Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

কৃষকের কাছে প্রযুক্তি পৌঁছে দেয়াই এই মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ

-ড. এফ এইচ আনসারী

নির্বাহী পরিচালক, এসিআই এগ্রিবিজনেস ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এসিআই মোটরস লিঃ

ড. এফ এইচ আনসারী স্বনামধন্য কৃষি উন্নয়ন ব্যক্তিত্ব। দেশে-বিদেশে কৃষি উন্নয়ন, গবেষণা, বিক্রয়, বিপণন ও বহুজাতিকরণে নিরলস কাজ করছেন তিনি। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় থেকে ¯œাতকোত্তর এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে পেশাগত জীবনে কাজ করেছেন অনেকগুলো দেশি-বিদেশি কোম্পানিতে। বর্তমানে তিনি এসিআই এগ্রিবিজনেস-এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করছেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজু আলীম।

আনন্দ আলো: ড. আনসারী আপনি কাজ করেন কৃষিখাত নিয়ে। বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এই দেশের ৬৫ ভাগ মানুষ এখনো কৃষির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই দেশের লাইফ লাইনই আসলে কৃষি। এক্ষেত্রে আপনাদের সার্ভিস বা প্রোডাক্টের অবস্থান কোথায়?

ড. এফএইচ আনসারী: আপনি ঠিকই বলেছেন এই দেশের ৬৫-৭০ ভাগ মানুষ  গ্রামে বাস করে । এর মানে এই সব মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত। ৪৫ ভাগ লোক সরাসরিভাবে কৃষিখাতের সঙ্গে কাজ করেন। খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো- এই দেশের অর্থনীতিতে আজ থেকে ৫-৬ বছর আগেও জিডিপিতে ১৯/২০ পারসেন্ট কন্ট্রিবিউট করতো।

আনন্দ আলো: আর বর্তমানে কি অবস্থায় আছে?

ড. এফএইচ আনসারী: বর্তমানে এটি কমতে কমতে সাড়ে পনেরতে চলে এসেছে। অর্থাৎ ভলিউম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার পোর্শনটা কমে যাচ্ছে। তার পেছনে কারণটা হলো এই-

আনন্দ আলো: জিডিপি বড় হচ্ছে এর সঙ্গে অংশটা কমে যাচ্ছে?

ড. এফএইচ আনসারী: একদম ঠিক। সঙ্গে সঙ্গে আমরা প্রোডাক্ট অব এগ্রিকালচার যে কথাটা আমরা বলি, যেটা নিয়ে কৃষি অর্থনীতিতে আমরা দাপিয়ে চলতে পারি- সেই অংশে খুব বেশি কিন্তু আমরা কন্ট্রিবিউট করতে পারিনি। কৃষি ব্যবসার তিনটি পার্ট আছে- একটা হলো ইনপুটের পার্ট অর্থাৎ সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি, পশু খাদ্য ওষুধপত্র, নিউট্রিশনসহ এইসব ব্যবসা। আরেকটা হলো- ভ্যালু অ্যাডিশন অর্থাৎ যা আমরা উৎপাদন করি এটাকে প্রসেস করে বিক্রি করা। আরেকটা হলো- ফরোয়ার্ড লিংকেজ। ফরোয়ার্ড লিংকেজ এ আমরা দেখি- বাজারে বা দোকানে যেসব প্রডাক্ট পাওয়া যায়- এগুলো হলো এক্সপোর্ট করা । প্রথম অংশে আমাদের যথেষ্ট সফলতা আছে। মাঝের অংশে কেবল শুরু হয়েছে। আর ফরোয়ার্ড লিংকেজে আমাদের যতটুকু খুব বেশি দরকার ততটুকুই করছি। এক্সপোর্ট এ আমরা তেমন কিছু করতে পারিনি। আমি মনে করি যদি কৃষিতে  ভ্যালু অ্যাড করা যায় এবং প্রডাক্ট অব এগ্রিকালচার করা যায় টেকনোলজি যুক্ত করে তাহলে অর্থনীতির যে অংশটা কমছে তা বাড়িয়ে নেয়া যাবে। এটি দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আনন্দ আলো: একটা বড় প্রশ্ন কিন্তু দেখা দিতে পারে- আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষের বসবাস। তাদের খাবারের যোগান দেয়ার পর আমরা কি আর এক্সপোর্ট করতে পারবো?

ড. এফএইচ আনসারী: আমি ছোট্ট একটি পরিসংখ্যান দেই- আমাদের দেশে ধান উৎপাদন হয় যে জমিতে তাতে গড়ে হেক্টরে ৪ টন উৎপাদন করতে পারি আমরা। কিন্তু ভিয়েতনাম করে ৬ টন। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে আমরাও ৬ টন করতে পারি। আর করা মানে হলো এই  সারপ্লাস হবেই। কারণ ধানেতো আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই সারপ্লাসটা বাইরেও হতে পারে অথবা যে এলাকাতে সারপ্লাস হচ্ছে  এই এলাকাতে কমিয়ে আমরা অন্যান্য ফসল- গম, ভুট্টা, সবজি, ফল এগুলো আবাদ করতে পারি। যেগুলো দেশে দরকার কিন্তু বাইরে থেকে আমদানি করতে হচ্ছে।

আনন্দ আলো: সবজি, মাছ ও ডিমের অনেক অংশ তো মনে হয় আমরা রপ্তানি করি?

ড. এফএইচ আনসারী: হ্যাঁ- সবজি, মাছ ও ডিমের কিছু অংশ আমরা রপ্তানি করি। দুধ, তেল, ডাল ও গম বিদেশ থেকে আমদানি করতে যাচ্ছে। এইগুলোতেও স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে আমাদের।

আনন্দ আলো: কৃষি আমাদের দেশের মেরুদÐ। কৃষিতে আমাদের চ্যালেঞ্জের জায়গাটা কোথায়? ভিয়েতনামের মতো উৎপাদন বাড়ানো কিংবা আমাদের কৃষকদের প্রশিক্ষণের অভাব?

ড. এফএইচ আনসারী: কৃষিতে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রডাকটিভ এগ্রিকালচার। অর্থাৎ আমি উৎপাদন করবো আমার পরিবারের এবং অন্যদের জন্যে, এভাবে অন্যরাও করবে।  এবং দেশ সম্পদশালী হয়ে উঠবে। এভাবে সবাই মিলে কাজ করতে হবে। তাহলে জিডিপি বেড়ে যাবে। চ্যালেঞ্জটা হলো টেকনোলজিতে। আমাদের দেশে কৃষি প্রযুক্তির উদ্ভাবন করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। কোনো কৃষি প্রযুক্তি ধীরে ধীরে করলে সেটা কোনো কাছে আসবে না। একই প্রযুক্তি সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন জায়গায় হচ্ছে। আমরা কোনটা আনতে পারছি কোনটা পারছি না। এই প্রযুক্তি দরকার আর প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি তা কৃষকের কাছে পৌঁছাতে হবে। কৃষকের কাছে প্রযুক্তি পৌঁছে দেয়াই কৃষিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া এটার জন্যে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ আছে। সরকার যদি অনেক বেশি বরাদ্দ তাদেরকে দেন। তাদেরকে টুলস ইকুইপমেন্ট দেয় এগুলো কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে। তাহলে প্রযুক্তি খুব দ্রæত তাদের কাছে পৌঁছে যাবে। আর মাঝখানে যেটি হয়েছে- প্রাইভেট সেক্টর আমাদের দেশে কৃষিতে ডমিনেট করছে। প্রায় সবগুলো কৃষি সেক্টরে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলো স্পর্শ করে গেছে। আর কৃষিতে প্রাইভেট সেক্টরে  অংশগ্রহণ নতুন। যারা প্রাইভেট সেক্টরে কৃষিকর্মী মাঠে কাজ করছে তাদেরকে পর্যাপ্তভাবে দক্ষ করে সাপোর্ট দেয়া হলে কৃষি প্রযুক্তি খুব তাড়াতাড়ি কৃষকের কাছে যাবে। কৃষক যা উৎপাদন করবে তা সারপ্লাস হবে। অথবা কম জমিতে অনেক বেশি উৎপাদন হবে এবং কম দামে বিক্রি করলে অনেক বেশি তাদের লাভ হবে। তখন কৃষি বাণিজ্য অনেক সার্থকভাবে আত্মপ্রকাশ করবে।

আনন্দ আলো: অনেক সময় প্রশ্ন আসে। আমরা কৃষি পণ্য উৎপাদন করি কিন্তু কৃষক সঠিক দাম পায় না? মধ্যস্বত্ব ভোগী অথবা পুরো প্রক্রিয়ার জন্যে এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আপনি কি বলবেন?

ড. এফএইচ আনসারী: মধ্যস্বত্ব ভোগীদের নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যদি আমরা দেখি মধ্যস্বত্ব ছাড়া আমাদের কৃষি সাফল্যজনকভাবে এগিয়ে যেতে পারবে না। তার কারণ হলো দূরবর্তী এলাকাগুলোতে যে পরিমাণ পণ্য উৎপাদন হচ্ছে তা বাজারে তো আনতে হবে? তা বাজারে আনার একটি প্রক্রিয়া আছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াতে কৃষকের জন্যে খুব লাভবান হয় না। কারণ উন্মুক্ত ট্রাকে অথবা পলিথিন দিয়ে বেঁধে নিয়ে আসে- নিয়ে আসার ফার্মেন্টেশনে পচে যায়। যেটুকু ভালো থাকছে তার কিছুটা বিক্রি হচ্ছে। কখনো লাভ হচ্ছে আর কখনো হচ্ছে লোকসান। এই সুযোগে মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভটা খেয়ে ফেলছে ব্যাপারটা তা নয়। তাই একজন কৃষক যে পরিমাণ উৎপাদন করে তার পরিমাণ যদি দ্বিগুণ করতে পারে তাহলে কি হবে? সস্তায় বিক্রি করলেও এটি লাভজনক হবে। এই দিকে আমাদের মনোযোগ দেয়া দরকার। তাহলে লাভ হবে এই যে, আমাদের দেশের মানুষ কম দামে এটি কিনতে পারবে আর কৃষকও কম দামে বিক্রি করেও লাভের মুখ দেখবে। এই জন্যে টেকনোলজি এবং যোগাযোগ দরকার।

আনন্দ আলো: টেকনোলজি কি আমরা সেইভাবে উদ্ভাবন করছি?

ANSARY-1ড. এফএইচ আনসারী: না, এই কাজে আমাদের সক্ষমতা কম।

আনন্দ আলো: বিদেশি টেকনোলজি আনার মতো ক্ষমতা কি আমাদের আছে?

ড. এফএইচ আনসারী: আমরা নিয়ে এসেছি। প্রাইভেট সেক্টর অনেক টেকনোলজি আনছে এবং ব্যবহার করছে।

আনন্দ আলো: এই ক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টর কেমন?

ড. এফএইচ আনসারী: প্রচুর- এই দেখেন, বর্তমানে আমাদের দেশের ৯০ ভাগ সবজির বীজ এই প্রাইভেট সেক্টর সরবরাহ করছে। ভুট্টা প্রায় ৯০ ভাগ সরবরাহ করছে। এইভাবে অনেক ফসলে প্রাইভেট সেক্টর কন্ট্রিবিউট করছে। মুরগির চাষাবাদ পুরোপুরি প্রাইভেট সেক্টর করছে। আমরা যদি মাছের কথা বলি- মাছের উৎপাদনের যে বিপ্লব হয়েছে তা কিন্তু প্রাইভেট সেক্টরের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে। প্রাইভেট সেক্টরে কৃষি ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। তবে গবেষণার ক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টর একটু দুর্বল আছে। বিদেশি গবেষণা এখানে নিয়ে এসে বেশিরভাগক্ষেত্রে আমরা চর্চা করছি। দেশে যেসব রিসার্চ প্রতিষ্ঠান আছে অনেক অবদান আছে তাদের। কিন্তু গবেষণা আরও দ্রæত এবং নতুন নতুন গবেষণা দরকার।

আনন্দ আলো: পশু খাদ্যের ব্যপারে জানতে চাই? মুরগির খামার থেকে শুরু করে পশুপালনের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। বিজ্ঞানভিত্তিক চর্চাও আমাদের হচ্ছে কিন্তু খাদ্যের জায়গাটা কি অবস্থায় আছে?

ড. এফএইচ আনসারী: আমাদের দেশে অনেক পশুখাদ্যের কারখানা আছে। তারমধ্যে চার পাঁচটি কোম্পানি উপরের অবস্থানে আছে এবং ভালো করছে। জার্মান এবং আমেরিকার মেশিনে এসব কোম্পানি চলছে। আমি সম্প্রতি ভারত থেকে এসেছি এবং সেখানে অনেক বড় বড় কোম্পানি পরিদর্শন করেছি- আমাদের যন্ত্রপাতি ভারতের যন্ত্রপাতি থেকে অনেক সুন্দর, অনেক সুগংগঠিত এবং অনেক সেট। এই সব যন্ত্রপাতি যেসব খাবার উৎপন্ন তার অয়েস্টেজ অনেক কম। গরু, মুরগি বা মাছের খাবার- যে কোনো হোক না কেন তার ওয়েস্টেজ অনেক কমে। পশু খাদ্যের সাপ্লাই আমাদের দেশে যথেষ্ট ভালো। আর এই খাদ্যের যে ’র ম্যাটেরিয়াল লাগে যেমন, ভুট্টা তার প্রায় সবই আমাদের দেশে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয়। সয়াবিনটা বাইরে থেকে নিয়ে আসতে হয়। অন্যান্য মাছের তেল বা নিউট্রেশন প্রোডাক্ট আছে এইগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। সেইক্ষেত্রে সরকারের কিছু ছাড় আছে যেমন, যে সব কারখানা এইসব আমদানি করে তার কোনো ডিউটি দিতে হয় না। তাই আমি মনে করি আমাদের দেশে পশুখাদ্যের সরবরাহের অবস্থা যথেষ্ট ভালো এবং সরকারের সমর্থন এখানে আছে। এখন যদি আমরা দেখি, মাঝে মধ্যে টেলিভিশন মিডিয়াতে শোনা যায় যে, চামড়ার ওয়েস্টেজ থেকে খাবার তৈরি করা হচ্ছে। আমি মনে করি আস্তে আস্তে এটা কমে যাচ্ছে কারণ- মানুষ বুঝতে পারে যে, পশুকে কোনটা খাওয়ালে তার গ্রোথ ভালো হচ্ছে। এফসিআর ফুড কনভার্স রেশিও বলে একটা অঙ্ক আছে- যদি মুরগিকে আমি দেড় কেজি খাবার খাইয়ে এক কেজি মাংস না পাই তাহলে আমার লস হবে। মাছকে যদি ১ দশমিক ৪ কেজি খাইয়ে যদি ১ কেজি না পাই তাহলেও লোকসান হবে। গরুর ক্ষেত্রে লোকসানের ব্যাপার আছে।

আনন্দ আলো: আমাদের কৃষক কি এতটা সচেতন?

ড. এফএইচ আনসারী: কারণ সে নিজে তো উৎপাদন করছে। সে প্রতি মুহূর্তে দেখে পশুর বেড়ে ওঠা এবং তাকে বাইরে বিক্রি করতে হয়। কস্ট অব বেনিফিট সে হিসেব করে দেখে। আমি মনে করি না যে, এখানে কন্টামিনেশন করার কোনো সুযোগ আছে। বাংলাদেশে বহু ভালো কারখানা হচ্ছে। যার ফলে ছোট ছোট ইনসিডেন্ট আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাবে। মানসম্মত খাদ্য উৎপাদিত হচ্ছে এবং তা চলতে থাকবে।