Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

ইটভাটার আগুন পরিবেশের গায়-মুকিত মজুমদার বাবু

অন্যান্য মৌসুমে কম বেশি ইটভাটায় আগুন জ্বললেও বৃষ্টি না থাকার কারণে শীতকালে ইট তৈরির কাজ জোরেশোরে শুরু হয়। এবারো তার ব্যতিক্রম নয়। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে ছোট-বড় শহরগুলোর আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গড়ে উঠেছে বৈধ-অবৈধ হাজার হাজার ইটভাটা। ইটভাটার বিষাক্ত গরম বাতাস আর কুণ্ডুলি পাকানো কালো ধোঁয়া পরিবেশকে করে তুলছে বিপর্যস্ত। ইটভাটাগুলোতে ইট পোড়ানোর জন্য যে ধোঁয়া সৃষ্টি হয় তা বায়ুুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি কল-কারখানা ও অন্যান্য কারণে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইডের ফলে ক্রমশ উপ্তত্ত হয়ে উঠছে পৃথিবী। বৃদ্ধি পাচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। বরফ গলছে। অতিরিক্ত বৃষ্টি ও বন্যা হচ্ছে। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে মৃত্যু হচ্ছে হাজার হাজার মানুষের। ইটভাটার আশপাশে যারা বসবাস করছে তারা নানা ধরনের কঠিন ও জটিল অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে হাঁপানি, চর্মরোগ, কিডনি বিকল, ফুসফুসের ক্যান্সার ইত্যাদি রয়েছে।

ইটভাটার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে কৃষক। অসচেতনতার কারণে তারা জমির টপসয়েল বিক্রি করে দিচ্ছে ইটভাটার মালিকদের কাছে। ফলে ওই আবাদি জমি এক রকম অনাবাদি পড়ে থাকছে বছরের পর বছর। এর কারণ হলো ফসল উৎপাদন করার জন্য যে ৫ ভাগ জৈব উপাদান থাকা দরকার, তা থাকে সাধারণত মাটির ওপরে ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি গভীর পর্যন্ত। জমির টপসয়েল থেকে চাষ করা উদ্ভিদ তার খাদ্য আহরণ করে। যখন কৃষি জমির টপসয়েল ইটভাটায় চলে যায় তখন ওই জমি থেকে ভালো ফসল আশা করা যায় না। জমির উর্বরাশক্তি ফিরে আসতে অনেক সময় লাগে। কৃষিবিদ ও মৃত্তিকাগবেষকদের মতে, স্বাভাবিক নিয়মে জমির উপরিভাগে পলি জমে জমে এক ফুট পুরু হতে সময় লাগে তিন থেকে চার দশক। তবে তা সব অঞ্চলে নয়। আর ইটভাটা যে পরিমাণ ফসলি মাটি ধ্বংস করছে তা খাদ্য নিরাপত্তায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হুমকি স্বরূপ।

ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহারের আইন থাকলেও নির্বিচারে পোড়ানো হচ্ছে রাস্তার পাশে থাকা সরকারি বিভিন্ন গাছ, বাঁশের মোথা, খেজুর গাছসহ নানা প্রজাতির কম দামি গাছ। এর ফলে জীববৈচিত্র্য যেমন হুমকির মুখে পড়ছে তেমনি হুমকির মুখে পড়ছে মানুষের স্বাস্থ্য। কোনো কোনো অঞ্চলে সরকারি বন উজাড় করা হচ্ছে ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে। আর এ সবই হচ্ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ম্যানেজ করে। দেশের অনেক ইটভাটা ‘ইটভাটা আইন’-এ অবৈধ হলেও চলছে বছরের পর বছর। আর এটা হচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অপতৎপরতায়। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, বনাঞ্চল ও জনবসতিপূর্ণ এলাকার তিন কিলোমিটারের বাইরে এবং অকৃষি জমিতে ইটভাটা স্থাপনের নিয়ম রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিপত্র অনুযায়ী, ১২০ ফুট চিমনির ভাটা তৈরি নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। শুধু হাওয়াই ঝিকঝাক ইটভাটা (পরিবেশবান্ধব) তৈরির জন্য সনদ দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। তারপরও এই নিয়ম উপেক্ষা করে, সনদ ছাড়াই নতুন নতুন ভাটা তৈরি অব্যাহত রয়েছে। প্রায় কোনো না কোনো জায়গায় প্রতিদিনই গড়ে উঠছে ইটের ভাটা। বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে পরিবেশ।

দেশে বৈধ-অবৈধ ইটভাটার সঠিক সংখ্যা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এসব ইটভাটায় প্রতিবছর পোড়ানো হচ্ছে কোটি কোটি ইট। প্রতি হাজার ইটের জন্য কাঠ পোড়াতে হচ্ছে আট থেকে ১০ মণ। আবার গড়ে সাড়ে ৯ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য, সাড়ে চার ইঞ্চি প্রস্থ ও তিন ইঞ্চি পুরুত্বের এক একটি ইটে মাটি লাগে তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি। গড়ে তিন কেজি করে ধরলেও কোটি কোটি ইট তৈরিতে কত হাজার টন মূল্যবান মাটি পুড়ে যাচ্ছে তা কি আমরা কেউ ভেবে দেখেছি?

ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইনে ইট পোড়াতে কাঠ ব্যবহার সম্পূর্ণ পরিহার এবং বায়ু দূষণকারী উচ্চ সালফারযুক্ত কয়লা ব্যবহারও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাখা হয়েছে আইন অমান্যকারীদের কারাদণ্ড অথবা জরিমানার বিধান। কিন্তু এ দেশের অধিকাংশ ইটভাটায় প্রধান জ্বালানি কাঠ ও সালফারযুক্ত নিম্নমানের কয়লা। প্রভাবশালী ইটভাটার মালিকেরা প্রশাণসনের সামনেই এ অবৈধ কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে, আর তারা সচেতনভাবেই নিজেদের মুনাফা বাড়াতে ক্ষতি করছে পরিবেশের। এদের বিবেককে জাগ্রত করতে নিতে হবে কার্যকরী উদ্যোগ ও আইনি পদক্ষেপ। আর এ দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়, আমাদের সকলের।

লেখক: চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন