Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

কবরীর না বলা কথা

আমাদের চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে কবরী। বাংলা চলচ্চিত্রের একজন জীবন্ত কিংবদন্তী তারকা। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেও খ্যাতি পেয়েছেন। রাজনীতির অঙ্গনেও সুনাম কুড়িয়েছেন। চলচ্চিত্রে আসার আগে ও পরে কেমন ছিল তাঁর জীবন সংগ্রাম? এই নিয়ে নিজেই লিখেছেন একটি বই। নাম ‘স্মৃতিটুকু থাক’। প্রকাশ করেছে বিডি নিউজ টুয়েন্টি ফোর পাবলিশিং লিমিটেড। এই বইয়ের সূত্র ধরেই আমাদের এবারের শীর্ষকাহিনী…

কম বয়সে ছেলেদের প্রচন্ড ভয় পেতাম। জে এম সেন হাইস্কুলে সেভেনে উঠেই সিনেমা জগতে পা ফেলি। সবে দুধের দাঁত পড়েছে। সুতরাং ছবি দেখে দর্শক কবরীকে ‘পাশের বাড়ির মেয়েটির মতো আপনজন’ ও মিষ্টি মেয়ে বলে উপাধিও দেয়। মনের মধ্যে প্রেম প্রেম খেলা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু ভয়ে মুখ খুলিনি। প্রেমের পরে কী হবে! আমি কী করব! কিছুই জানি না। প্রথমে প্রেম এরপর বিয়ে!

আমার কপালে প্রেমের সুখ কোনোদিন হয়নি। যাক আপদ চুকেছে। প্রেমে পড়ে কার না কার ঘরণী হতাম। তবে যা হবার তা তো হয়েছেই। সবার জীবন কী এক রকম হয়? এই পৃথিবী একটা যুদ্ধক্ষেত্র। যুদ্ধে কেউ জেতে কেউ হারেÑ মেনে নিতেই হয়। এভাবেই বুঝি জীবন কেটে যায়।

মানুষজন বড় হয়ে কত কী হতে চায়Ñ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, পাইলট, অভিনেতা, সাংবাদিক বা অন্য কিছু। ফিরিঙ্গী বাজারের মিনা পালের স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে সাদা শাড়ি পরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে মাস্টারি করবে। কিন্তু আমার জীবন যে একদম উল্টো। অ্যাকশন-কাট-লাইট-এনজি-ওকে। মানুষ মনে করে চলচ্চিত্রের নায়িকা না জানি কত সুখী হয়। ঘুমায়, শুটিং করে, দাসদাসী মাথায় তেল লাগায়, শ্যাম্পু করে, ঘরদোর পরিস্কার করে। তারা কিছুই করে না, শুধু মজার মজার খাবার খায় আর টাইম টু টাইম ঘুমায়। অসুখ হয় কি? না, তাও বোধ হয় না। মেকআপ করে ড্রেস পরে যখন ক্যামেরার সামনে দাঁড়ায় কী যে মোহনীয় লাগে।…

যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। বাস্তব যে কত কঠিন অনেক মানুষের সে ধারণাই নেই। আমার মা খুবই ভালো রাঁধত। বিশেষ করে শর্ষে ইলিশ, পোস্ত পালঙ, শাক আলু, কই মাছ, ফুলকপি আলু, পাঁচমিশালী তরকারির নিরামিষ। উফ! যার কোনো জুড়ি নেই। রান্না আমারও প্যাশন। আমার বন্ধুদের আমার বাচ্চাদের জন্য আমি অত্যন্ত যতœ নিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে রান্না করি। তারা মজা করে বলে, ‘তোমার হাতে কি জাদু আছে?’

এই গুণ আমার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। মা অত্যন্ত সাংসারিক ছিলেনÑ নিরাভরণ জীবন তার পছন্দ। ‘মহাভারত’ পড়তে আগ্রহী, বন্ধুবৎসল, সুর করে পুঁথি পড়তেন। আমি কবরী হওয়ার পরও আমার মায়ের নতুন করে কোনো চাহিদা তৈরি হয়নি। কোনো পরিবর্তনও তার মধ্যে দেখিনি। ভাসা ভাসা চোখের চাহনিতে প্রকাশ করতেন অনেক না বলা কথা।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ আমার জীবনে অনন্য ঘটনা, অনন্য সময়। মুক্তির আনন্দ অন্যরকম। অনেক কষ্টে অর্জিত এই স্বাধীনতা। ভারত থেকে দেশে ফিরে আরেক বিড়ম্বনার শিকার হই। নিজস্ব কষ্ট থেকে কোনোমতে উতরানো যায়, কিন্তু সমষ্টিগত বাধা থেকে নিস্তার পাওয়া খুবই কঠিন। স্বাধীনতাযুদ্ধের পর নানাজনের সাথে কথা হতো, মেলামেশা হতো, কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের সাথে পরিচয় হয়ে ওঠেনি। কবরী হিসেবে আমাকে তারা চিনতেন, কিন্তু যাওয়া আসা তেমন ছিল না। শুধুমাত্র শ্রদ্ধেয় মালেক উকিল সাহেবের পরিবারের সাথে আমার ওঠাবসা। তাঁর মেয়ে বেবী, লিলি, মায়া ওদের সাথেই আমার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। আমি আর অভিনেত্রী রোজী সামাদ প্রায়ই মালেক ভাইয়ের পারিবারিক দাওয়াতে যেতাম।

KObori-5বাংলাদেশ সৃষ্টির পরে ছবি আগের মতো আর সুবিধা করতে পারেনি। কিছু ভালো ছবি যে হয়নি তা নয়, কিংবা কিছু ছবি ভালো ব্যবসা করেনি তাও নয়। তবে পুরোনোদের অনেকের চলে যাওয়ায় এক ধরনের সিস্টেম লস হয়েছে। সে সময় যারা এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন, তারা একটা প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে আসতেন। স্বাধীনতার পর আনাড়ি কিছু লোকের হাতে সিনেমা শিল্পটি হালুয়া-রুটির ভাগবাটোয়ারায় পরিণত হয়। দিনে দিনে এর পরিণতি হলো করুণ থেকে করুণতর। এজন্য রাজনীতিও দায়ী। তাই যা হবার তাই হয়েছে, হচ্ছে। এখনো আমাদের পুরনো সিনেমাগুলো টিভি চ্যানেলে সম্প্রচারিত হলেও পরের ছবিগুলোর হদিস নেই। দর্শকনন্দিত হতে পারেনি সেগুলো। সোনালি জগৎ এখন ধূসর অতীত।

অনুপ সিং নামের এক সিনেমার পোকা ঋত্বিকদার ওপর তথ্যচিত্র বানাবেÑ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’কে ঘিরে। মূল ছবিটির শিল্পী আমি, রোজী, মোস্তফা ভাই, আরো অনেকে। যাকে যাকে পেয়েছে তাদের নিয়েই নির্মাণ করেছে সেটি। শমী কায়সার এই তথ্যচিত্রে কথক হিসেবে কাজ করেন। আমরা আরিচায় পুরোনো লোকেশনে গেলাম। পুরোনো সঙ্গীরা এক সাথে কাজ করার আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। তিতাস নির্মিত হয় সম্ভবত ৭৩ সালে। আর ‘নেম অব দ্য রিভার’ তথ্যচিত্রটি তার অনেক পরে। তথ্যচিত্রের শুটিং করতে গিয়ে বেকায়দায়ও পড়ি। যত রাতই হোক বাড়ি ফেরার কথা সবার। হঠাৎ বৃষ্টি নামায় আমাদের গাড়িগুলো লাল মাটির পিচ্ছিল কাদায় আটকে যায়। অগত্যা শুটিং শেষে গ্রাইে রাতযাপন। সাংবাদিক বন্ধু আখতারুজ্জামান অনেক খুঁজে একটা বাড়ি পেলেন। সেখানে মোটে একটা বিছানাপাতা চৌকি। পরিচালক থেকে ক্রু অনেক লোক আমরা। সবাই কষ্ট করলেন। আমরা পাঁচ মহিলা এক চৌকিতেই অর্ধেক শরীর ঠ্যাক দিয়ে গল্প করেই রাত কাবার করলাম। এতো কষ্ট করে বাসায় ফিরে প্রশ্নের মুখোমুখিÑ কেন রাতে থাকলাম? রাত বলে কথা। যেন দিনে কিছু হয় না। মেয়েদের জীবন ভারি অদ্ভুত। বিশ^াসের জায়গায় মেয়েদের ঠাঁই করে নিতে হলে সৃষ্টিকর্তাকে নতুন করে ভাবতে হবে। সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে অন্য পুরুষের সাথে জড়িয়ে চরিত্র হনন। সত্যি কি মিথ্যা সে বিশ্লেষণও নেই। অথচ এর চাইতে বড় অপরাধও তো হতে পারে। বাবা, ভাই, স্বামী, পড়ন্তবেলায় সন্তান জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। এমনকি ছেলেবন্ধু থাকলে তার কাছেও হার মানতে হয়। হায়রে মেয়ে মানুষ! অনুপ সিং যখন তথ্যচিত্রটির কথা পাড়েন তখন সদ্য মাকে হারিয়ে মন ভারাক্রান্ত। সম্মানী নিয়ে কোনো আলাপ হয়নি। আমরা পেশায় এতো নিবেদিত ছিলাম, টাকার কথার আগে গল্প, পরিচারক, চরিত্র নিয়ে ভাবতাম। কত কাজই তো টাকা ছাড়াই করেছি। আর এখন সিনেমা দূরে থাক, নাটকেও শিল্পী মেলে না টাকা দিয়েও। তারা পেশা ছাড়াও নানা কাজে ব্যস্ত। আগে বলা হতো ক্রিয়েটিভ পেশা, এখন এই পেশা সাইনবোর্ড সর্বস্ব।

KObori-4১৯৭৪ সালে বনানীতে খুব সুন্দর একতলা বাড়ি ভাড়া নেই। নিজের বাড়ির স্বপ্ন ছিল না। খুব কম বয়সে কাজ শুরু করায় হয়তো সম্পদপ্রীতি কম ছিল। রাজ্জাক, ফারুক, আলমগীর, জাফর ইকবাল, মাসুদ পারভেজ, উজ্জ্বল, কায়েস, আনন্দ, সিডনী এই কয়জনার সাথে একচেটিয়া কাজ করতাম আমি। নতুন হিরোর সাথে কাজ করার সময় আমি অনেক দুষ্টুমি করেছি। অনেক হিরোকে পছন্দ হতো না। কী করব, আমার ইচ্ছায় তো সব হবে না। তবে নাজেহাল করার দুষ্টুবুদ্ধি আঁটতাম। নতুনরা তো আমাকে দেখে প্রথমে খুব ঘাবড়ে যেত। তখনো কিন্তু কোনো কান্ড ঘটাইনি। প্রথম শট হিরো এসে দাঁড়াবে। হেসে বলবে, ‘চলো ডিয়ার আমরা ঘুরে আসি’। আমি বলব, ‘না আমি যাব না’। আমি একটু থেমে বলব, ‘এখন না পরে।’ মাতব্বর নতুন হিরো ডায়লগের মাঝখানে বলে উঠল, ‘আপনি তো পরের সংলাপ বললেন না।’ কাট কাট। পরিচালক নয়া মিয়াকে দিলেন ধমক। আমি তো প্রচন্ড রেগেছি। তারপর প্রেমে গদগদ ভাব নিয়ে নায়কের চোখের দিকে তাকানোর ক্লোজআপ শট। …অ্যাকশন। আমি চোখ দুটো গোলগোল করে ট্যারা বানিয়ে হিরোর দিকে তাকালাম। লোকটা আমার এক্সপ্রেশন দেখে প্রেমের বদলে ভয়ে কান্নার এক্সপ্রেশন দিচ্ছে। পরিচালক তো অবাক। হাসি চেপে আমিও জিজ্ঞেস করিÑ ‘কী হয়েছে?’ সে তো চুপ।

দেখতে দেখতে বাচ্চারা বড় হয়ে গেল। বাচ্চারা ছোট থাকতেই বেশি কাজ করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের আগে আমার দ্বিতীয় ছবি ‘বাহানা’র সময় এটি ছিল উর্দু ছবি, পাকিস্তানের করাচি শহরে শুটিং হয়েছিল। আমি এক সন্তানের মা। আমার বাচ্চাকে আমি এক বছর পর্যন্ত বুকের দুধ খাইয়েছি। অনেক পেশাজীবী মা বিশেষ করে গø্যামার জগতের নারীরা বাচ্চাদের ব্রেস্ট ফিড করায় না। তাদের ভয় পাছে সৌন্দর্য নষ্ট হয়। কিন্তু বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, মেধার বিকাশ ঘটানো এসব ছাড়াও মা ও সন্তানের মাঝে সেতুবন্ধ গভীর করে এটা। সন্তান বলে কথাÑ বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।

আমার পাঁচ মানিকÑ অঞ্জন (বাবুনী), রিজওয়ান (মন্টি), শাকের, জয়নাল (চিশতি) ও শান। আমার বাচ্চারা আর আমি রচনা করেছি এক স্বর্গলোক। ওরা যখন ছোট ছিল তখন আমিও ছোট্টটি হয়ে ওদের সাথে চোর-পুলিশ খেলতাম, পিস্তল দিয়ে খেলতামÑ বিশেষ করে বড় দুটিÑ বাবুনী, মন্টির সাথে। মনেই হতো না আমি ওদের মা। বড় হওয়ার পর তাদের সাথে বন্ধুত্ব আরো প্রগাঢ় হয়। আমার বড় দুই ছেলে রিজওয়ান আর অঞ্জন ও-লেভেল দিয়ে আমেরিকায় পড়তে যায়। যুদ্ধের আগে ওরা খুব ছোট ছিল। আমিও ছোট ছিলাম। আমি শুটিং নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত থাকতামÑ জনপ্রিয়তা যেমন তুঙ্গে, কাজের চাপও মারাত্মক। বাবুনী আমেরিকান স্কুলে পড়ত, মন্টি ব্রিটিশ এক কিন্ডারগার্টেনে। দুজনই খুব মেধাবী। আমার মা আমার দুই বাচ্চাকে দেখাশোনা করতেন। বাবুনী, মন্টির মতো জয়নালও ও-লেভেল পাস করে আমেরিকায় পড়তে যায়। শাকের ইংল্যান্ডে অক্সফোর্ড ব্রæক্স থেকে, জয়নাল বোস্টন নর্থ ইস্টার্ন থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে। মন্টি নিউইয়র্কে, বাবুনী লস এঞ্জেলেসে, শান কানাডায় গ্রিন উড স্কুলে পড়ত। চিশতি আমেরিকান কলেজের সর্বোচ্চ সম্মান ‘ম্যাগনা কাম লাড’ পেয়ে গ্র্যাজুয়েশন করে। আমার মা-ছেলেরা খেলতে খেলতে কখন যে বড় হয়ে গেলাম বুঝিইনি।

KObori-3পেয়ারা গাছের ডালে এক পা দু পা করে উঠছি। ছোট পেয়ারা, বড় পেয়ারা, ডাঁসা পেয়ারা ডালে ডালে ঝুলছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা নেব। হাত দুটি আকুলি বিকুলি করছে। হঠাৎ চোখে পড়ল পাকা একটা পেয়ারা পাতার নিচে লুকিয়ে আছে। হুম। আমার হাত থেকে রক্ষে নেই। হালকা বাতাস বইছে। গাছে মৃদু দুলুনি। এক হাত দিয়ে ছোট একটা ডাল ধরেছি, আরেক হাতে পাতা সরিয়ে হাত বাড়িয়েছি, এই… এই তো… পেয়ারাটি ধরেই ফেলেছি প্রায়…।

ধপাস!

ডাল ভেঙে পায়ে শাড়ি জড়িয়ে এক্কেবারে মাটিতে। প্রথমে বুঝতে পারিনি, পরে দেখি হাঁটুর নিচে চামড়া ছিলে রক্ত ঝরছে। ব্যথা করছে। কিন্তু ভয়ে জোরেশোরে কাঁদতেও পারছি না।

‘সুতরাং’ ছবির প্রথম দিনের প্রথম শট ধারণের কাজ চলছে। আউটডোর। গুলশান পার্ক। চারদিকে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা গাছে ভরা। আমার প্রথম সিনেমা। শট ধারণের জন্য ক্যামেরা তখন আমার পায়ে ফোকাস করা।

ক্যামেরাম্যান কিউ এস জামানের সঙ্গে সুভ্ষা দত্ত ছুটে এলেন। তিনি এ ছবির পরিচালক, নায়কও। অবস্থা দেখে এক মুঠো ঘাস কচলিয়ে আমার শাড়ি সরিয়ে পায়ে লাগাতে গেলেন। আমি কিছুতেই শাড়ি ওঠাতে দিচ্ছি না। ঠাস করে চড় মারলেন আমাকে। অপমানে ব্যথায় ভ্যা করে কেঁদে দিলাম।

শুটিং শেষে সবাই খুব আদর করল, বলল, শটটা সুন্দর হয়েছে। দত্ত দাদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘অ্যাই, খুব লেগেছে?’ এমন আদুরে কথায় নতুন করে অভিমানে গলা ভার হয়ে ওঠে। চোখে জল ছলছল। আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে জানালামÑ ‘হ্যাঁ, খুব লেগেছে।’ দত্তদা কাছে টেনে মাথায় আদর করে দিলেন। বললেন, ‘দূর পাগলি! কাঁদতে হয় নাকি! কত ব্যথাই তো আমরা পাই, কিন্তু একটুও কাঁদি না। সিনেমায় অভিনয় করতে সছো, অনেক কষ্ট করতে হবে। তা না হলে আম হবে কেমন করে?’

তখন সিনেমা বলতে বুঝতাম সাংঘাতিক একটা ব্যাপার। স্কুলে পড়া, টুকটাক নাচ ছাড়া আর কিছুই বুঝতাম না।

সিনেমা করতে এসে আমার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতাটা বলিÑ

‘একটু দাঁড়াও তো।’

চমকে উঠলাম।

‘পেছনে ঘোরো, আবার সামনে, হেঁটে দেখাও, চুল দেখি… দাঁত দেখি।’

ছোটখাটো মানুষ দত্তদা বলেই যাচ্ছেন।

আরে, এ তো দেখি কনে দেখার মতো! আমার দিদির বিয়ের সময় এমন হয়েছিল, আমার মনে আছে। বেয়াদপ!

‘কথা তো নিশ্চয় বলতে পারো?’

বিরক্ত হয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা করি।

‘মাথা নাড়লে চলবে না, শব্দ করে পরিস্কার করে বলো, তোমার নাম কী?’

আমি চুপ।

আবার বললেন, ‘নাম কী?’

‘মিনা।’

‘পুরো নাম বলো।’

‘মিনা পাল।’

‘সংলাপ বলো, ‘অ্যাই ছাড়ো, কেউ দেখে ফেলবে।’ দেখি তুমি অভিনয় করতে পারবে কি না।’

এভাবেই আমার ‘সুতরাং’ ছবির জন্য ইন্টারভিউ শুরু।

আমি সাহস পাচ্ছি না। বুকের ভেতর যেন কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে। মনে মনে বাবাকে অভিশাপ দিচ্ছিÑ এতো লম্বা একটা কথা কী করে বলব! আর এই লোকটা তো আচ্ছা পাজি! নিষ্ঠুর।

‘আরে মেয়ে, চুপ করে আছ কেন?’

তারপর কী ভেবে একটু মোলায়েম করে বললেন, ‘বলো, প্লিজ, বলো।’

এবার একটু স্বস্তি পেলাম। আস্তে আস্তে সংলাপ বললাম।

সংলাপ শুনে বলে উঠলেন, ‘এ তো দেখি চাঁটগাইয়া গলার সুর। উঁহু, চলবে না। কথা ঠিক করে বলতে হবে।’

আরতপর ‘কে ফটোগ্রাফারস’-এর খালেক সাহেব আসলেন, সত্যদা, আরো কত লোকজন। আমি ভয়ে বিস্ময়ে তাকাচ্ছি, কিচ্ছুই বুঝতে পারছি না। খালেক ভাই ফটাফট অনেক ছবি তুললেন। ডার্করুম থেকে ছবি ওয়াশ করে পাঠিয়ে দিলেন। শাড়ি, বøাউজ, কাচের চুড়ি আরো কত কি জোগাড় হচ্ছে।

দেখলাম, বাবার খুশি খুশি চেহারা। মনে হচ্ছে আমাকে তাদের পছন্দ হয়েচে। দত্তদা বললেন, ‘কৃষ্ণবাবু, কাল দুপুর ৩টায় আর কে মিশন রোডে আমাদের অফিসে মিনাকে নিয়ে চলে আসবেন। রিহার্সেল হবে।’

আমি তাহলে পাস।

পরদিন প্রডিউসারের অফিসে গেলাম। এক হাজার এগারো টাকা দিয়ে আমি সাইন করলাম। জীবনের প্রথম রোজগার। শুরু হয়ে গেল নতুন জীবনের গল্প।

আলো ঝলমল ঢাকা শহর, মিনার চোখে স্বপ্ন। ‘সুতরাং’ দিয়ে বাংলার মানুষের মনে এক চিলতে ঠাঁই করে নেওয়ার জন্য অনেক পরিশ্রম, অনেক সংগ্রাম। কত নতুন কিছু বুঝতে হবে, জানতে হবে, শিখতে হবে। নিজেকে তৈরি করতে হবে। এক হাজার এগারো টাকা পুঁজি নিয়ে বাংলার সাত কোটি মানুষের হৃদয়ের দখল নেয়া ছিল অনেক কঠিন কাজ। পুলসিরাত পার হতে লেগেছিল অনেক বছর।

 

কী দেখে বা কী ভেবে দত্তদা আমাকে চলচ্চিত্রে নিলেন আমি আজও ভেবে পাই না। আমি যে কী রকম দেখতে ছিলাম ফর্সা না কালো, লম্বা না বেঁটে, সুন্দরী না পচা, আমার নাক বোঁচা নাকি খাড়া মনেও পড়ে না। এটুকু শুধু মনে পড়ে ছেলেবেলায় আমি দুরন্ত ছিলাম। মা বলতেন, ‘পাড়া চরনি।’ সেই ফিরিঙ্গি বাজার আলকরণ স্কুল, জেএমস সেন স্কুল, বান্ধবীর বাড়ি যাওয়া সবখানেই আমার অন্তহীন ছোটাছুটি। ভুলতেও পারি না ছোটবেলার স্মৃতি। ঘুরে ঘুরে কেবল মনে পড়ে। স্কুল ছুটির পর পূজার ফুল, বিল্বপত্র, দুর্বাঘাস এইসব জোগাড় করা আমার নিত্যদিনের কাজ। পূজার সময় মায়ের নতুন শাড়ি পরতে চাইতাম। বড় বোন লীলা বলতো আমি শাড়ি ছিড়ে ফেলব। ‘হিংসুটে।’

KObori-2আমাদের বৈষয়িক অবস্থা ভালো ছিল না। এতোগুলো ভাইবোনের লেখাপড়া, কাপড়-চোপড়, ঘর ভর্তি বড় বড় খানেওয়ালা ছোটবড় মিলিয়ে দুইবেলায় ২৪/২৫ জন। বিরাট খরচ। বাবার একলার রোজগারে কুলাচ্ছিল না। বড় ভাই কিছু সাহায্য করতো। আমাদের গ্রামের বাড়িতেও কিছু সম্পত্তি ছিল। ওসব বিক্রি করতে করতে প্রায় শেষের কোঠায়। তাই পুতুল খেলার সংসার থেকে ছুটি নিয়ে ভিন্ন জগতে সংসার পাততে আসতে হয়। ছোট্ট মেয়ে মিনার কাছে তাই আলো ঝলমল ঢাকা শহর এক বিস্ময়। তার আগামী যখন তৈরি হচ্ছে, বোছবার মতো বয়সও তার হয়নি।

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে আমি, বাবা আলো দিদি তিনজন সদরঘাটের এক বোর্ডিংয়ে উঠলাম। মা ভাইবোন, স্কুলের বন্ধু, এমনকি পুতুল খেলার সাথীদের জন্য মায়া হচ্ছিল। সবকিছু বিসর্জন দিয়ে বলি হলাম কিছুটা বুঝে, কিছুটা না বুঝেই ১৩ বছরের মেয়েটি সবার মুখে হাসি ফোটাতে সংসারের হাল ধরল।

কতটুকু পেরেছি জানি না। নিজের দিকে তাকানোর ফুরসত ছিল না। ফ্রক, হাফ প্যান্ট পরে বাবার হাত ধরে দিদিকে সঙ্গে নিয়ে সিনেমার রিহার্সেল করতে বেবিট্যাক্সি চেপে সদরঘাটের বোর্ডিং থেকে রামকৃষ্ণ মিশন রোডের অফিসে আসতাম। তারপর আর কে মিশন রোডে বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম। চট্টগ্রামে থাকতে বেবিট্যাক্সি চড়ার কত শখ ছিল। আর এখন চড়তে চড়তে আমি ক্লান্ত।

প্রথম দিনই কে ফটোগ্রাফারস নামের স্টুডিওতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। নানা অ্যাঙ্গেলে অনেক ছবি তোলেন খালেক ভাই। ভয়েস টেস্ট করা হয়। রীতিমতো কনে দেখা। শাড়ি পরিয়ে দেখল। সামনের দাতে পোকা হয়েছিল, মাত্র পড়ে নতুন দাত উঠতে শুরু করেছে।

দত্তদা বললেন, কথার সুরে চট্টগ্রামের টান রয়েছে, ঠিক করতে হবে। অনেক পরে দত্তদার কাছে জানতে চেয়েছিলাম আমাকে আপনার নায়িকার চরিত্রে পছন্দ কেন করেছিলেন? দাদা জানান, প্রথমত আমার উচ্চতা। কারণ দত্তদা ছোটখাটো হওয়ার আমার সাথে মানাবে। দ্বিতীয়ত আমার নতুন দাতের নিচে ঢেউ ঢেউ ছিল, ওটা নাকি দাদার পছন্দের কারণ।

অফিসে সত্যদা আমাকে দেখার সাথে সাথে বলত, মিনা আমি তোমাকে বিয়ে করব। ভয়ে দিদির শাড়ির ভেতর মুখ লুকিয়ে বলতাম, আমি বিয়ে করব না।

নানা কিছুর তালিম শেষে শুটিং শুরু হয়। আজকের অভিজাত গুলশান তখন গ্রাম। এই গুলশানেই সুতরাং এর প্রথম লোকেশন। চারদিকে কাঁঠাল গাছ, পেয়ারা গাছ, আম গাছ, লম্বা লম্বা তাল গাছ। রীতিমতো জঙ্গল। শুটিংয়ের অবসরে আজকের মতো এসি গাড়িতে বসার সৌভাগ্য হয়নি। গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিতাম। ক্যামেরাম্যানকে দেখলে আমার খুব ভয় লাগত।

দত্তদার কাধে মাথা রেখে ভালোবাসার সংলাপ বলতে হবে। জীবনে প্রথম কোনো পুরুষ মানুষের এতো কাছে আসা। তার ওপর প্রেমের সংলাপ। আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। বুঝতে পারছি না কেমন করে কাধে মাথা রাখব। কিছুতেই হচ্ছিল না। ক্যামেরাম্যান বার বার কাট কাট বলছিলেন। ধমকও দিলেন। জল ভরা চোখে ভগবানের নাম দিয়ে শট ওকে করেই ফেললাম। সবাই মহা খুশি। উফ বাঁচলাম।

সিনেমায় পা রেখে সত্যিকারের বড় হতে শুরু করি। নদী যেমন বহমান, মানুষের জীবনও তেমনই। বহতা নদীর মতো একেবেকে চলে। ঝড়বৃষ্টি আলো অন্ধকার আনন্দ বেদনা নিয়েই জীবন। শুধু আমার কেন, সবারই পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ শরীরের অঙ্গে অঙ্গে মেখে নানা রঙে আমরা সময়কেও রাঙাই। আমার সময়কেও আমি তেমন করে দেখি। আমার জীবনে কি সেই রং এসেছিল?

সুতরাং-এ কিশোরী প্রেমিকা জরিনার ভ‚মিকায় মিনা পালের অভিষেক হয় নতুন নামে কবরী ওরফে জরিনা। সিনেমায় সে গর্ভবতী হয়।

মনে পড়ে আমি যখন বেশ ছোট, আমার মায়ের এক/দু বছর অন্তর বাচ্চা হতো। দেখতাম মা নিজের পেট চেপে ধরে কাঁদতেন। আমাকে কিছু বলার আগেই দৌড়ে পাড়ার দাইমাকে ডাকতে যেতাম। মা হাসপাতালে গেলে তার অভাব খুব অনুভব করতাম। মাকে দেখার জন্য আকুল হয়ে থাকতাম।  ছোট থেকেই মায়ের কান্না সহ্য হতো না। মা অনেক কাজ করতেন। সংসারের কোন কাজটি মাকে ছাড়া হয় শুনি? শুধু সন্তান জন্ম দিয়েই আমার মায়ের ক্ষান্তি হয়নি। নিজের সুখের কথা কোনোদিন ভাবেনি। ছোটবেলায় তার কাছে সতীনের সংসারে জালাতনের কথা শুনে শুনে ওসব ঘটনার পাত্রপাত্রীর চরিত্র এক রকম মনে আঁকা হয়ে যায়। মনে হতো আমিও এই গল্পের এক চরিত্র যে চরিত্র কথা বলে না, গভীরে প্রবেশ করতে পারে না, সাজাও দিতে পারে না, শুধু মার বুক ভরা কান্নায় শামিল হয়ে এতটুকু সান্ত¡না দেবার অদম্য ইচ্ছাকে উজাড় করে দিতে প্রাণপণ চেষ্টা করতাম। অনেকদিন পর দেখা হলে মায়ের পা দুটি চেপে ধরে প্রণাম করবার মধ্যে কী যে তৃপ্তি পেতাম মনে হতো মায়ের সবটুকু আশীর্বাদ বুঝি আমার একারই অধিকার।

শুটিংয়ের সময় মায়ের কথা খুব মনে পড়ত। সুতরাং এ নায়িকার বাচ্চা হবার দৃশ্য ছিল। গামছার মধ্যে তুলা ভরে পেটের ওপর লাগিয়ে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছিল পেট যেন বড় দেখায়। দত্তদা ভালো করে দেখেও নিলেন দৌড়ের সময় তুলা পড়ে যায় কিনা। দৌড়ের সময় পেটে হাত দিয়ে কষ্টের ভাব কেমন করতে হবে বার বার দেখাচ্ছিলেন দাদা। আমার লজ্জা লাগছিল। ঐ বয়সে যে মেয়ের বিয়ে হয়নি, বাচ্চা হয়নি সে কি বোঝে অভিনয়টা কেমন করে করতে হবে। দৃশ্যটায় গুন্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ মাটিতে পড়ে পেটে হাত দিয়ে উফ উফ বাবাগো মাগো বলে কাঁদতে হবে। পরে সিনেমা দেখে মনে হলো কে বলবে আমি বাচ্চার মা নই? আমি জন্মগতভাবেই মা। তা না হলে মায়ের এক্সপ্রেশন আমার অভিনয়কে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল কীভাবে?

অনেকদিন পর বাড়ি যাই। মাঝে অবশ্য মা ঢাকায় এসে আমাকে দেখে গেছে। বাড়ি যেতে পেরে খুব আনন্দ লাগে। আবার মনটা খারাপও হয়ে যায়। এরই মধ্যে বন্ধুরা কে কোথায় চলে গেছে। কারে আবার বিয়ে হয়ে গেছে। কারো কোনো খোঁজ নেই। আবার ঢাকা ফিরে আসি।

চলচ্চিত্রে অভিনয় খুবই কঠিন। মনপ্রাণ ঢেলে দিতে হয়। একদিন শুটিং পরিচালক বললেন, ক্যামেরার লেন্সের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকো। মনে করো তোমার প্রেমিক গভীরভাবে তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। তোমার রি-অ্যাকশন দাও। প্রথম প্রথম বুঝতে পারতাম না, নার্ভাস লাগত। ধীরে ধীরে রপ্ত হয়ে যায়। তাকিয়ে আছি তাকিয়ে আছি মিষ্টি হাসির আভা সারা মুখে দ্যুতি ছড়ায়, দাঁত বার না করে হাসি। এমন কঠিন এক্সপ্রেশন, কিন্তু অপূর্ব।

সুতরাং ছবি রিলিজের পর চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায় নতুন নায়িকা নতুন নায়ক নতুন পরিচালক সবাই দারুণ কাজ করেছে এক্কবারে সুপার ডুপার। সাংবাদিক আজিজ মিসির চিত্রালীতে লিখতেন আসলাম, দেখলাম জয় করলাম। পিজি হাসপাতালের ভবনটি আগে শাহবাগ হোটেল ছিল। ওখানে পুরো টিমকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সুতরাং ছবিটি কম্বোডিয়ায় এক ফেস্টিভ্যালে সেকেন্ড বেস্ট ফিল্ম পুরস্কার পায়।

তখন নামিদামি অভিনেত্রির সংজ্ঞা বুঝতাম না। মন মগজ বুদ্ধি কিছুই পোক্ত হয়নি। টাকার লোভ মাথায় বাসা বাধেনি। শক্তিশালী এই মিডিয়াকে মোকাবিলা করার জন্য পরিপূর্ণভাবে তৈরি হয়েও আসিনি। কিন্তু আমার প্রথম ছবি সুতরাং শুধু বক্স অফিসেই সাফল্য আনেনি, একটি সুন্দর, মার্জিত, বিনোদন ছবি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এখনো অনেকে আমাকে বলেন, নতুন বিয়ের পর তারা স্ত্রীকে নিয়ে সুতরাং দেখেছেন বহুবার, উপহার হিসেবে।

আমার বড় ছেলে বাবুনী হবার পর বাহানা ছবিতে কাজ করার প্রস্তাব পাই। ওটাই আমার দ্বিতীয় ছবি। জহির রায়হানের পরিচালনায় এটিই পাকিস্তানে প্রথম সিনেমাস্কোপ উর্দু ছবি। তারপর খান আতার ‘সোয়ে নদীয়া জাগে পানি’ ছাড়াও আরো কয়েকটি উর্দু ছবিতে কাজ করি। যেমন ইবনে মিজানের ‘মেরে সনম’। আমার উর্দু ছবি কোনোটাই ভালো হয়নি। ব্যবসা সফল হয়নি। তবে চলচ্চিত্র শিল্প তখন অত্যন্ত মর্যাদা অর্জন করেছিল। আতা ভাইয়ের ‘সোয়ে নদীয়া জাগে পানি’ মস্কো তাসখন্দে আফ্রো এশিয়ান ফেস্টিভ্যালে প্রচুর প্রশংসা কুড়ায়। পূর্ব পাকিস্তানের স্টুডিওতে সাব টাইটেলের ব্যবস্থা ছিল না। তাসখন্দে যাবার পর কর্তৃপক্ষ প্রথমে ছবিটি বাতিল করে দেয়। একদিন সময় চেয়ে নিয়ে তাসখন্দে বসেই আতা ভাই ছবিটির ইংরেজি সাব টাইটেল করেন। ছবিটি পুরস্কারও পায়। অত্যন্ত মেধাবী ও বহু গুণের অধিকারী ছিলেন খান আতাউর রহমান। একাধারে গান লেখা, স্ক্রিপ্ট, সঙ্গীত পরিচালনা সবকিছু করতেন। আমি তার একনিষ্ঠ অনুরাগী ছিলাম। শ্রদ্ধা করতাম, ভালোবাসতাম, ভয়ও পেতাম।

KObori-1এফডিসির ১নং ফ্লোরে প্রথম মেকআপ নেই। পরবর্তীতে দিনরাত কাজ চলত। শুটিং শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ২টা-৩টা কখনো ভোর ৪টাও বাজত। সকালে বাচ্চাদের দেখতাম ঘুমিয়ে আছে অথবা স্কুলে গেছে। আর রাতে এসে দেখতাম বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে। দারুন ব্যস্ত, ৬৬ থেকে ৭০ সাল পর্যন্ত ঝড়ের বেগে কাজ করেছি।

তখনকার ছবি বানানো হতো সাত কোটি দর্শকের জন্যই। পরিবার কেন্দ্রিক গল্পে, মৌলিক সাহিত্য থেকে নেওয়া গল্পে অথবা ফোক কাহিনী নিয়ে সব শ্রেণীর মানুষের জন্য বিনোদন। রূপবান দিয়ে শুরু তারপর আবার বনবাসে রূপবান, পারুলের সংসার, সাত ভাই চম্পা, অরুণ বরুণ কিরণমালা এই ছবিগুলোর মধ্যে আমিও খুব মজা করে কাজ করেছি।

অরুণ বরুণ ছবিতে সাপের সাথে অনেক কাজ ছিল। একবার সাপ ধরে গান হাইতে হবে। এই বড় ফনা তোলা সাপ। আতা ভাই পরিচালক। ঐ সাপ দেখে কি গান হগাইব। হাসি হাসি চেহারায় গাইতে হবে। হাসির বদলে ভয়ে দুই চোখ বেয়ে পানি গড়াতে লাগল। সাপুড়ে অনেক অভয় দিল। ক্যামেরা, অ্যাকশন। সাপের গলা ভালো করে চেপে ধরলাম ব্যাটা যেন আমাকে কামড়াতে না পারে। সাধ্যমতো দৃশ্যটা করে দুলাইন গান গেয়েই ফেললাম। ব্যাস। যেই না কাট বলল এক ঝটকায় সাপটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। সাপুড়ে দৌঁড়ে এসে তার প্রিয় সাপটাকে তুলতে গেল। হায় হায় হায় সাপের দম নেই। আমার মুঠোর চাপের চোটে মরেই গেছে।

সুপার হিট সাত ভাই চম্পা ছবিতে আমার ঠোটে দারুণ একটি গান আছেÑ

‘শোনেন শোনেন জাহাপনা

শোনেন রানি ছয় জনা

শোনেন বলি নতুন করে পুরান ঘটনা।’

গুলিস্তান সিনেমা হলে মুক্তি পায় সাত ভাই চম্পা। গানটি দেখতে বø্যাকে টিকেট কাটে দর্শকরা। পুরো ছবি না দেখেও আমার লিপসে গান দেখতে যেত। আমি গানের সুর, তাল বুঝতে পারতাম। মনেই হতো না অন্য কেউ গাইছে। সুতরাং ছবিটি করতে এসেই সুরকার সত্য সাহার কাছে গানের তালিম নেই। সিনেমায় আসার আগ অবধি রুনুদার কাছে নাচ শিখি। পরবর্তীতে সিনেমার জন্য নৃত্য শুরু পাই জি এ মান্নানকে। দত্তদার কাছে অভিনয় সংলাপ উচ্চারণ শিখেছি।

চলার পথে কত হগুণীজনের আশীর্বাদ পেয়েছি, তাদের কাছে কত কী শিখেছি। তখন আমার বাসায় খুব আড্ডা হতো। তখনকার একমাত্র সিনেমার পত্রিকা চিত্রালী প্রকাশ হতো এস এম পারভেজের সম্পাদনায়। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক আনিস চৌধুরী এদের আড্ডার মধ্যমণি আমি। আমার শেখার জানার আগ্রহ খুউব। সেই ছোটবেলা থেকে আজ অবধি শিখছিই। সিনেমায় অভিনয়ের ব্যস্ততার মাঝে মার চেষ্টায় প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে ম্যাট্রিক পাস করি। পড়ার অভ্যেসটা সেই শৈশবেই যে রপ্ত হয়ে গিয়েছিল তা আজও যায়নি। বহু নমস্য মানুষের সান্নিধ্য যেমন পেয়েছি, চেষ্টা করেছি সবার থেকে কিছু না কিছু শিখতে। তাই কার্পণ্য করিনি শেখাতেও। আমার কাছে কেউ কিছু জানতে চাইলে আমিও চেষ্টা করি যথাসাধ্য সাহায্য করতে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় একবারও ভাবিনি আমি রাজনীতি করব। নতুন দেশ, নতুন মানুষ, নতুন যোদ্ধা। সব কিছুতেই নতুন সুগন্ধ ছড়াবারই কথা। নতুন বই নেড়েচেড়ে যেমন গন্ধ নিতাম, কিন্তু এ কী? তা না হয়ে কেমন টানাপোড়েনের মধ্যে চলচ্চিত্র শিল্পটি হাবুডুবু খেতে খেতে মান কমতে শুরু করে। স্বাধীন মাতৃভ‚মিতে কত কাজই তো করার ছিল, কিন্তু গাইডলাইন পাইনি। যেমন করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, তেমনি করেই আমি ভিড়ে যাই স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি রোধের সংগ্রামে। আমার ভাবতেই ভালো লাগে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা আর নির্বাচনে জিতে জাতীয় সংসদে সদস্য হয়েছি। এজন্য হাসিনা আপার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। মনে পড়ে, ঢাকা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সভায় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সাথে আমিও অংশ নেই, বক্তৃতাও করি। ভাবলে অবাক লাগে, জাহানারা খালাম্মা আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘কবরী প্রেসক্লাবের সামনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আমরা সভা ডেকেছি, আসবে কিন্তু।’ আমি গর্ববোধ করি উনার মতো এতো বড় একজন মানুষ আমার মতো ক্ষুদ্র একটা মানুষকে তাঁর পাশে বক্তৃতা দেবার সুযোগ দিয়েছিলেন। রাজাকারদের বিচারের দাবিতে বরাবরই নিবেদিত থেকেছি। দেখতে দেখতে কত সময় গড়িয়ে গেল। কত ঘটনার জন্ম এই এক জীবনে। এক জীবনে এতো কথা লেখা যায়?