Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আলী ইয়া আলী!

১৯৭৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে এসেছিলেন বিশ্বখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী। চার দিনের ওই সফরে তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন তখনকার স্ত্রী ভেরোনিকা এবং কয়েকজন বন্ধু। ওই সফরে বাংলাদেশে আসার কাহিনি গার্ডিয়ান পত্রিকায় লিখেছিলেন সাংবাদিক ও লেখক রেজিনাল্ড ম্যাসে।

বাংলাদেশ সফরে আসার জন্য মোহাম্মদ আলীকে যে অনুরোধ জানানো হয়েছিল, তা তিনি ফেরাননি। এ দেশের মানুষের ভালোবাসার জবাব মোহাম্মদ আলী কীভাবে দিয়েছিলেন, তা ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরেছেন রেজিনাল্ড ম্যাসে। তিনি আলীর বাংলাদেশ সফর নিয়ে ‘বাংলাদেশ আই লাভ ইউ’ নামের প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন।

ম্যাসে ১৯৭৮ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে আলীকে বাংলাদেশ সফরে রাজি করাতে পেরেছিলেন অনেক চেষ্টার পরই। আলী শুরুতে বলেছিলেন, লিওন স্পিংকসের সঙ্গে শিরোপার লড়াইটা শেষেই তিনি বাংলাদেশে আসতে চান। কিন্তু লিওনের সঙ্গে সামান্য ব্যবধানে হেরে যান আলী। এরপর লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে ম্যাসে তাঁকে ফোন করে বাংলাদেশ সফরের পরিকল্পনা মনে করিয়ে দিলে আলী বলেন, পরাজয়ের এই গ্লানি নিয়ে তিনি বাংলাদেশের ভক্তদের মুখোমুখি হতে চান না।

ম্যাসে তখন আশ্বসৱ করে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ এখনো তোমাকেই দ্য গ্রেটেস্ট হিসেবে ভালোবাসে। ওখানে রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র চাষি পর্যনৱ সবাই আলীকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন।’

আলী তখন বরাবরের মতো ঠাট্টাচ্ছলে নিচু গলায় বলেন, ‘ভাই রেজিনাল্ড, আপনি মন থেকে বলছেন তো?’ জবাবে ম্যাসে বললেন, ‘আল্লাহর কসম, মন থেকে বলছি।’ তখন আলীর উত্তর, ‘ঠিক আছে। আমি যাব।’ আলী কথা রেখেছিলেন।

১৯৭৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে এসে সবার মন জয় করে নিয়েছিলেন। চার দিনের সফরে তাঁর সফরসঙ্গী হয়েছিলেন তাঁর তখনকার স্ত্রী ভেরোনিকা এবং কয়েকজন বন্ধু।

ফিরে দেখা

১৯৯৯ সালে তাকে স্পোর্টসম্যান অব দ্য সেঞ্চুরি হিসেবে ঘোষণা করে বিবিসি ও স্পোর্টস ইলাট্রেট। এখনও বক্সিং খেলার নাম উঠলেই ভেসে ওঠে তার ছবি। তবে এই মানুষটি বক্সিংয়ে আসার পেছনে আছে মজার ঘটনা। চোরকে শায়েসৱা করার উদ্দেশ্যে বক্সিং শিখেছিলেন মোহাম্মদ আলী। তখন তার জানা ছিল না, চোরকে শিক্ষা দেওয়ার এই অস্ত্র তাঁকে বিশ্বখ্যাত করে তুলবে।

সময়টা ছিল ১৯৫৪ সাল। মোহাম্মদ আলীর বয়স তখন মাত্র ১২ বছর। আলীর বাবা এক বড়দিনে লাল রঙের সাইকেল উপহার দিয়েছিল তাঁকে। সাইকেলটি বালক আলীর খুব প্রিয় ছিল। একদিন সাইকেলটিকে বাজারের একটি দোকানের পাশে রেখে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলেন তিনি। ফেরার সময় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। দেখলেন সাধের সেই সাইকেলটি জায়গায় নেই। সোজা কথায় চুরি গেছে সেটি। প্রচণ্ড কষ্টে কেঁদে ফেলেন তিনি। একই সাথে জমতে লাগল ক্ষোভ। চোরকে পেলে এখনই উচিৎ শিক্ষা দেয়ার ইচ্ছে হল তার। তবে চোরকে পেতে তো হবে!

উপায়নৱর না দেখে ঠিক করলেন পুলিশের কাছে যাবেন। সে সময় এলাকারই এক জিমে বক্সিং শেখাতেন জো মার্টিন। অবশ্য বক্সিং তার নেশা হলেও করতেন পুলিশে চাকরি। আলী গেলেন সেই মার্টিনের কাছেই। সাইকেল চুরি অভিযোগ শুনলেন তিনি। শুনলেন বটে, তবে দেখলেন হতাশ বালকের চোখে ক্ষোভ আর জেদের ঝিলিক। জহুরি যেমন রত্ম চেনে, মারটিনও বোধহয় চিনেছিলেন আলীকে। তিনি পরামর্শ দিলেন, চোরকে পরাসৱ করতে হলে আগে তোমাকে লড়াই শিখতে হবে। আলীর হাতে মারটিন তাই তুলে দিলেন জিমে ভর্তি হওয়ার ফরম।

পরদিন থেকে শুরু হল তার বক্সিং শেখা। আর সবার মতো করে মারটিন তাকে বক্সিং না শিখিয়ে একটু অন্যভাবে প্রশিক্ষণ দেন। মোহাম্মদ আলী শিখলেন কীভাবে ঘুরে ঘুরে মৌমাছির মতো হুল ফোটাতে হয়.. অর্থাৎ ঘুষি মারতে হয়। আলীর লড়াইয়ের এই বিশেষ কায়দাটা মারটিনের কাছ থেকেই শেখা।

প্রশিক্ষণের প্রায় ৬ সপ্তাহ পর স্থানীয় এক টিভিতে অনুষ্ঠিত লড়াইয়ে অংশ নেন মোহাম্মদ আলী। প্রতিপক্ষ রনি ও কিফি। চমৎকার লড়াইয়ের মাধ্যমে রনিকে পরাসৱ করেন তিনি। পরবর্তীতে ওসৱাদ শিষ্য একত্রে ‘সিক্স কেন্টাকি গোল্ডেন গ্লোভ টাইটেল’ অর্জন করেন। একে একে অংশ নিতে থাকেন বক্সিংয়ের বিভিন্ন ম্যাচে। এর কয়েক বছর পর ১৯৬০ সালে অলিম্পিকে স্বর্ণপদকও জয় করেন মোহাম্মদ আলী।

আলীর খেলার বিশেষত্ব ছিল যে, লড়াইয়ের সময় সবার মতো তিনি মুখের সামনে হাত গার্ড হিসেবে রাখতেন না। দু’হাত তার নিচেই নামান থাকত। ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার আলীকে ঘুষি মারা তবুও প্রতিপক্ষের জন্য সহজ হতো না। দ্রুত গতির আলী খুব সহজেই ঘুষি এড়াতে পারতেন। সেভাবেই প্রতিপক্ষ বুঝে ওঠার আগেই হুল ফোটাতেন তিনি। ১৯৬৪ সালে সনি লিস্টনকে হারিয়ে শিরোপা নেন আলী। লড়াইয়ের আগেও লিস্টনকে সাবধান করে বলেছিলেন, লড়াইয়ের সময় প্রজাপতির মত নেচে নেচে তিনি মৌমাছির মতো হুল ফোটাবেন।

মোহাম্মদ আলী। চেয়েছিলেন শুধু এ নামেই তাকে ডাকা হোক। মোহাম্মদ আলীর ভাষায়, ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লের জীবন ছিল দাসের। সে জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি হন মোহাম্মদ আলী। দ্য গ্রেটেস্ট ফরএভার। ৬১ ম্যাচে ৫৬ জয়। তিনবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। বক্সিংয়ের রিংয়ে তার মতো কেউ আজও আসেননি। কোনোদিন আসবেনও না। গত শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ ছিলেন তিনি। কারও কারও মতে তিনি, সর্বকালের সেরা। শুধু ক্রীড়াবিদ কেন? মানুষ মোহাম্মদ আলী কি তার চেয়েও বড় ছিলেন না? কালো মানুষদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি সব সময় ছিলেন সামনের কাতারে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যোগ দেয়ার প্রসৱাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি পান ৫ বছরের সাজা। তবুও অনড় থাকেন মোহাম্মদ আলী। বিশ্বের অনেক শক্তিশালী বক্সারকে কাবু করা মোহাম্মদ আলী সেই ১৯৮৪ সাল থেকে লড়ছিলেন দুরারোগ্য ব্যাধি পারকিনসনে। তার মাথাসহ সমসৱ শরীর সবসময় কাঁপতো। আর শেষদিকে তার স্মৃতি শক্তিও লোপ পেয়ে গিয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ মোহাম্মদ আলী কেবল রিংয়ের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য নয়, তিনি চির স্মরণীয় ও সম্মানীয় তার চারিত্রিক দৃঢ়তা আর মানবতাবাদী মনোভাবের জন্য। মেধা, শৈলী, চাতুর্য, সাহস, দূরনৱ গতি তাকে প্রতিষ্ঠিত করে অনন্য এক ক্রীড়াবিদ হিসেবে। মার্টিন লুথার কিং কৃষ্ণাঙ্গদের নেতা হিসেবে নোবেল পুরস্কার পেলেও তার বেশ আগে থেকেই বিশ্বের সব কালো যুবকদের আদর্শ পুরুষে পরিণত হন মোহাম্মদ আলী। কালোদের প্রতি মার্কিন শ্বেতাঙ্গদের অবহেলাই আলীকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। তিনি নিজেই নিজেকে দ্য গ্রেটেস্ট উপাধি দিয়েছেন। তিনবারের হেভিওয়েট শিরোপাজয়ী আলী বলেন, আমি কেবল গ্রেটেস্ট নই, আমি ডাবল গ্রেটেস্ট। আমার মতো শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির বিনয়ী হওয়া কঠিনই। তার আগে কেউ এ কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে বক্সিং রিং থেকে অবসরে যান তিনি। প্রথম পেশাদার জীবনে ১৩১ লড়াইয়ের মধ্যে মাত্র একটিতে হারেন তিনি। ছন্দে আর নৃত্যে যেভাবে তিনি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেন তা মুষ্ঠিযুদ্ধকে একাটা বিশেষ শিল্পে পরিণত করেছিলেন তিনি। আলী যখন দুলে দুলে প্রতিপক্ষকে আঘাত করতেন তখন তিনি প্রজাপতির মতো উড়তেন বলে মনে হতো। ফুটবলে পেলে না ম্যরাডোনা, ক্রিকেটে শচীন না লারা, ব্র্যাডম্যান না সোবার্স, টেনিসে ফেদেরার না সাম্প্রাস সেরা তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে দীর্ঘ। কিন্তু বক্সিংয়ে আলী ছিলেন অতুলনীয়। দেখতে ছিলেন খুবই সাদামাটা। কিন্তু মুষ্ঠিতে ছিল অসীম শক্তি। আর মনের জোরটা ছিল তার আরও অনেকগুণ বেশি। ষাটের দশকে তার সেরা সময়ে মার্কিন সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করে তিন বছর নিষিদ্ধ থাকেন বক্সিং থেকে। ২৫ থেকে ২৮ বছর বয়সে তিনি যদি লড়তে পারতেন তবে তার সাফল্য আরও বিসৱৃত হতো। তিনি যেমন ছিলেন বিদ্রোহী, তেমন ছিলেন জনদরদী, মানবহিতৈষী। এ কারণে ওই সময়ে তিনি দেশে অনেকের কাছে অপ্রিয় হলেও বিশ্বব্যাপী তার ভক্ত সংখ্যা বেড়ে যায়। তার মধ্যে দার্শনিক মনোভাব যেমন ছিল তেমন রসবোধও ছিল প্রবল। তার অনেক কথাই এখন অমৃতবাণীর মতো হয়ে আছে। মোহাম্মদ আলী সবসময়ই অনুপ্রাণিত ছিলেন তার নিজের আদর্শের চেতনায়। ১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার নাম ছিল ক্যাসিয়াস ক্লে জুনিয়র। ১২ বছর বয়সেই তিনি বক্সিং রিংয়ে পা রাখেন। ছোটভাই রহমান আলীও পরবর্তীতে বক্সিং রিংয়ে আসেন। যদিও তিনি সে রকম আলো ছড়াতে পারেননি অথবা আলীর আলোয় হারিয়ে যান। ১৯৬০ সালের ২৯ অক্টোবর ১৮ বছর ২৮৬ দিনে মোহাম্মদ আলীর বক্সিং রিংয়ে অভিষেক হয়, প্রতিপক্ষ ছিল টানি হানসেকার। তারপর ১৯৬৩ সাল পর্যনৱ ১৯টি ম্যাচ খেলে সবগুলোতেই জেতেন। এর মধ্যে ১৫টি জয় ছিল ‘নক আউটে’। সে সময় আলী জিম রবিনসন, হেনরি কুপার, জর্জ লোগান, আলন্সো জনসন ও জনি ফ্লি ম্যানের মতো বক্সারদের হারান। ১৯৬২ সালে হারান আর্চি মুরকেও। ১৯৬৩ সালে আলী ও ডাগ জোন্সের ম্যাচটি ছিল ‘ফাইট অব দ্য ইয়ার’। ম্যাচটি হয়েছিল নিউ ইয়কের ‘ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে’। এরপর ১৯৬৩ সালে প্রথম দেশের বাইরে যান। সেবার লন্ডনে তার প্রতিপক্ষ ছিলেন স্থানীয় বক্সার হেনরি কুপার। ১৯৬৪ সালে প্রথম হেভিওয়েট শিরোপা জেতেন সনি লিস্টনকে হারিয়ে। সপ্তম রাউন্ডে তিনি সনিকে পরাসৱ করেন। এরপর ১৯৭৮ সালে আলী তার তৃতীয় হেভিওয়েট শিরোপা জেতেন লিও স্পিংসকে হারিয়ে।

১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিকে বক্সিংয়ে স্বর্ণপদক জয়ী খেলোয়াড় হওয়ার পরও রোমের একটি রেস্টুরেন্টে তাঁকে খাবার দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। ‘অপরাধ’ তিনি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ! রাগে, দুঃখে, অপমানে আলী অলিম্পিক মেডেলটি টাইগ্রিস নদীতে ফেলে দেন। ১৯৬১ সালে আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মালেক এল শাহবাজের (ম্যালকম এক্স) অনুপ্রেরণায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তারপর থেকে পরিচিত হন ‘মোহাম্মদ আলী’ নামে। যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে তার হেভিওয়েট শিরোপা কেড়ে নেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আদালত তার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়। যদিও তাকে শেষ পর্যনৱ কারাগারে যেতে হয়নি। ১৯৭১ সালে সুপ্রিম কোর্ট তাকে নির্দোষ ঘোষণা করে। তবে সাড়ে তিন বছর তিনি নিষিদ্ধ থাকেন রিং থেকে। খেলার জগৎ থেকে অবসর নেয়ার পরও নানা পুরস্কার আর উপাধিতে ভূষিত হন তিনি। আলীর এক মেয়ে লায়লা আলীও বক্সিং জগতে সুনাম কুড়ান। তিনি লাইট মিডলওয়েট শিরোপাও জেতেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি চার বিয়ে করেন। এদের ঘরে সাত মেয়ে ও দুই ছেলের জনক তিনি। ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় অনুষ্ঠিত অলিম্পিক মশাল প্রজ্বলনের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। ২০০৫ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশ তাকে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম পদকে ভূষিত করেন। নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতে আলী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। ১৯৭৮-এ আলী বাংলাদেশও সফর করেন। ওই সময় বাংলাদেশের নাগরিকত্বও দেয়া হয়। ঢাকায় বাংলাদেশের বক্সিং স্টেডিয়ামটিও মোহাম্মদ আলীর নামে প্রতিষ্ঠিত।