Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

উত্তম ভালোবাসা

রেজানুর রহমান: ভালোবাসা আসলে কী? কাউকে দেখে ভালো লাগলো সেটাই কী ভালোবাসা? হেঁটে যাচ্ছে একটি মেয়ে অথবা একটি ছেলে তাদেরকে এক ঝলক দেখেই মন ভালো হয়ে গেল। এটাই কী ভালোবাসা? একটি ছেলে প্রতিদিন সকাল, বিকাল যখনই সময় পায় বাড়ির ছাদে ওঠে। পাশের বাড়ির ছাদে কাউকে খোঁজে। যেদিন তাকে দেখতে পায় সেদিন তার মনের ভেতর আনন্দ উৎসবের ঢেউ ওঠে। আর যেদিন দেখতে পায় না সেদিন কষ্টের ঢেউ উথাল-পাতাল করে মনের ভেতর। এটাও এক ধরনের ভালোবাসা। আবার এমনও হয় সেই ছোটবেলা থেকে পাশাপাশি কাছাকাছি বেড়ে উঠছে দু’জন। কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্য। কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় প্রতিদিনই কাছাকাছি, পাশাপাশি কেটেছে দু’জনের। ‘তুই’ সম্মোধনে কথা বলে দু’জন। একে অপরকে ভালোবাসে। অথচ একদিনও মুখ ফুটে বলা হয়নি। অতঃপর একদিন মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়। তখন দু’জন বুঝতে পারে ভালোবাসার রঙ কেমন, ভালোবাসার শক্তি কেমন। আবার এমনও হয় অসম্ভব রকমের ভালোবাসায় জড়িয়েছে দু’জন। একজনকে ছাড়া অন্যজনের যেনো চলেই না। সকালে দেখা হয়েছে। তবুও বিকেলে দেখা হতেই হবে। হয়তো সারাদিন একসাথে থাকার পরও ছেড়ে যেতে মন চায় না। শুধুই মনে হয় আরেক দণ্ড থাকি। হাতে হাত রেখে বসে থাকা ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কথা নাই। মাঝে মাঝে চোখ ফেলে তাকানো। মৃদু হাসি। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আদর করা। অজানেত্ম মনের ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসে সেই প্রচলিত প্রেমের বাণী- তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। বলো… আমাকে ছেড়ে তুমি চলে যাবে না… বলো…

প্রতিদিন নতুন করে প্রতিজ্ঞা। না, না তোমাকে ছেড়ে আমি কোথায় যাবো? তুমিই তো আমার পৃথিবী। আমার সাহস, আমার চলার পথের সঙ্গী। অসম্ভব তোমাকে ছাড়া আমি একদণ্ডও কল্পনা করতে পারি না।

অথচ হঠাৎ একদিন… অকস্মাৎ… ভেঙে যায় সম্পর্কের বাঁধন। ছোট ঘটনা অথবা তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে মন কষাকষি- তুমি এটা করতে পারলে… তুমি…? আমি থাকবো না তোমার সাথে… গুডবাই…

এভাবেও ভালোবাসা ভেঙে যায়। আবার এমনও হয় যাকে ভালোবেসেছি তাঁকে আর ছাড়বো না। শতকষ্টেও তার সাথে থেকে যাবো। ভালোবাসার এমন নজীর ভুঁড়ি ভুঁড়ি। এক দম্পতির কথা জানি। ভালোবেসে বিয়ে করেছে। সংসার শুরু করার পর এক পর্যায়ে মতের অমিল দেখা দেয়। তাই বলে নিজেদেরকে ছেড়ে যায়নি তাঁরা। তাঁদের সংসারে এখন ছেলে বউ, নাতি নাতনীদের রাজত্ব। এতবড় সংসার অথচ কেউ জানে না সংসারের শেকড়ে একটা ব্যথা হয় মাঝে মধ্যে। ব্যথাটা বুঝতে দেয় না বড়োবুড়ি। কেন দেয় না জানেন? সংসারের প্রয়োজনেই। তারা প্রতিদিনই চেষ্টা করে সংসারের উত্তম ভালোবাসার শক্তি ছড়িয়ে দিতে। কারণ ভালোবাসাই একটি সংসারের অগ্রগতির মূলমন্ত্র। আর সেটা যদি হয় উত্তম ভালোবাসা তাহলে তো কথাই নেই।

আবারও সেই প্রশ্নটাই করি- ভালোবাসা আসলে কী? ভালোবাসার কী কোনো রঙ আছে। নাকি আছে কোন বিশেষ ফর্মুলা? এই যে আমরা উত্তম ভালোবাসার কথা বলছি সেটাই বা কেমন?

ভালোবাসা নিয়ে হেলাল হাফিজের একটা কবিতার লাইন এরকম- তোমার জন্য সকাল, দুপুর তোমার জন্য সন্ধ্যা, তোমার জন্য সকল গোলাপ এবং রজনীগন্ধা। তার মানে কী! তোমার জন্য সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, রাত্রি… তোমার জন্যই তো সব… এটাই কী উত্তম ভালোবাসা? হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন- ভালোলাগা এমন এক জিনিস যা একবার শুরু হলে সব কিছুই ভালো লাগতে থাকে…

02_3তার মানে এটাই কী উত্তম ভালোবাসার লক্ষণ? নির্মলেন্দু গুণের মতে, ভালোবাসি বলে দেব স্ট্রেটকাট, আবার যখনই দেখা হবে…

এটাকে কী বলব? ভালোবাসা এখনও উত্তম হয়ে উঠেনি। অর্থাৎ ভালোবাসা তার শক্তি পায়নি এখনও। আবার যদি সুনীলের কবিতার সেই লাইন ক’টি পড়ি তাহলে কী উত্তম ভালোবাসাকে উপলব্ধি করা যাবে- দূরনত্ম ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়, বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টি নীলপদ্ম। তবুও কথা রাখেনি বরুণা…

এই যে ‘কথা রাখা না রাখা’ এটাই আসলে উত্তম ভালোবাসার প্রাণশক্তি। কথা দিয়েছি আমি তোমার সাথে থাকব। কাজেই আমি আছি… বর্তমান যুগে কতজন কথা দিয়ে কথা রাখে? কতজন সাথে থাকবে বলে সাথে সাথেই হাঁটে?

চলমান চিত্রটা ভালো না। মোটেই ভালো না এই যে সাথে থাকা না থাকার চিত্রটা। তাই বলে কী ভালোবাসা হারিয়ে গেছে? কেউ কী কাউকে ভালোবাসছে না? কেজি মুসত্মফার সেই গানের লাইনের মতো- তোমারে লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে, রাতের বাসরে দোসর হয়ে তাই সে আমার টানে… ভালোবাসার এমন শক্তি কী এখন নেই? আছে অবশ্যই আছে। তবে ভালোবাসার রঙ পাল্টেছে। প্রকাশের ভঙ্গি পাল্টেছে। আর তাই কোনটা উত্তম ভালোবাসা তা সহজেই বলে দেয়া যায় না।

ভালোবাসার কথা উঠলেই বাংলা ছবির মহানায়ক উত্তম কুমারের নাম সবার আগে উঠে আসে। একথাতো সত্য উত্তমকে ভালোবেসে বাংলা ছবি দেখার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে বাঙালি দর্শক। উত্তম ভালোবাসায় যুক্ত হন বাংলা ছবির কিংবদনত্মী নায়িকা সূচিত্রা সেন। এক পর্যায়ে উত্তম-সূচিত্রার ছবি ভালোবাসার ‘উত্তম সূত্র’ অথবা প্রেরণা হয়ে ওঠে। ছবিতে উত্তম আর সূচিত্রাকে দেখে দর্শক বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা তাঁদের মতোই হবার চেষ্টা শুরু করে। তরুণেরা এক একজন উত্তম কুমার আর তরুণীরা এক একজন সূচিত্রা সেন হবার অদৃশ্য প্রতিযোগিতা শুরু করে। একসময় বাঙালির সমাজ জীবনে উত্তম- সূচিত্রার চলচ্চিত্র জুটি উত্তম ভালোবাসায় পরিণত হয়। ভালোবাসলে হয় উত্তমের মতো না হয় সূচিত্রার মতোই ভালোবাসব।

আজও বাঙালির সমাজ জীবনে উত্তম-সূচিত্রার উত্তম ভালোবাসার রসায়ন আগের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। কেন গুরুত্বপূর্ণ? কারণ আমরা মনেপ্রাণে উত্তম ভালোবাসাকেই লালন করতে চাই। ভালোবাসার রঙিন পৃথিবী গড়তে চাই।

১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষে পৃথিবীব্যাপী ভালোবাসাবাসির একটা মহাউৎসব শুরু হয়েছে। যদিও আমরা একটা দিনের মধ্যে ভালোবাসাকে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না। তবুও থাকুক না একটা দিন শুধুই ভালোবাসার দিন। দিনে দিনে এটি হয়ে উঠুক ভালোবাসার জন্মদিন।

 শুধুই উত্তম

Uttam-Kumarজাকীর হাসান: ‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো’… মোটর সাইকেলে উত্তম কুমার, পেছনে সুচিত্রা সেন। ‘সপ্তপদী’ সিনেমার সেই গান বাঙালি দর্শকের কাছে রোমান্টিক মুহূর্তের চিরনত্মন দৃশ্য। প্রেমের পথে অহর্নিস যাত্রার নায়ক-নায়িকা তারা। বাঙালি প্রেমিক-প্রেমিকার কাছে এ চলা অনত্মহীন। সেই যাত্রাপথের উত্তম-সুচিত্রার রোমান্টিক জুটি তাই দর্শকের হৃদয়ে পেয়েছে অমরত্বের মর্যাদা।

অনেকে বলেন বাঙালি দর্শক প্রেম করতে শিখেছে উত্তম-সুচিত্রার রোমান্টিক দৃশ্য দেখে। বাঙালি দর্শকের কাছে রোমান্টিকতার একমাত্র উদাহরণ তারা। এ দু’জনের মাঝেই বাঙালি দর্শক নিজেদের প্রেমকে মূর্ত হতে দেখেছে। রূপালি পর্দায় সুচিত্রা সেনকে দেখে একজন ছেলে তার প্রেমিকাকে নিয়ে কল্পনার জাল বুনেছে। তাই রূপালী পর্দায় বাঙালি দর্শকের কাছে আজ পর্যনত্ম আর কোন জুটিই এ দুজনের রোমান্টিকতার মিথ ভাঙতে পারেনি। পর্দায় এ দুজনের রোমান্টিকতা যেভাবে ফুটে উঠতো তা আর কারো সঙ্গেই হয়নি।

পরিচালকরা যে চেষ্টা করেননি তা নয়। উত্তম কুমারকে অন্য নায়িকার বিপরীতে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা কম করেননি তারা। কিন্তু সব চেষ্টাই বিফলে গেছে। উত্তম যেন সুচিত্রাতেই সমর্পিত। সুচিত্রা ছাড়া সেই রোমান্টিক অভিনয় আসে না। সুচিত্রাও তাই, উত্তম ছাড়া তার সেই চোখের চাহনির ধার যেন ঝলসায় না। উত্তম কুমার না থাকলে ভুরুর নাচনে যেন নেই সেই ছন্দ। থুতনি উঁচু করে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসিতে যেন মুক্তো ঝরে না যদি না বিপরীতে থাকেন উত্তম কুমার।

উত্তম-সুচিত্রা এ দুটি নাম যেন একসূত্রে গাঁথা। দুটি ছেলে-মেয়ের সম্পর্ক এখনো প্রেমে গড়ায়নি কিন্তু দুজনের চোখেই ভালোবাসার ঝিলিক। দুজনের কথার পিঠে কথা, কথা কাটাকাটি। দর্শককে আনন্দে উদ্বেল করেছে। দু’জনের সম্পর্ক হওয়ার পর রোমান্টিক দৃশ্যগুলো প্রেমের স্পর্শে বিবশ করেছে। আর শেষ দৃশ্যে দু’জনের মিলনে বাংলার দর্শকরা পরিতৃপ্তি নিয়ে ঘরে ফিরেছে।

সুচিত্রা সেন উত্তম কুমারের বিপরীতে প্রথম অভিনীত চলচ্চিত্র ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৩ সালে। এরপরে ১৯৫৪ সালে মুক্তি পায় দু’জনের সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র ‘অগ্নি পরীক্ষা’। এই চলচ্চিত্র মুক্তি পাবার পর সেই যে তাদের জুটি মানুষের হৃদয়কে দিয়েছিল এরপর তা চির আসন লাভ করেছিল। এরপর একের পর এক মুক্তি পেয়েছে এই জুটির সাড়া জাগানো সব চলচ্চিত্র। শাপমোচন (১৯৫৫), সাগরিকা (১৯৫৬), পথে হল দেরি (১৯৫৭), হারানো সুর (১৯৫৭), রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকানত্ম (১৯৫৮), সপ্তপদী (১৯৬১), বিপাশা (১৯৬২), চাওয়া পাওয়া, গৃহদাহ (১৯৬৭), হার মানা হার (১৯৭১), নবরাগ (১৯৭১), আলো আমার আলো (১৯৭২), প্রিয় বান্ধবী (১৯৭৫) প্রভৃতি। শুধু রূপালী পর্দাতেই নয় উত্তম কুমারের সঙ্গে সুচিত্রার সম্পর্ক পর্দার বাইরেও ছিল অত্যনত্ম গভীর। ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই উত্তম কুমারের যখন মৃত্যু হয় সুচিত্রা সেন তখন স্বেচ্ছা নির্বাসন বেছে নিয়েছেন। কিন্তু তার আজীবনের রূপালী পর্দার সঙ্গীকে শেষবার দেখার জন্য সেই নির্বাসন ভেঙে বেরিয়ে আসেন তিনি। মাঝ রাত পর্যনত্ম বসে ছিলেন তার মৃতদেহের পাশে। শবযাত্রা দাহ করার আগে মরদেহে তার স্ত্রীর মালা পরাবার নিয়ম আছে। এ সময় উত্তম কুমারের স্ত্রী সেই মালা সুচিত্রার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘সারাজীবন ধরে তো ওকে পর্দায় মালা পরিয়েছো, ওর শেষ যাত্রায় অনত্মত তুমি বাসত্মবে মালা পরাও।’ শুধু বাঙালি দর্শকের হৃদয় রাঙাতে রূপালী পর্দাতেই নয়, শেষ যাত্রাতেও দুজন একে অন্যকে ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে রেখেছিলেন।

অরুণকুমার থেকে উত্তমকুমার: আগের দিন ডাক্তার সেজে ক্যামেরার সামনে প্রথম দাঁড়াতে গিয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তার। হাসাহাসির শিকার হয়েছেন টেকনিসিয়ানদের কাছে। পরের দিন স্টুডিওতে ঢুকছেন। শুনতে পেলেন পেছন থেকে একজন বলছে ‘হিয়ার কাম্‌স নিউ দুর্গাদাস।’ একবার ভাবলেন ছেড়েই দেবেন ফিল্মের কাজ। ফিরে যাবেন সেই পুরনো পোর্ট কমিশনার্স-এর অফিসে। তারপর কী ভেবে ঘুরে দাঁড়ালেন। অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়। পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে অফার করলেন তাঁদের, যারা একটু আগেই তাকে স্টুডিওতে ঢুকতে দেখে ব্যঙ্গ করছিল। সিগারেট শেষ হতে না হতেই একটু আগের প্রতিক্রিয়াগুলোও গেল বদলে। তোমার এলেম আছে। হলেও হতে পারো কিছু একটা, এরপর তাঁদের চা খাওয়ালেন অরুণ। চলল টোস্ট, ডিমের ওমলেটও। যারা আগের দিন বলেছিলেন ওর দ্বারা অভিনয় করা সম্ভবপর হবে না, একেবারে গেয়ে, তাঁরাই মনিটরের সময় ‘বাঃ চমৎকার’, ‘বেস্ট অ্যাকটিং’ বলে উৎসাহিত করলেন। কেউ কেউ তো পরিচালককে বলেও ফেললেন, এই ছবি যদি আপনার চলে তো ওরই জন্য চলবে। অরুণকুমার তখনও উত্তমকুমার হননি।

১৯২৬ সালে ৩ সেপ্টেম্বর জন্মেছিলেন অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। তবে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন বাঙালির ‘মহানায়ক’ উত্তম কুমার নামে। মামাবাড়ি কলকাতার আহিরিটোলা। পৈত্রিক বাড়ি ভবানীপুরের গিরিশ মুখার্জি রোড। শৈশব কাটে সেখানেই। কলেজে পড়া শেষ না করেই চাকরি শুরু করেন কলকাতা বন্দরে। সেই সময় থেকেই তাঁর থিয়েটারে হাতেখড়ি। তারপর সিনেমার পর্দায় পথচলা।

কলকাতার স্টুডিও পাড়ায় নায়কোচিত ব্যবহারের কথা উঠলেই বহুবার বলা হয় একটা গল্প। একদিন স্টুডিওর সামনে থেকে গাড়িতে পেট্রোল নিচ্ছিলেন অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। গাড়িতে বসে না থেকে তিনি গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ ঘটনা দেখে পরে উত্তমকুমার তাঁকে বলেন, নায়করা যদি এভাবে রাসত্মায় ঘুরে বেড়ায় তবে দর্শকের সেই নায়কের সম্পর্কে আগ্রহ কমে যায়।

এরকম আরও একটি ঘটনা, কোনো এক অনুষ্ঠানে উত্তমকুমারের নিরাপত্তার জন্য অনেক উঁচু মঞ্চ করা হয়েছিলো। মঞ্চে উঠে উত্তমকুমার দেখতে পান, এক নারী তাঁকে দেখার জন্য একটি বাড়ির কার্নিশ ধরে ঝুলছেন। তিনি তাকে নেমে আসতে বলেন। ওই নারী জানান তার পড়ে যাওয়ার ভয় নেই, কারণ তিনি তার স্বামীর ঘাড়ে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শুধু উত্তম কুমারকে দেখার জন্য।

একটি বিতর্কিত ঘটনা আজ পশ্চিমবঙ্গে মুখে মুখে আলোচিত। যদিও উত্তমকুমারের তরফ থেকে কোনোদিনই এ ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে কোনো বক্তব্য আসেনি। তবে সেই সময়ের অনেক মানুষ এ ঘটনাকে সত্যি বলে মনে করেন।

সেই সময় কলকাতায় চলছে নকশাল আন্দোলন। এই সময়ে কোনো একদিন অভ্যাস মতো খুব ভোরে কলকাতা ময়দানে হাঁটতে গেছেন মহানায়ক। সেখানে তিনি নাকি দেখেন এক নকশাল নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। এরপর কিছুদিন ভয়ঙ্কর ‘ট্রমা’-তে ছিলেন উত্তম কুমার। এ ঘটনার প্রভাবে তিনি নাকি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। যা থেকে বের হতে তার অনেক সময় লেগেছিলো।

মহানায়ক উত্তম কুমার রবীন্দ্রসঙ্গীতের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। সময় পেলেই তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা করতেন। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার হরিণ চাই’, ‘অনেক কথা বলেছিলেম’, ‘তুমি ধন্য ধন্য হে’ এবং ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী’ গানগুলো তার মন-প্রাণকে ভাবিয়ে তুলত। এ গানগুলো তিনি রেকর্ডও করেছিলেন। কিন্তু তা এতদিন অপ্রকাশিত ছিল। অবশেষে উত্তম কুমারের মৃত্যুর ৩২ বছর পর সেগুলো উদ্ধার করেছে ‘মেগাফোন’ ও ‘পেরিনিয়াল রেকর্ডস’ প্রযোজনা সংস্থা।

গান শেখার মধ্যে দিয়েই অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়ের উত্তমকুমার হয়ে ওঠার প্রসত্মুতিটা শুরু হয়েছিল। তখন প্লে-ব্যাক পদ্ধতি সেভাবে চালু হয়নি। সিনেমায় নায়ক হওয়ার প্রথম শর্তই ছিল, ভালো গায়ক হওয়া চাই। তাই শৈশব থেকেই গান শেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন উত্তমকুমার।

ক্যারিয়ারের শুরুতে তিনি নিদানবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বেশ কয়েকজন সঙ্গীতগুরুর কাছে গানের তালিমও নিয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে উত্তমকুমার দেবকীকুমার বসুর ‘নবজন্ম’ ছবিতে নচিকেতা ঘোষের সুরে ছয়টি গান গেয়েছেন। সেসব পরে অ্যালবাম আকারে প্রকাশও হয়েছিল। গান গাওয়ার পাশাপাশি তিনি নিজে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন ‘কাল তুমি আলেয়া’ ছবিতে। কিন্তু উত্তমকুমারের গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত, সে কথা তখন কেউ কল্পনাও করেননি। কিন্তু এ কল্পনাতীত ঘটনাই বাসত্মবে ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ইতিহাসে সংযোজিত হয়েছে আরেকজন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর নাম। তিনিই মহানায়ক উত্তমকুমার। সম্প্রতি মেগাফোন থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের চার সিডির অ্যালবাম ‘আমাদের যাত্রা হলো শুরু’র শেষ দুটি গানের শিল্পী স্বয়ং উত্তমকুমার। প্রযোজনা সংস্থাটির ‘অপ্রকাশিত রেকর্ডিং’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে উত্তমকুমারের কণ্ঠে ‘আমার সোনার হরিণ চাই’ ও ’অনেক কথা বলেছিলেম’ গান দুটি। অন্যদিকে ‘পেরিনিয়াল রেকর্ডস’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে উত্তমকুমারের গাওয়া আরো দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘তুমি ধন্য ধন্য হে’ এবং ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী’।

02_1উত্তম-সুপ্রিয়া দেবী: ভালোবাসার মানুষকে আপন করে নেওয়ার পথে সমাজ, সংসারের কোনো বাধাই মানেননি মহানায়ক। লোকনিন্দা, অপবাদ সবকিছু মাথা পেতে নিয়েও জীবনের সতেরটি বছর একসঙ্গেই বসবাস করে গেছেন উত্তম কুমার ও সুপ্রিয়া দেবী। আইনত বিয়ে করতে পারেননি কিন্তু বিবাহিত দম্পতির মতোই পরস্পরের প্রতি বিশ্বসত্ম ছিলেন তাঁরা।

উত্তম কুমার তার অভিনয়, নায়কোচিত সৌষ্ঠব ও তারকাদ্যূতিতে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ আসনটি দখল করে আছেন। চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই ১৯৪৮ সালে ২৪ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন একই পাড়ার মেয়ে ও বান্ধবী গৌরী দেবীকে। তিনি তখন আলিপুর ডকে চাকরি করতেন। গৌরীর সঙ্গে বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসা। অন্যত্র তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শুনে ঝোঁকের মাথায় হুট করেই পালিয়ে বিয়ে করেন তাকে। ১৯৫০ সালে তাদের একমাত্র সনত্মান গৌতমের জন্ম হয়।

অরুণ অভিনয় করুক এটা খুব একটা পছন্দ করতেন না গৌরী দেবী। কিন্তু অভিনয়ের নেশা ছিল তার রক্তে। তাই পাড়ার থিয়েটার থেকে চলচ্চিত্রজগতে প্রবেশ করে অনেক সংগ্রামের পর নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন উত্তম কুমার। জনপ্রিয়তা পান আকাশচুম্বী। তবে খ্যাতি পেলেও দাম্পত্য জীবনে সুখি ছিলেন না তিনি। কারণ গৌরী দেবী তার শিল্পী সত্তার তেমন কোনো মূল্য দিতেন না। উত্তমকুমার একটি স্মৃতিচারণে লিখেছিলেন কোনো নতুন ছবির চুক্তিপত্রে সই হলে সে কথা যখন তিনি ঘরে ফিরে বলতেন তখন চরিত্র বা গল্প সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করার আগে প্রথমেই তার স্ত্রী জিজ্ঞাসা করতেন, ‘কত দেবে?’ নায়ক উত্তমের পাশে গৌরী ছিলেন নিতানত্মই সাদামাটা। দু’জনের মধ্যে মানসিক দূরত্ব দিন দিন বাড়তে থাকে। দাম্পত্য জীবনে অসুখি উত্তম তাই ছবির জগতেই খুঁজে নেন নিজের বন্ধু-বান্ধব।

অভিনয় জীবনের প্রথমদিকে যখন একের পর এক ছবি ফ্লপ হচ্ছিল তখন ‘বসু পরিবার’ সিনেমায় এক যৌথ পরিবারের আদর্শবাদী বড় ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করে তিনি দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এ সিনেমায় সুপ্রিয়া দেবী ছিলেন তার বোনের ভূমিকায়। এটিই উত্তম-সুপ্রিয়া অভিনীত প্রথম ছবি।

সুপ্রিয়া দেবী স্মৃতিচারণে বলেছেন এগারো বছর বয়সে কলকাতার গিরীশ মুখার্জি রোডে তিনি উত্তম কুমারকে প্রথম দেখেন সতেরো-আঠারো বছরের এক তরুণ হিসেবে। তিনি ছিলেন বড় ভাইদের বন্ধু। সুপ্রিয়া (ডাক নাম বেণু, পারিবারিক নাম কৃষ্ণা) তখন থাকতেন তার বাবার কর্মস্থল বার্মায় এখন মিয়ানমার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি বোমাবাজির ভয়ে সব সম্পদ ত্যাগ করে উদ্বাসত্মু হয়ে তার পরিবার চলে আসেন কলকাতায়। ‘বসু পরিবার’ ছবিতে অভিনয় করার পর ১৯৫৪ সালে তার বিয়ে হয়ে যায় বিশ্বজিৎ চ্যাটার্জির সঙ্গে। বিয়ের পর অভিনয় ছেড়ে দেন তিনি। কিন্তু বিশ্বজিতের সঙ্গে তার দাম্পত্যজীবন সুখের হয়নি। একমাত্র সনত্মান সোমার জন্মের পর তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে তিনি আবার রূপালিভুবনে ফিরে আসেন।

১৯৬০ সালে মুক্তি পায় উত্তম-সুপ্রিয়া জুটির ব্যবসাসফল ছবি ‘শুন বরনারী’। সহশিল্পী হিসেবে দু’জনের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। দুজনেরই ব্যক্তি জীবনের শূন্যতা থেকে জন্ম নেয় প্রেম। এই প্রেম ছিল পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। উত্তমের ওপর সব কিছুর জন্যই ভীষণভাবে নির্ভর করতেন সুপ্রিয়া। অনেক সময় একসঙ্গে শুটিংয়ে যাওয়া-আসা করতেন তারা। এই নিয়ে স্ত্রী গৌরী দেবীর সঙ্গে উত্তম কুমারের দাম্পত্য কলহ চরম আকার ধারণ করে। অন্যদিকে সুপ্রিয়ার মধ্যে তিনি খুঁজে পান বিশ্বসত্ম বন্ধু, নির্ভরযোগ্য সহকর্মী এবং তার শিল্পী সত্তার অনুরাগীকে।

১৯৬৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর গিরীশ মুখার্জি রোডের পৈতৃক বাসভবন থেকে উত্তম কুমার চলে আসেন সুপ্রিয়া দেবীর ময়রা রোডের ফ্ল্যাটে। জীবনের বাকি সতেরটি বছর তিনি সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গেই অতিবাহিত করেন। কেমন ছিল তাদের জীবন? সুপ্রিয়া দেবী তার স্মৃতিকথা ‘আমার জীবন আমার উত্তম’-এ সেকথা অনেকভাবেই বলেছেন। তার ভাষ্যে জানা যায়, ১৯৬২ সালের ২ ডিসেম্বর তাদের বিয়ে হয় ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায়। বিয়েতে সুপ্রিয়ার বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও উত্তম কুমারের কয়েকজন বন্ধুও ছিলেন। ৫ ডিসেম্বর তারা বিবাহত্তোর অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন যেখানে চলচ্চিত্র জগতের প্রচুর অতিথির সমাগম হয়।  তবে গৌরী দেবীর সঙ্গে আইনগতভাবে বিচ্ছেদ না হওয়ায় তারা বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে পারেননি। স্বামী হিসেবে উত্তম নাকি ছিলেন খুব রোমান্টিক এবং কখনও কখনও বেশ ঈর্ষাকাতর। উত্তমের বারণ মেনেই হিন্দি ছবির জগত ত্যাগ করেন সুপ্রিয়া। বাড়িতে প্রযোজক ও পরিচালকদের বেশি আসা-যাওয়া এবং সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে আড্ডা একেবারেই পছন্দ করতেন না তিনি। তবে উত্তমের নারী সহকর্মী, ভক্ত কিংবা উঠতি নায়িকাদের মাত্রাতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতাতেও ঈর্ষা বোধ করতেন না সুপ্রিয়া। কারণ তিনি জানতেন উত্তম এদের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহী নন। এমনকি সুচিত্রা সেনকেও ঈর্ষা করেননি। পর্দায় সুচিত্রা-উত্তমের রোমান্টিক দৃশ্য দেখেও তিনি বুঝতেন সেটা নিছক অভিনয়।

মানুষের হৃদয়ে পৌঁছানোর সেরা পথ নাকি পাকস্থলীর ভিতর দিয়ে। এটা সুপ্রিয়া দেবীর বেলায় খুব সত্যি। তাই নিত্য নতুন রান্না করতে ভালোবাসতেন তিনি। আর মহানায়ক ভালোবাসতেন সেসব খেতে। সুপ্রিয়ার হাতের রান্নার দারুণ ভক্ত ছিলেন তিনি।

উত্তম-সুচিত্রা জুটির মতো না হলেও উত্তম-সুপ্রিয়া জুটিও বহুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। উত্তম-সুপ্রিয়া অভিনীত ‘চিরদিনের’, ‘বনপলাশীর পদাবলী’, ‘কাল তুমি আলেয়া’, ‘লাল পাথর’, ‘শুন বরনারী’, ‘মন নিয়ে’, ‘শুধু একটি বছর’, ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ইত্যাদি সিনেমা ব্যবসাসফল হওয়ার পাশাপাশি সমালোচকদের প্রশংসাও পায়। বিশেষ করে ‘চিরদিনের’ উত্তম-সুপ্রিয়া অভিনীত দারুণ রোমান্টিক ছবিটি।

উত্তমের জীবনে সুপ্রিয়া ছাড়া আর কোনো নারী যেমন ছিলেন না, তেমনি সুপ্রিয়ারও জীবনে আর কোনো প্রেম আসেনি। ১৯৮০ সালে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর থেকে এখনও একাই পথ হাঁটছেন সুপ্রিয়া দেবী। যৌথ জীবনে নেক অপবাদ ও লোকনিন্দা সহ্য করতে হয়েছে উত্তম কুমার ও সুপ্রিয়া দেবীকে। কিন্তু তাদের প্রেম যে সত্যিই চিরদিনের তা সময়ের কষ্টি পাথরে প্রমাণিত হয়েছে।