাশনাল। মিডিয়া পার্টনার হিসেবে যোগ দেয় দীপ্ত টিভি। কিন্তু তাদের আর্থিক সহায়তায় গহীন বালুচর নির্মাণ করা সহজ ছিল না। পরে আমাদের ‘সাতকাহন’ সহ নানান জনের সহায়তায় অর্থের সংকুলান করে গহীন বালুচর নির্মাণ করি।

প্রশ্ন: দু’জনের কেমিস্ট্রি কেমন ছিল?

সৌদ: (মৃদু হেসে) আমাদের দু’জনের  সংসার জীবনের ১০ বছর তো হয়ে গেল। শুধু গহীন বালুচর তো প্রসঙ্গ নয়। লাইফের কেমিস্ট্রি… সবকিছু মিলে বেশ ভালোই যাচ্ছে…।

সুবর্ণা: জীবনে চড়াই-উৎরাই থাকে। গহীন বালুচর-এর কারণে বোধকরি লাইফের জার্নিটা বেটার হয়েছে।

সৌদ: একটা ফিল্ম কখনও একক প্রচেষ্টায় হয় না। ফিল্মে টিম ওয়ার্ক লাগে। সেই টিমে আমার সবচেয়ে বড় সহযোগী অথবা সঙ্গী হিসেবে যার নাম আসবে সে সুবর্ণা। গহীন বালুচর করার সময় সবচেয়ে ভালো এবং সবচেয়ে খারাপ মুহূর্তের সঙ্গী ছিল সুবর্ণা। সব সময়ই সুবর্ণা পাশে ছিল। গহীন বালুচর আমাদের ব্যক্তি জীবনকেও অনেক কাছে টেনে এনেছে। একধরনের বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে আরও একটু বেশি করে চেনার সুযোগ হয়েছে এই জার্নিটার ফলে।

সুবর্ণা মুস্তাফা: অনেকগুলো টেলিভিশন প্রোডাকশন আছে আমাদের। ধারাবাহিক, টেলিফিল্ম, একঘণ্টার নাটক মিলিয়ে অনেক কাজ করেছি আমরা। কিন্তু ফিল্মের এক্সপেরিয়েন্সটা সম্পূর্ণ আলাদা। দীর্ঘ সময় ধরে অসীম ধৈর্য নিয়ে আমাদেরকে কাজটা করতে হয়েছে। কখনও কষ্টের নদী সাঁতরেছি, আবার কখনও ভালো সময় গেছে। দু’জনে সমানভাবে সবকিছু মোকাবিলা করেছি।

প্রশ্ন: সৌদের প্রথম সিনেমা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। এ ব্যাপারে মন্তব্য কি?

সৌদ: আমি সচরাচর, খুব একটা ভোকাল না। এত বছর ধরে যারা আমাকে দেখে আসছে তারা আমাকে ভালো ভাবে চিনে এবং জানে। আমি বেশ স্পষ্ট করেই বলছিÑ চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্দেশে নির্মিত আমার প্রথম চলচ্চিত্রের নামই গহীন বালুচর।

প্রশ্ন: গহীন বালুচর নিয়ে কী রকম আবেগ কাজ করছে?

সুবর্ণা মুস্তাফা: একথা এখন সবাই জানে যে এটি একটি চলচ্চিত্র… এটি একটি মূলধারার চলচ্চিত্র… এবং এটি একটি সুনির্মিত চলচ্চিত্র। হল মালিক থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শকদেরও মন্তব্যÑ ২০১৭ সালের এটি একটি ভালো চলচ্চিত্র। যশোরের রাণী মহল নামে একটি সিনেমা হলের কথা বলি। ওই হলে সাধারণ দর্শক সারীতে বসে আমরা ছবিটা দেখেছি… তারা খুব আনন্দের সঙ্গে ছবিটা দেখেছে।

সৌদ: দর্শক তখনও আমাদের পরিচয় জানতে পারেননি…

সুবর্ণা মুস্তাফা: আমরা অনেক এলিট দর্শকের সঙ্গে বসেও ছবিটা দেখেছি। আমার অভিজ্ঞতা প্রতিটি জায়গায় একই ধরনের ছিল। দর্শক ছবিটিকে অত্যন্ত সাদরে গ্রহণ করেছেন। ছবি শেষে কেউ কেঁদেছেন। অনেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে তাদের অনুভ‚তি ব্যক্ত করেছেন। কাজেই এটি যে সুনির্মিত চলচ্চিত্র তাতে কোনো সন্দেহ নাই। আমরা দর্শকদের কাছে কৃতজ্ঞ।

প্রশ্ন: গহীন বালুচর আসলে কোন ধরনের চলচ্চিত্র?

সৌদ: গহীন বালুচর একদম সাধারণ মানুষের জন্য মেইনস্ট্রিম ফিল্ম। মেইনস্ট্রিম ফিল্মের কিছু ফর্মুলা থাকে। সেই ফর্মুলার ভেতরে গহীন বালুচরকে সহজেই অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। যেখানে আমরা নাটকীয়তা আছে, গান আছে, নাচ আছে, দর্শককে স্পর্শ করার মতো আরও অনেক এলিমেন্ট আছে। গহীন বালুচর সুনির্মিত ফিল্ম কিনা জানি না। এটা বিচার করবেন দর্শক। দর্শক ভালো বললে তবেই ভালো। খারাপ বললে তবেই খারাপ। তবে গভীর ভালোবাসা দিয়েই আমরা ছবিটি বানিয়েছি।

সুবর্ণা মুস্তাফা: এক্ষেত্রে আমার কিছু কথা আছে। সব ছবিই কমার্শিয়াল ছবি। সবচেয়ে দুর্বোধ্য যে ছবিটা কেউ বানায় সেও চায় তার ছবিটা ব্যবসা করুক। আমার কাছে ছবির সংজ্ঞা হলো দুই ধরনের। গুড মুভি আর ব্যাড মুভি। আমি যখন ‘অজ্ঞাতনামা’ দেখি ইট ইজ এ গুড মুভি… আমি যখন আয়নাবাজি দেখি, ইট ইজ এ গুড মুভি… ঢাকা অ্যাটাকও গুড মুভি… কিন্তু আমি যখন না শিল্প না বাণিজ্য… ছবিই বুঝলাম না, ঘুম এসে গেল… দ্যাট ইজ এ ব্যাড মুভি… নো ম্যাটার কে সেটাকে বানিয়েছে, সেখানে কারা অভিনয় করেছে… তাছাড়া ছবি যদি ব্যবসাই না করে তাহলে ছবি বানানোর অর্থ কি? যে যাই বলুক টাকার জন্যই তো কাজ করা। মেইনস্ট্রিম সিনেমা যদি না দাঁড়ায় তাহলে অলটারনেটিভ সিনেমার তো জায়গাই থাকে না।

প্রশ্ন: সুবর্ণার প্রতি প্রশ্ন, কোনো বিশেষ চরিত্রে কাজ করতে না পারার আক্ষেপ আছে কি না?

সুবর্ণা মুস্তাফা: অল্পবয়সে বিচিত্র সব চরিত্রে অভিনয় করেছি। নতুন বউ সিনেমার কাজ করেছি। নয়নের আলো করেছি। আমার চরিত্র ছিল নয়ন। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক মতিন রহমান আমার সম্পর্কে একটা কথা বলেছিলেন। তখন বুঝিনি। পরে অনুধাবন করলাম যে, আমি একমাত্র অভিনেত্রী যে কি না মূলধারার চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রেও সমান তালে কাজ করেছি। গুড্ডি, সুরুয মিয়া, দুরত্ব, লাল সবুজের পালার মতো নান্দনিক ধারার চলচ্চিত্রের পাশাপাশি অসংখ্য বাণিজ্যিক ধারার ছবিতেও অভিনয় করেছি। চরিত্র নিয়ে আমার কোনো অতৃপ্তি নাই। আই অ্যাম ভেরি মাচ হ্যাপি… বাংলাদেশের মতো একটি দেশে শুধুমাত্র অভিনয় করে আমি আমার জীবিকা নির্বাহ করছি। আমি সেই কাজটি করি যে কাজ করতে আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দ। এটা করবো, সেটা করবো এ ধরনের অনেক বড় উচ্চাঙ্গা আমার কোনোদিনই ছিল না। হ্যাঁ, কিছু ক্যারেক্টার মাঝে মাঝেই আমার কাছে ভর করে। রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগের ‘কুমু’ চরিত্রে অভিনয় করতে পারলে ভালো লাগত। আমার একটা ড্রিম ক্যারেক্টার আছে। সেটা হলো সাহেব বিবি গোলাম উপন্যাসের মেজবউ। আমার খুবই পছন্দের চরিত্র। আমার জীবন নিয়ে কোনো কমপ্লেইন নাই। জীবন যে ভাবে যাচ্ছে তাতে আই অ্যাম হ্যাপি…

প্রশ্ন: ছোট পর্দায় কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন কি না?

সুবর্ণা মুস্তাফা: আমি আগে থেকে স্ক্রীপ্ট না পেলে কাজ করতে পছন্দ করি না। প্রসঙ্গক্রমে একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। আমাদের দেশে এই যে এতগুলো প্রাইভেট টিভি চ্যানেল, সেটাও যদি সুপরিকল্পিত ভাবে হতো… ভালো করে লক্ষ্য করলেই দেখবেন সব চ্যানেলে একই সময়ই খবর প্রচার হয় এবং সব খবরই একই রকম। শুধুমাত্র সংবাদপাঠক অথবা পাঠিকার চেহারাটা আলাদা হয়। সব টিভি চ্যানেলে একই সময়ে টক শো প্রচার হয়। আর নাটক তো হয়েই যাচ্ছে… হয়েই যাচ্ছে… টেলিভিশন কি সব সময় বিনোদন দিয়েই যাবে নাকি সমাজ উন্নয়নমূলক খবরও প্রচার করবে এ ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন আছে। আমাদের টেলিভিশন দর্শক হারাচ্ছে তার অন্যতম কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন প্রচার। দেশের কোনো একটি টেলিভিশনের অনুষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে শুরু হয় না। আর ঈদের অনুষ্ঠানের তো কোনো ঠিক ঠিকানাই থাকে না। ঈদের কোনো অনুষ্ঠান দেখতে বসলে হয়তো দিন রাত পার হয়ে যাবে… বিজ্ঞাপন দেখবো নাকি অনুষ্ঠান দেখবো… টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান সময়টা নিয়ে আমি খুব শংকিত। আমাদের টেলিভিশন চ্যানেল সমূহে কনটেন্ট বেশ পুত্তর। হেলদি কনটেন্ট না বাড়ালে দর্শক ফিরে আসবে না। আমাদের টেলিভিশনে হাসির নাটকের নামে যা হচ্ছে তা সত্যি বিব্রতকর। যদিও আমাদের  পরিচিত তারকারাই এটা করছে। হাসির নাটকের একটা মানদÐ ঠিক করা দরকার। আমাদের দেশে কিন্তু হাসির নাটকের একটা মানদÐ ঠিক করা আছে। আমরা আজ রোববার, এলেবেলে, বহুব্রিহী দেখে ফেলেছি। এই ধরনের হাসির নাটক থেকেও তো আমাদের শিক্ষা নেওয়ার আছে। আর একটা কথা বলি। ইদানিং এজেন্সি টিভি নাটকের মানদÐ ঠিক করে দেয়। অমুক তমুককে দিয়ে নাটক বানানোর কথা বলে। এজেন্সির এই মনোভাব দূর করতে হবে। তা নাহলে টিভি নাটকের মানের কখনও উন্নতি হবে না। ফেসবুক ফলোয়ার দেখে নাটকে কাস্ট করলে কাজের কাজ কিছুই হবে না।

সৌদ: পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে পিকিউলিয়ার মনে হয়। কোনটা ঠিক করলে কোনটার সমাধান হবে আমি নিশ্চিত না। কখনও কখনও মন খারাপ হয়। ১৭ বছর ধরে মিডিয়ায় কাজ করছি। ১৭ বছর আগে ১০০ টাকার যে কাজটি করা যেতো এখন তার জন্য লাগে ৩০০ টাকা। অথচ যে নাটকটির দাম তখন ১০০ টাকা ছিল সেটি তখন ৬০/৭০ টাকায় বানাতে বলে। তাহলে নাটকের মান কীভাবে ভালো হবে তা আমি নিশ্চিত নই। এর একটা সুষ্ঠু সমাধানের পথ খোঁজা প্রয়োজন। নানা কারণে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো দর্শক হারাচ্ছে। এক্ষেত্রে বিদেশি টিভি চ্যানেলের প্রভাব মোটেই দায়ী নয়। আমরা নিজেরা তৈরি নই বলে দর্শক হারাচ্ছি। এই উপলব্দি যতক্ষণ না গুরুত্ব পাবে ততক্ষণ আমাদের টিভি অনুষ্ঠানের মান কমতেই থাকবে।