Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

এই গল্প শুধুই ইমনের

ক’দিন আগেও তার নামটি এতো মানুষ জানতো না। নিজের পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ‘জালালের গল্প’ মুক্তি পাওয়ার পরই দর্শক মহল এবং শোবিজে তাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে।  ২০১৪ সালে ১৯তম বুসান চলচ্চিত্র উৎসবের এশিয়ান সিনেমা ফান্ড পায় ছবিটি। উৎসবটির ‘নিউ কারেন্টস’ বিভাগে প্রথম বাংলাদেশি ছবি হিসেবে বিশ্ব প্রিমিয়ার করে ছবিটি। একই বছরের নভেম্বরে ভারতের গোয়ায় অনুষ্ঠিত ৪৫তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (আইএফএফআই) প্রথমবারের মতো আয়োজিত হওয়া ‘অ্যা উইন্ডো অন সাউথ এশিয়ান সিনেমা’ বিভাগে একমাত্র বাংলাদেশি চলচ্চিত্র হিসেবে প্রদর্শনের জন্য মনোনীত হয়। এছাড়াও ভারতের রাজস্থানে জয়পুর চলচ্চিত্র উৎসবে মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে সেরা নবাগত নির্মাতার পুরস্কার পান এই নির্মাতা। ইরানের রাজধানী তেহরানে অনুষ্ঠিত ৩৩তম ফজর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও ছবিটি প্রদর্শিত ও প্রশংসিত হয়। পুর্তুগালের আভাস্কা চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি সেরা চলচ্চিত্র হওয়ার পাশাপাশি ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতা হন মোশাররফ করিম। দেশে ‘জালালের গল্প’ ছবিটি মুক্তি পায় ৪ সেপ্টেম্বর। চলচ্চিত্রে যুক্ত হওয়া, ভিন্নধারার ছবি নির্মাণ, বাংলা চলচ্চিত্রের নানান দিক নিয়ে পরিচালক আবু শাহেদ ইমন কথা বলেন আনন্দ আলো’র সঙ্গে। লিখেছেন- সৈয়দ ইকবাল।

আনন্দ আলো: ‘জালালের গল্প’ ছবিটির প্লটটা মাথায় এলো কিভাবে?

আবু শাহেদ ইমন: ২০০৯ সালের দিকে আমি সিডনী ফিল্ম স্কুলে পড়তাম। তখন আমার একটা গ্রাজুয়েশন ফিল্ম ছিল, ‘এ হোমমেড লাভ স্টোরি’। সেই প্রজেক্টটা করার সময় অনেকগুলো ট্রিটমেন্ট লিখেছিলাম। তার মধ্যে জালালের গল্প একটি। তবে তখন এটির নাম ছিল ‘জালালের পিতাগণ’। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ভাইয়ের সাথে বুসান উৎসবে এই গল্প নিয়ে আলাপ করি। তারপর আস্তে আস্তে অনেক সময় নিয়ে যতœ করে ফিল্মটা বানাই। আমি যখন এই গল্পটা চিন্তা করেছিলাম, তখন কিন্তু ভাবিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করবো। পরবর্তী সময়ে যখন আমি ইমপ্রেসের সঙ্গে এর গল্প সহ চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয়ে আলাপ করি, তখন ছবি নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়।

আনন্দ আলো: ছবিটিতে কোনো গান না রাখার কারন কী?

আবু শাহেদ ইমন: দেখুন, ৫/৬টা গান, ৩/৪টা মারামারির দৃশ্য কিংবা অ্যাকশন অথবা গোলাগুলি থাকলেই সেটাকে চলচ্চিত্র বলা যায়, আর খুব ঠান্ডা প্রকৃতির গল্প কিংবা নাটকীয় প্লট থাকলে সেটাকে ছবি বলা যাবে না পুরো পৃথিবীর কোথাও এমন কথা নেই। এক মিনিটের গল্পের ছবি সেটা যেমনি চলচ্চিত্র, তেমনি ৩০ মিনিট প্লটের ফিকশনও ছবি। বিজ্ঞাপনও কিন্তু ছবি। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, একেকটি ছবির একেকটা নাম থাকে। যেমন- এড ফিল্ম, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, পুর্ণ্যদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ফিকশন ইত্যাদি। কোনটা ফিল্ম আর কোনটা ফিল্ম না, সারাবিশ্বে আমাদের দেশের মতো যদি এমন বিভেদ থাকতো, বিশ্বে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, মাজেদ মাজেদী, স্পিল বার্গ, মার্টিন স্কোর্চ, ডেভিড মিলার, জহির রায়হানদের মতো কালজয়ী নির্মাতাদের জন্ম হতো না। এঁদের প্রত্যেকের সিনেমার আলাদা একটা ভাষা আছে, আলাদা গল্প বলার ধরণ আছে, নির্মাণের ভিন্ন ভিন্ন ম্যাসেজ আছে। কিন্তু অদ্ভুদ ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের দেশেই ফিল্মের কিছু ফরম্যাট বানানো হয়েছে। আর্ট ফিল্ম, টেলিভিশন ফিল্ম, বাণিজ্যিক ফিল্ম ইত্যাদি বলে একজন নতুন নির্মাতার Jalal__1_275410567ছবিকে দূরে  ফেলে দেয়া হয়। সম্ভবত এইটাই একমাত্র দেশ যেখানে সিনেমাকে ‘টিভি নাটক’ বলে খারিজ করে দেবার একটি বিশ্রি রকমের চেষ্টা করা হয়। পৃথিবীতে অনেক নামিদামি নির্মাতার ছবি আছে যেগুলো ক্ল্যাসিক ধরনের, অথচ আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব তাদের সেসব সিনেমাকেও সিনেমা মনে করেন না। এখানে পাঁচটা গান, তামিল ছবির গান চুরি করে, পাঁচটা নায়িকা নিয়ে নাচাচ্ছেন এবং সেই অবিশ্বাস্য গল্পটাকে সিনেমা বলছেন। আর যেটা বাস্তবতার নিরিখে নির্মিত সেটাকে নাটক বলছেন? এর চাইতে বড় রকমের ফানি কথা পৃথিবীর কোথাও শুনিনি। এ কারণেই নাটকের নির্মাতারা নিজের মনের মত গল্প নিয়ে সৎ সিনেমা নির্মাণে সাহস পাচ্ছেন না। বানালেও গতানুগতিক তিনটা পাঁচটা, গান, ফাইট, বড় পর্দার নায়ক বা নায়িকা তত্ত¡ উপস্থাপন করছেন, মানে ফরম্যাট থেকে বাইরে যেত পারছেন না। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক তরুণ নির্মাতা এবং আমার সমসাময়িক বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকেও এই বিষয়ে কথা শুনে থাকি। এমনকি আমার ‘জালালের গল্প’ মুক্তি পাওয়ার পর অনেকেই এমন নেতিবাচক কথা বলেছেন। কিন্তু আমি এসব কথায় তেমন পাত্তা দিচ্ছি না। আমার কাজ গল্প বলা। আমি সেই চেষ্টাটাই করে যাবো।  সিনেমায় গান রাখতেই হবে কেন? অনেক বড় ভাইয়েরা এই সংকট থেকে বের হতে পারেননি। রাখবনা, রাখছিনা বলতে বলতেও একটা গান রেখেছেই। আমি সেই প্যাটার্ন থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছি। আমি চেয়েছি গান ছাড়াও যে আসলে শুধু গল্প দিয়ে দর্শককে এক মিনিটের জন্যও বোরিং না করে হলে ধরে রাখা যায় সেটার প্রমাণ করতে। গানকে আসলে আর নতুন নতুন কোন কোন ফর্মে সিনেমায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় আমি বিষয়টি নিয়ে ভাবছি। আমার পরবর্তী ছবিতেই দর্শক তা দেখতে পাবেন।

আনন্দ আলো: আপনি তো বিশিষ্ট নির্মাতা তারেক মাসুদের সঙ্গেও কাজ করেছেন?

আবু শাহেদ ইমন: সিডনী ফিল্ম স্কুলে যাওয়ার আগে বাংলাদেশের মহান নির্মাতা তারেক মাসুদের সঙ্গে আমার কাজ করার সৌভাগ্য হয়। আমার চলচ্চিত্রের স্কুলিংয়ের মেজর ভিত্তি দুইটা। প্রথম ভিত্তি তারেক ভাই। তারেক মাসুদকে আমি চিনেছিলাম ‘মাটির ময়না’ দেখে। যাই হোক, তারেক ভাইয়ের সাথে দেখা করার আগে রীতিমত বিশাল ইন্টারভিউ দিতে হয়েছিল আমাকে। নানান প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে যখন তার সাথে পরিচয় হল তখন দেখেছি তারেক ভাই সিনেমা নিয়েই জীবন যাপন করতেন। তিনি সিনেমা নিয়েই পড়ে থাকতেন। তারেক ভাইয়ের সাথে ২০০৮ সালে কাগজের ফুলের জন্য কাজ শুরু করলেও সেটি না হওয়াতে পরবর্তীতে ‘রানওয়ে’তে কাজ করেছিলাম। আমাদেরকে তিনি সবসময় তার সিনেমার ভাবনাগুলো দিয়ে অনুপ্রাণিত করতেন। তিনি সবসময় চেয়েছেন আমাদের চিন্তাভাবনার ধরণটা যেন বাংলাদেশের বাস্তবতার নিরিখে হয়। তিনি বলতেন, এই দেশে ফর্মুলার বাইরে নিজস্ব চিত্রভাষা নির্মাণের জন্য বিরাট কলিজা লাগে। আর স্বাধীন গল্প বলার চেষ্টাটা বেশি জরুরি। আমার দূর্ভাগ্য ‘রানওয়ে’র শুটিং শেষ করবার আগেই বৃত্তি পেয়ে যাওয়াতে আমি শেষের দিকে ১/২টি লটে শুটিং এ থাকতে পারিনি। কিন্তু তার সাথে সবসময় যোগাযোগ ছিল। আমার প্রতিটি খবর তার সাথে  শেয়ার করতাম।

02_1আনন্দ আলো: একজন তরুণ নির্মাতা হিসেবে বলবেন- বাংলা সিনেমার কি কি সংকট আপনার চোখে পড়েছে?

আবু শাহেদ ইমন: সংকট তো অনেক রকমের, হাজার ধরনের। একান্তই আমার ব্যক্তিগত অভিমত থেকে বলবো। বর্তমানে আমাদের চলচ্চিত্রের নিজস্ব কোনো চরিত্র নেই। প্রায় অধিকাংশই তামিল বা হিন্দি সিনেমার কার্বন কপি। মৌলিক গল্প দিয়ে একসময় আমাদের পরিচালকদের দর্শকদেরকে মুগ্ধ করবার যে প্রয়াস ছিলো সেটা এখন আর তেমন দেখা যায় না। আমরা অন্যের ভালোটা দেখতে পারিনা। অন্যের কাজকে কেউ স্বীকৃতি দেইনা। নিজের কাজকেই কেবল শ্রেষ্ঠ মনেকরি। তারেক ভাইয়ের রানওয়ে ছবির একটি ডায়ালগ মনে পড়ে গেলো, ‘এইদেশে এত মত এত পথ, কোনটা যে আসল, সত্যি বোঝা খুবই মুশকিল’।

আনন্দ আলো: পরবর্তী ছবি নিয়ে কি ভাবছেন?

আবু শাহেদ ইমন: আবার কোরিয়ায় ফিরে যাব। একটা সেমিস্টার এখনো পড়া বাকি। ফিরে এসে ‘স্টোরি অব আ পুলিশম্যান’-এর কাজ শুরু করব। এছাড়াও গ্রাজুয়েশন ফিল্ম বানাচ্ছি। ফিচার ফিল্ম ডেভেলপ করছি। ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং আমার সামাজিক জীবনে সিনেমা নিয়ে হাজার হাজার পরিকল্পনা রয়েছে। যতোদিন বেঁচে থাকবো ততোদিন সিনেমা নিয়েই জীবন-যাপন করতে চাই।