Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আমার ভুবনে যত পথ আছে সবি তোমার কাছে যাবার

রাবেয়া খাতুন
আনন্দ আলো: আপনার ছোটবেলার গল্প শুনতে চাই।
রাবেয়া খাতুন: আমার ছোটবেলার স্মৃতি তিন অথবা চার বছর থেকে মনে করতে পারি। তখন পুরান ঢাকায় রায়সাহেব বাজারে আমরা থাকতাম। সেখানেই আমার বেড়ে ওঠা। এখনকার দিনে যেমন বাচ্চাদেরকে ৩/৪ বছরের মধ্যে স্কুলে পাঠানো হয়, তখন সেরকম অবস্থা ছিল না। ছয়, সাত বছরের আগে কেউ স্কুলেই যেত না। মনে আছে স্কুলে যাওয়ার আগের সময়টা আমার কাছে বড় আনন্দের ছিল। কোনো তাড়াহুড়া, টেনশন ছিল না। শুধুই খেলাধুলা। তখনকার দিনে পুরান ঢাকায় ‘ধীরি’ নামে এক ধরনের খেলার প্রচলন ছিল। খেলাটা কেমন ছিল? লম্বা সুতার মধ্যে পাথর বেঁধে দুই পক্ষে কাটাকাটি হতো। অনেকটা আকাশে ঘুড়ি কাটা খেলার মতো। যার পাথর কাটা পড়ত সে হেরে যেত। একদিন ধীরি খেলায় মহাব্যস্ত। হঠাৎ আমার এক কাজিন (নাম আব্দুল মজিদ) আমাকে সেখান থেকে ধরে নিয়ে এলো বাসায়। মা গোসল করিয়ে সাজিয়ে দিলেন। মজিদ ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন বাসার কাছের মালিটোলা স্কুলে। আমাকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে মজিদ ভাই তো চলে গেলেন। হঠাৎ অনেক মেয়ের মধ্যে নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিলো। সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। শুরু হলো অনিচ্ছাকৃত স্কুল যাত্রা। কিন্তু কোনোদিনই আমি স্কুলকে ভালোবাসতে পারিনি।
আনন্দ আলো: আপনারা কয় ভাইবোন?
রাবেয়া খাতুন: তিন বোন এক ভাই। বড় আপার তখন বিয়ে হয়ে গেছে। আমার চেয়ে বারো বছরের বড়। ছোট বোন সুফিয়া আমার থেকে ৪ বছরের ছোট। কাজেই বাসায় ছাত্রী মানুষ বলতে আমি একা। ছোট মামা কবির, নিজে পড়তেন, পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আমাকেও পড়াতেন। স্কুলে যেতাম। কিন্তু ঐ যে বললাম ভালো লাগত না।
আনন্দ আলো: কেন?
রাবেয়া খাতুন: বাধ্যগত পড়াশোনা ভালো লাগত না। অংক সবসময় কঠিন মনে হতো। বুঝতাম না। জীবনে ৩০-এর ওপরে নাম্বার পাইনি। ‘টায় টায়’ পাস করে গেছি। কিন্তু ইংরেজি, বাংলায় ছিলাম বেশ ভালো। প্রত্যেকবারই ৮০ কিংবা ৯০-এর কাছাকাছি নাম্বার উঠেছে।
আনন্দ আলো: আপনাকে সাহিত্য টানতে শুরু করেছিল কবে থেকে…?
রাবেয়া খাতুন: পারিবারিক আবহে যদি সাহিত্যের শুরু বলি তাহলে বলব যে, আমার বড়বোন অর্থাৎ নূরজাহান আপা শুরুটা করে দিয়েছিলেন। বড় আপা সব রকম গল্পের বই পড়তেন। তার হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর। আমার হাতের লেখা সুন্দর হওয়া উচিত ছিল কিন্তু হয়নি। আমি প্রথম জীবনে লেখা পাঠাতাম পত্রিকায়, হাতের লেখা ছিল অন্যের। মানে সব লেখাই আমার ছোট বোনকে দিয়ে কপি করাতাম। ওর হাতের লেখাও ছিল ভীষণ পরিষ্কার আর সুন্দর। বড় আপা গল্প বলতেন খুব চিত্তাকর্ষক করে। রাক্ষস-খোক্কশের গল্প। একরকম অভিনয় করেই দেখাতেন তিনি। হাত দিয়ে যে বর্ণনা করতেন তা দেখে ভয় পেয়ে যেতাম। এত জীবন্ত করে বলতে পারতেন দেখে আমি মনে মনে গল্প বানিয়ে ফেলতাম। সাহিত্যের ভিত হিসেবে অজান্তেই কাজ করেছিলেন নূরজাহান আপা আর মজিদ ভাই। প্রথম গল্প যেদিন পত্রিকায় ছাপা হয় সময়টা বোধহয় ৪৯ কিংবা ৫০ সাল। তখন ‘যুগের দাবি’ বলে একটা কাগজ বের হতো। পঞ্চাশের দশকে আমরা যারা এসেছিলামÑ তাদের অধিকাংশ প্রথম গল্পই এই পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।
আনন্দ আলো: ‘সিনেমা’ পত্রিকার কথা বলুন?
রাবেয়া খাতুন: আমি আর জহির রায়হান একসঙ্গে সিনেমায় কাজ করতাম। সাধারণত সিনে পত্রিকাগুলো সাহিত্য বিভাগকে তেমন গুরুত্ব দিত না। আমরা সিনেমায় সাহিত্য বিভাগকে বেশ সমৃদ্ধ করেছিলাম। আজকে যারা নামকরা লেখক তাদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক, গাফ্ফার চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, মির্জা আব্দুল হাই, হাসান হাফিজুর রহমান, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর সবাই সিনেমায় লিখতেন।
আনন্দ আলো: সেই সময় চরম প্রতিক‚ল পরিবেশেও প্রেসিডেন্ট নামে কিশোরদের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন ‘সিনেমা’র সম্পাদক ফজলুল হক। এ ব্যাপারে কিছু বলবেন।
রাবেয়া খাতুন: উপন্যাসটা আমার। দৈনিক ইত্তেফাকে ধারাবাহিক ছাপা হচ্ছিল। আইয়ুব খান এ সময় ইত্তেফাক বন্ধ করে দেয়ার কারণে উপন্যাসটির ছাপা মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়। সাগরের আব্বা (ফজলুল হক) একদিন বললÑ তোমার এই উপন্যাসটি ছোটদের জন্য একটি ভালো ছবি হতে পারে। সিদ্ধান্ত হলো প্রেসিডেন্টকে নিয়ে সিনেমা বানানো হবে। চিত্রনাট্য লিখল সাগরের আব্বা। লোকেশন ঠিক হলো। পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম থেকে ছবির স্যুটিং শুরু হবে। শেষ হবে পশ্চিম পাকিস্তানের শেষ সীমান্তে। অর্থাৎ ছেলে ধরা ঢাকার একটি মেয়ে শিশুকে ধরবে, ছেলেটি ছোটবোনকে উদ্ধার করতে তার পিছু নেবে। ঢাকায় এখন যেখানে স্টেডিয়াম সেখানে তখনকার দিনে মেলা হতো। মেলায় সার্কাসের লোক নিচে আগুন জ্বেলে ওপর থেকে লাফ দিত। সাগরের আব্বা সেই দৃশ্যের স্যুটিং করল। কবে ছবি হবে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নাই। কিন্তু ছবির জন্য রোমাঞ্চকর দৃশ্যটি স্যুট করল। অবশেষে ছবির স্যুটিং শুরু হল চট্টগ্রাম জাহাজঘাটা থেকে। তারপর করাচি। সেই প্রথম প্লেনে উঠা। করাচিতে স্যুটিং করার সময় টাকা ফুরিয়ে গেল। টাকা নিয়েই দুশ্চিন্তা। করাচি থেকেই সাগরের আব্বা তার বন্ধুদের কাছে চিঠি লিখতে শুরু করল। এই মুহ‚র্তে একজনের কথা মনে পড়ছে। নামের সাথে পন্নী ছিল (পুরো নাম মনে করতে পারছি না)। তিনি এক হাজার টাকা দিলেন ফজলুল হককে। তখনকার দিনে এক হাজার মানে অনেক টাকা। কোনোমতে আবার ছবির স্যুটিং শুরু হলো। প্রেসিডেন্ট নির্মাণে অনেক পারিবারিক কষ্টের কাহিনী আছে। তিন দফায় অনেক কষ্টে ছবির স্যুটিং হয়েছে। প্রথম দফা শুরু চট্টগ্রামে। তারপর টাকার কারণে বিরতি। টাকা জোগাড় হলে করাচিতে দ্বিতীয় দফার স্যুটিং। আবার টাকার জন্য বিরতি। আবার টাকা জোগাড়। তৃতীয় দফায় স্যুটিং হলো লাহোরে। পুরো ছবির স্যুটিং শেষ করতে ক’বছর লেগেছিল তা এখন মনে করতে পারছি না। একটা কথা বলা খুবই জরুরিÑ লাহোরের শাহনুর স্টুডিওর সহযোগিতা না পেলে প্রেসিডেন্ট ছবির কাজ কখনই শেষ করা যেত না। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গায়িকা নূরজাহানের (প্রথম) স্বামী শওকত হোসেন রিজভীর স্টুডিও এটি। সাগরের আব্বা শওকত হোসেন রিজভীকে সরাসরি বলেছিল, আমার এখন কোনো টাকা-পয়সা নাই। আপনার স্টুডিওতে কাজ করা বাবদ আমি কোনো টাকা-পয়সা দিতে পারব না। আপনি কাজ করার সুযোগ দিলে ছবির কাজ শেষ হলে টাকা দিয়ে আমি ছবির প্রিন্ট নিয়ে যাব।
তারপর অনেক দিন পার হয়েছে। এখনও আমি ভদ্রলোকের মহানুভবতার কথা ভুলতে পারি না। তিনি বিনা বাক্য ব্যয়ে রাজি হয়ে গেলেন। বাকিতেই তার স্টুডিওতে প্রেসিডেন্ট এর কাজ শুরু হলো। লাহোর, পেশোয়ার, পিন্ডি, ইসলামাবাদ, সোয়াত, আফগানিস্তানের বর্ডারের কাছে স্যুটিং হলো ছবির। আবারও বলি লাহোরের শাহনূর স্টুডিও সহযোগিতা না করলে এ ছবি কোনো দিনই আলোর মুখ দেখত না।
আনন্দ আলো: আবার লেখালেখি নিয়ে প্রশ্ন। আপনি লেখেন কখন?
রাবেয়া খাতুন: পেছনের কথা দিয়ে আরম্ভ করি। তখন সংসারের রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সবকিছুই আমাকে সামলাতে হতো। তাই দিনের বেলা ছেলে-মেয়েরা যখন স্কুলে থাকত তখনই লিখতাম। সকাল ১০টার মধ্যে ওরা স্কুলে চলে গেলে আমি লিখতে বসতাম। ঐ অভ্যাসটা এখনও রয়ে গেছে। সকাল ১০টার জায়গায় সাধারণত এখন ১১টায় কাজ শুরু করি। ২টা-আড়াইটা পর্যন্ত লেখালেখি চলে। অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেন সংসার সামলিয়ে আপনি লেখেন কখন? তাদেরকে আমি বলতাম এবং এখনও বলি লেখা আর ঘর-সংসার দুটোকেই আমি আলাদা বিভাজনে রেখেছি। তাই কেউ কারও প্রতিদ্ব›দ্বী হয়ে ওঠেনি।
আনন্দ আলো: লেখার ক্ষেত্রে আপনার প্রেরণা কারা?
রাবেয়া খাতুন: দুঃখের সাথে বলতে হয় বাংলাদেশে রাইটারের প্রেরণা তারা নিজে। তবে হ্যাঁ, অনেকের জীবনে (মেয়েদের ক্ষেত্রে) স্বামী বাধা হয়, পরিবেশ বাধা হয়, সামাজিক বাধাও আসে। আমার জীবনে তা ঘটেনি। বাধা যেটুকু এসেছিল অভাব, অনটন, এগুলোর সঙ্গে অহরহ যুদ্ধ করতে অনেকটা বছর পার হয়েছে। সাগরের আব্বা ফুল সংসারী ছিল না। সংসারে ছিল ঠিকই কিন্তু তা চলবে কী করে সবসময় ভাবত না। কোনো ডিসিশনে তাকে পাওয়া যেত না। একজন সংসারী মানুষ, যার ৪টা ছেলে-মেয়ে আছে তার দায়িত্ব কেমন থাকা উচিত? সে যুগে বিজ্ঞাপন বানাতে শুরু করেছিল। হয়তো বলল স্যুটিং-এর জন্য লাহোর অথবা করাচি যাবে। ১০/১৫ দিনের ব্যাপার। অথচ যাওয়ার পর ৩ মাস তার কোনো খবর নেই। চিন্তা করতে পারো? বাসা ভাড়া, চাকর বাকর, ৪টা ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা, সংসার খরচের কী হবে? এ ব্যাপারে তার কোনো চিন্তা ছিল না। এ ধরনের কাÐ সে একাধিকবার করেছে। হঠাৎ উধাও। পাত্তা নেই। ৩ মাস অথবা তারও বেশি। আবার হঠাৎ হাজির। মাফ চায়, আর হবে না… কিন্তু প্রতিশ্রæতি ঠিক থাকত না। শেষ পর্যন্তও নয়। চলচ্চিত্রে কখনো খ্যাতিমান হবে এই দূরাশায় পরবাসী হয়ে যে অল্প বয়সী স্ত্রীকে জীবিতকালে বৈধব্য দেয়, কিশোর সন্তানদের খোঁজখবর না নিয়ে করে রাখে পিতৃহারা তাকে আর যাই হোক প্রকৃত মানুষের মর্যাদা দেওয়া যায় কি?
আনন্দ আলো: সংসার কী করে চলত? চাকরি করতেন?
রাবেয়া খাতুন: না। লিখে এবং আমেরিকান এম্বাসিতে অনুবাদ নাটক রচনা করে। তখন ওতে ৯০ অথবা ১০০ টাকা পেতাম। জীবনের একটা বড় সময়ে আমাকে ছেলে-মেয়েসহ যুদ্ধ করতে হয়েছে। সঙ্গী বলতে কলম। উল্লাস এবং উপার্জনের একমাত্র অস্ত্র।
আনন্দ আলো: আপনার বিনোদন কী?
রাবেয়া খাতুন: দেশ-বিদেশের বই পড়া। ম্যাগাজিনগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা। প্রচুর গান শুনি। সিনেমা দেখি। সময় সুযোগে ভ্রমণ করি।
আনন্দ আলো: গানের ক্ষেত্রে উপমহাদেশে আপনার প্রিয় শিল্পী কে?
রাবেয়া খাতুন: হিন্দিতে রফি, মেহেদী হাসান, নূরজাহান। বাংলায় হেমন্ত, সন্ধ্যা, মান্নাদে। আমাদের এখানে রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন, সৈয়দ আব্দুল হাদী, মাহমুদুন্নবী, সুবীর নন্দীর গান ভালো লাগে। নতুনদেরও গান শুনি। হাবিব, টুটুল, শাহনাজ বেলী, আসিফ, মনির খান।
আনন্দ আলো: মানুষের চলার পথে বন্ধুর প্রয়োজন হয়। যার বন্ধু ভাগ্য ভালো সে সুখী। বন্ধু আপনার কাছে কী?
Rabeya-Khatunরাবেয়া খাতুন: আমার বন্ধু ভাগ্য খুব ভালো তা বলা যাবে না। তবে বিরল বন্ধু ভাগ্য নিয়ে আমি এসেছি। আমার মেয়ে বন্ধুর সংখ্যা কম। ছেলে বন্ধুর সংখ্যা বেশি। যেমন কবি আহসান হাবীব, মির্জা আব্দুল হাই। আমার পরম প্রিয় বন্ধু ছিলেন তারা। আলাউদ্দিন আল আজাদ, গাফ্ফার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক এরা আমার খুব ভালো বন্ধু। শুরুতে আমরা যেমন ছিলাম পরিণত বয়সেও তেমন আছি। সাগরের বন্ধুরাও কেউ কেউ আমার খুব ভালো বন্ধু। সাগরের ছেলে বন্ধু অথবা মেয়ে বন্ধু তাদের কয়েকজনের সাথে আমার বেশ সখ্যতা। তাদের সঙ্গে জেনারেশন গ্যাপের ব্যবধান থাকে না। আমি তাদের সঙ্গ খুব উপভোগ করি।
আনন্দ আলো: বন্ধুত্ব টিকে থাকার মাজেজা কী?
রাবেয়া খাতুন: আমার মনে হয় বন্ধুত্বের প্রথম শর্তই হলো পারস্পরিক ভালোবাসা, ঔদার্য। দাবি করে বন্ধুত্ব টেকানো যায় না। বন্ধুত্ব মানেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। প্রীতির সঙ্গে শ্রদ্ধার সম্পর্ক থাকবে। অনেকের বিশ্বাস এদেশে ছেলে এবং মেয়ের বন্ধুত্ব বেশি দিন টেকে না। কিন্তু সেটা সবক্ষেত্রে ঠিক নয়। আমার ছেলে বন্ধুরা শুরুতেও আমার কাছে যেমন আপন প্রিয় ছিল এখনও তেমনি আছে। এটা সম্ভব হয় সম্ভবত আমরা নিজেদের মধ্যে কখনই কোনো স্বার্থ খুঁজিনি।
আনন্দ আলো: কখনও প্রেমে পড়েছিলেন?
রাবেয়া খাতুন: একজন শিল্পীর জন্য (যে ক্ষেত্রেই হোক) প্রেম অপরিহার্য অবলম্বন। তবে তা কে কেমনভাবে গ্রহণ করবেন সেটা তার বিষয়। প্রেম জীবনে সবসময়ই প্রয়োজন।
আনন্দ আলো: আপনার উপন্যাসের কোনো বিশেষ চরিত্র কী আপনার প্রিয়?
রাবেয়া খাতুন: আমার উপন্যাসের সংখ্যা ৬০-এর বেশি। হ্যাঁ কিছু উপন্যাসের চরিত্র আমার বেশ প্রিয়। কখনও কখনও আমি তাদের সাথে থাকি, বিচরণ করি। সাগরদের সঙ্গে খাই, উঠি বসি, বেড়াতে যাই। কিন্তু আমার ঘোরাফেরা থাকে উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সাথে। তখন সাগরদেরকে বলি, আমি কিন্তু এখন মানসিকভাবে তোমাদের সাথে নাই। উপন্যাস লেখার কোনো কোনো বেলা এমন ঘটনা ঘটে। আমি চরিত্রগুলোর সাথে কথা বলি। আমি মনের দিক থেকে নিজেকে সর্বদাই তরুণ মনে করি। উপন্যাসে নায়ক নায়িকার বয়স যদি হয় পঁচিশ তাহলে আমিও পঁচিশ বছরে চলে যাই। আবার কখনও মনে হয় চরিত্রগুলোর সাথে তাল মেলাতে পারছি না। তারা আমার কথা শুনছে না। কলম থেমে থাকে। আমার বয়স তখন চলে যায় একশ বছরের ওপারে।
আনন্দ আলো: লেখকের রাজনৈতিক সচেতনতার ব্যাপারে কিছু বলবেন?
রাবেয়া খাতুন: রাজনৈতিক সচেতনতা প্রত্যেক লেখকের জন্য জরুরি। কিন্তু তিনি সরাসরি রাজনীতি করবেন বা রাজনীতির জন্য লিখবেন আমি তা সমর্থন করি না। তবে চাই বা না চাই উপন্যাসে তা অবধারিতভাবেই আসে।
আনন্দ আলো: কেন লেখেন? সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বলেন কেউ কেউ। আপনার কী সে ধরনের…
রাবেয়া খাতুন: না, আমি সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা ভেবে লেখা শুরু করি নাই। ছোটবেলায় যখন লেখা শুরু করেছিলাম তখন আনন্দের জন্য লিখতাম। আজও সেই আনন্দেই লিখি। আমি শুধুই আনন্দের জন্য লিখি। কারও কাছে কোনো দায়বদ্ধতা নাই।
আনন্দ আলো: বাংলায় আপনার প্রিয় লেখক কারা?
রাবেয়া খাতুন: রবীন্দ্রনাথ তো সবার আগে। তারপরে যারা আসেন কল্লোল যুগের ত্রিরতœ, মানিক, তারাশঙ্কর ও বিভূতিভ‚ষণ। এদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় তারাশঙ্কর। তাঁর লেখার সব কিছুই মনে হয় চিরন্তনী। আরেকজন লেখকের কথাÑ নরেন্দ্রনাথ মিত্র। চমৎকার লেখার হাত। তাঁর নতুন বই প্রকাশ হওয়া মাত্র আমাদের মধ্যে হৈচৈ পড়ে যেত। কে কীভাবে পয়সা জোগাড় করে আগে তার বই কিনব, রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হতো। প্রতিভা বসু, মহাশ্বেতা দেবী, আশাপূর্ণ দেবী আমার প্রিয় লেখক। দেশের মধ্যে গোড়া থেকেই একজন লেখক আমাকে আকৃষ্ট করেছিল আবু ইসহাক। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, শওকত ওসমানের লেখা ভালো লাগে। মূলত পঞ্চাশ দশকে আমরাই এদেশের সাহিত্যের গোড়াপত্তন করেছিলাম। এদের মধ্যে গাফ্ফার চৌধুরী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, হাসনাত আবদুল হাই, শওকত আলী, রিজিয়া রহমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখা আমার ভালো লাগে।
আনন্দ আলো: বলা হয় গদ্যে একটা সময় শরৎ যুগ ছিল। আপনার মন্তব্য কী?
রাবেয়া খাতুন: হ্যাঁ, আসলেই একটা সময় গদ্যে শরৎ যুগ ছিল। এ প্রসঙ্গে একটা গল্প আছে। শরৎচন্দ্র এবং নাট্যগুরু শিশির ভাদুরীর মধ্যে একসময় বাকযুদ্ধ হয়েছিল। শিশির ভাদুরী গর্বভরে বলেছিলেন, আমার নাটক দেখার জন্য দর্শক পথে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন শরৎচন্দ্র নাকি বলেছিলেন আমার বই যদি কুকুরের গলায় ঝুলিয়ে দেই তাহলেও কুকুরের গলা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে লোকে তা পড়বে। এতেই বোঝা যায় তার সময়ে শরৎচন্দ্র কতটা জনপ্রিয় ছিলেন। আমরা প্রথম জীবনে শরৎচন্দ্রকেই পড়েছি এবং তিনি আমাদেরকে সাহিত্যচর্চায় আকৃষ্ট করেছেন। এখন তার মূল্যায়ন হয়তো ততটা হয় না। কিন্তু আমি মনে করি শরৎ সাহিত্য তরুণ পাঠকের কাছে যুগ যুগ ধরে আগ্রহের বিষয় হয়ে থাকবে। কারণ তার উপন্যাসে সমাজ সংস্কারের বাস্তব, নর-নারীর বিচিত্র সম্পর্কের কথা উঠে এসেছে।
আনন্দ আলো: আপনার আলোচনায় জাতীয় কবি নজরুল ইসলামকে পাওয়া গেল না…
রাবেয়া খাতুন: নজরুল তো গল্পকার নয়। অনেকে বলবেন নজরুলও গদ্য সাহিত্য লিখেছেন। কিন্তু আমি বিনয়ের সাথে বলতে চাই নজরুলের গদ্য সাহিত্য বেশ দুর্বল। আমরা তাঁর গান ও কবিতায় যে রতœ ভাÑার পেয়েছি তা তার গদ্য সাহিত্যে পাইনি।
আনন্দ আলো: সাহিত্যে মূলধারা ও জনপ্রিয় ধারা বলে একটা বিতর্ক আছে। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য…
রাবেয়া খাতুন: হ্যাঁ, এই ধরনের বিতর্ক আমি কাগজপত্রে দেখি। মূলধারা, জনপ্রিয় ধারা। আমি মনে করি এই দুয়ের মধ্যে কোনোই বিরোধ নাই। মূলধারার লেখক ধরা যাক সৈয়দ শামসুল হকের কথা। তিনি যেমন মূলধারার লেখক, তেমনি জনপ্রিয় ধারারও।
আনন্দ আলো: একজন লেখককে সবসময় বেশি লিখতে হয়…
রাবেয়া খাতুন: না। আমি তা মনে করি না। একজন লেখক জীবনে একটি বই লিখেও স্মরণীয় বরণীয় হতে পারেন। কোয়ানটিটি নয়। কোয়ালিটি গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্চাশের দশকে যাযাবরের আবির্ভাব ঘটেছিল। দৃষ্টিপাত বলে তিনি একটা বই লেখেন। এর পরেও কয়েকটি বই তিনি লিখেছেন। কিন্তু ঐ দৃষ্টিপাতই তাকে পাঠকের কাছে অমর করে রেখেছে। দৃষ্টিপাতের পর তিনি যদি আর কোনো বই নাও লিখতেন তাহলেও পাঠক তাকে মনে রাখত।
আনন্দ আলো: লেখালেখির ক্ষেত্রে ভ্রমণ আপনার বেশ প্রিয় বিষয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। ভ্রমণ নিয়ে কিছু বলবেন।
রাবেয়া খাতুন: ভ্রমণ প্রিয় বিষয়। হবিও বলতে পারো। ইদানীং ভ্রমণ আমার সাহিত্যের একটা বড় স্থান দখল করেছে। আমি একটা বই পড়ে যে আনন্দ পাই, শিক্ষা লাভ করি। একটা গান শুনে যে আনন্দ পাই, একটা ভালো সিনেমা দেখে যে আনন্দ পাই, সেই ধরনের আনন্দ ও শিক্ষা আমি ভ্রমণেও পাই। কাজেই ভ্রমণ এখন আমার কাছে শুধু হবি নয়, লেখালেখির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। ভ্রমণে আমি একটা ব্যাপার প্রায়ই খেয়াল করি একেক দেশের একেক ভাষা। তার কয়টা আমরা জানি? কিন্তু বিভিন্ন দেশে গিয়ে আমি ভাষা না বোঝার অভাব বোধ করি নাই। কারণ দেশগুলোর প্রকৃতি, গাছপালা, নদীনালা, পাহাড়-পর্বত মনে হয় আমার সাথে কথা বলছে।
আনন্দ আলো: ভ্রমণের ক্ষেত্রে আপনার স্মৃতিতে কোন দেশটি বেশি উজ্জ¦ল?
রাবেয়া খাতুন: একটা বিষয় পরিষ্কার করি। যদি প্রশ্ন আসে পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালো ও সুন্দর কোন দেশ? তাহলে প্রথমেই বলব আমার দেশ, প্রিয় মাতৃভ‚মি বাংলাদেশ। অনেকে এখনও প্রশ্ন করেন ইবনে বতুতা বাংলাদেশে কী এমন দেখেছিলেন? সুন্দর দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এত প্রশংসা কেন করেছেন? পৃথিবীতে আমাদের দেশের মত সবুজ দেশ কী আর দ্বিতীয়টি নাই? সত্যি আমাদের চেয়েও সবুজে ভরা দেশ আছে। কিন্তু আমাদের সবুজটা ক্ষণস্থায়ী নয়, কিছু সময়ের জন্য নয়। এটা সব সময়ই সবুজ। আমাদের নদীনালার রূপ আরও আকর্ষণীয়। আবেগ থেকে বলছি না। সত্যি আমাদের দেশ সুন্দর। তবে হ্যাঁ, বিদেশী মনোহর দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া আমাকে আকৃষ্ট করে।
আনন্দ আলো: এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। আমাদের পরিবারগুলো ভেঙে ভেঙে ছোট হয়ে আসছে। আপনি একক না একান্নবর্তী পরিবারের পক্ষে?
রাবেয়া খাতুন: অবশ্যই একান্নবর্তী পরিবারের পক্ষে। কারণ আমি বড় হয়েছি একান্নবর্তী পরিবারে। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে, কেন এমন হচ্ছে? এক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হলোÑ কারণ অনেক আছে। পরিবার ভেঙে টুকরো টুকরো হলে মঙ্গল আসে না। আমাদের জন্য ঠিক না। বিদেশে এ ধরনের পরিবার কালচার গড়ে উঠেছে। কিন্তু আমেরিকা ইউরোপ সবখানেই এটা নিয়ে বিতর্ক চলছে। এখন আবার যৌথ পরিবারের দিকে ঝুঁকছে পৃথিবীর মানুষ। এক্ষেত্রে একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যৌথ পরিবারে শিশুরা প্রকৃত আদর, আদব-কায়দা শেখে। যা তাদের পরবর্তী জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুরাই তো একটা দেশের ভবিষ্যৎ। কাজেই তাদের জন্যই আমি যৌথ পরিবারের পক্ষে কথা বলি।
আনন্দ আলো: জেনারেশন গ্যাপ বলে একটা আলোচনা অথবা হতাশার সুর প্রায়ই শোনা যায়। আপনার মন্তব্য কী? এ নিয়ে কখনও ভাবেন?
রাবেয়া খাতুন: হ্যাঁ, ভাবি। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনেও এর প্রতিফলন দেখি। জেনারেশন গ্যাপ একটা বড় হতাশার জায়গা। দুই পক্ষ কখনই এক হতে পারে না। কিন্তু যদি উদার দৃষ্টিভঙ্গি থাকে সময় ও বিষয়ের গুরুত্ব বুঝে যদি সম্পর্ককে বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে জেনারেশন গ্যাপ থাকার কথা নয়।
আনন্দ আলো: জেনারেশনকে চালিত করার ক্ষেত্রে পরিবার অর্থাৎ একটি সংসারের ভ‚মিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে সংসার সাজানোটাই তো আসল?
রাবেয়া খাতুন: সংসার সাজানোর ক্ষেত্রে সমঝোতাই হলো বড় কথা। সমঝোতা এবং মমত্ববোধ যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গাঢ় হয় তখন সংসারও সুশৃঙ্খল-সুশ্রী হতে থাকে। সংসার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র, সমঝোতা বিশ্বাস আর মমত্ববোধ ছড়িয়ে দিতে পারলেই জেনারেশনকে সুন্দর করে গড়ে তোলা সম্ভব।
আনন্দ আলো: সাহিত্যে শ্লীল-অশ্লীল বলে একটা কথা আছে। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
রাবেয়া খাতুন: শ্লীল-অশ্লীল বলতে যদি সেক্সকে বুঝানো হয়ে থাকে তাহলে আমি বলবÑ সেক্স জীবনের অনিবার্য অঙ্গ। যে লেখক ব্যাপারটাকে সুন্দরভাবে আনতে পারবে অথবা প্রয়োজনবোধে সাহিত্যে তুলে ধরবে, সেটা কোনোভাবেই অশ্লীল মনে হবে না। কিন্তু শুধু আমাদের দেশ না সারা পৃথিবীতে একশ্রেণীর লেখক-লেখিকা আছেন যারা সেক্সকে তাদের লেখায় উদ্দেশ্য নিয়ে অন্যভাবে ব্যবহার করেন।
আনন্দ আলো: লেখিকা রাবেয়া খাতুন এবং ব্যক্তি রাবেয়া খাতুন কে আপনার কাছে বেশি প্রিয়?
রাবেয়া খাতুন: আমি জীবনের দুটি দিকেই সিরিয়াস। একটা হলো আমার পরিবার। আমার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে থাকতে আমি পছন্দ করি। অন্যটি হলো আমার লেখালেখি, আমার উপন্যাসের চরিত্ররা। তাদের সঙ্গেও থাকতে পছন্দ করি।
আনন্দ আলো: ঝটপট উত্তর দিন কে প্রিয়? আপনার পরিবার না লেখালেখি।
রাবেয়া খাতুন: দুটোই প্রিয়। আমার মনে হয় আমি সাগরদের কাছে যেমন মমতাময়ী মা, আমার পাঠকদের কাছেও তেমনি প্রিয় লেখক। কাজেই সংসার, লেখালেখি দুটোই আমার অতি প্রিয়।
আনন্দ আলো: প্রতিষ্ঠার জায়গা থেকে যদি বলি তাহলে ব্যক্তি রাবেয়া খাতুন প্রতিষ্ঠিত নাকি লেখিকা রাবেয়া খাতুন প্রতিষ্ঠিত?
রাবেয়া খাতুন: এখানে তর্ক কোথায়?
আনন্দ আলো: একজন আলোকিত ব্যক্তি হিসেবে আত্মত্যাগে আপনি একটা বড় সংসারকে সম্মান, মর্যাদার আসনে তুলে এনেছেন…
রাবেয়া খাতুন: তুলে এনেছি কিনা জানি না। তবে সন্তানরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মানুষ হয়েছে। এটা বড় সান্ত¡না।
আনন্দ আলো: ধরা যাক মৃত্যুর পর আপনাকে আবার পৃথিবীতে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কোন রূপান্তরে আবার আসবেন?
রাবেয়া খাতুন: (প্রশ্ন শেষ না হতেই প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে) না মৃত্যুর পর আমি আর এই পৃথিবীতে আসতে চাই না।
আনন্দ আলো: এমন কোনো স্বপ্ন দেখেছিলেন যা এখনও পূরণ হয় নাই?
রাবেয়া খাতুন: একজন লেখকের কত রকমের স্বপ্ন থাকে। এই মুহ‚র্তে মনে পড়ছে, একটা হোমকার থাকবে। তাতে করে আমি আমার প্রিয় মানুষকে নিয়ে সারা বিশ্বে ঘুরে বেড়াব।
আনন্দ আলো: সেই প্রিয় মানুষটি কে?
রাবেয়া খাতুন: (হেসে) না, সেটা বলা যাবে না। একজন সৃষ্টিশীল মানুষের একান্ত প্রিয় মানুষতো থাকতেই পারে।
আনন্দ আলো: এই স্বপ্নটি পূরণ হলে আপনার খুব ভালো লাগবে?
রাবেয়া খাতুন: (আবারও হেসে) না, এই স্বপ্ন কোনোদিনই পূরণ হবে না।
আনন্দ আলো: ঐতিহাসিক বা জীবিত অনেক চরিত্রের প্রতি নিÑয়ই আপনার প্রীতি ও শ্রদ্ধা আছে। চরিত্রগুলো কারা জানতে ইচ্ছে করে।
রাবেয়া খাতুন: হজরত মুহম্মদ (সা.), যীশু খ্রিষ্ট, গৌতম বুদ্ধ, আলেকজান্ডার, হিটলার, গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র, ইন্দিরা গান্ধী, সোফিয়া লোরেন এবং আধুনিক প্রযুক্তির আবিষ্কারকদের কেউ কেউ।
আনন্দ আলো: আপনার কাছে পরিবার কী?
রাবেয়া খাতুন: গ্রন্থি। হাসি, কান্না, আনন্দ-বেদনা, অহঙ্কার, আশ্রয়, নিরাপত্তা। তবে অতিসংগ্রামী দিনগুলোতে সাগর আমার পার্টনার ছিল। অনেক কষ্ট করেছে ও।
আনন্দ আলো: জীবনের অপূর্ণতা বোধ করেন?
রাবেয়া খাতুন: অপূর্ণতা তো সারা জীবন ধরেই ছিল এবং থাকবে।
আনন্দ আলো: সেটা কেমন?
রাবেয়া খাতুন: যেমন আমার বিবাহিত জীবনের কথাই ধরি, সেখানে অপূর্ণতা রয়ে গেছে। তারপরের জীবন যদি ধরো… সেখানেও আছে অপূর্ণতা। মানে আমার যা প্রাপ্য ছিল আমি সেগুলো পাইনি। হয়তো হাত বাড়ালেই সব পেতাম। নেই নাই।
আনন্দ আলো: তাহলে কী পূর্ণতার জায়গা নাই?
রাবেয়া খাতুন: আছে। অবশ্যই আছে। আমার যা কিছু পূর্ণতা আংশিক এসেছে কলমের মাধ্যমে। জীবনে মানুষের দুঃখ-কষ্ট অনেকভাবে আসে। শিল্পীদের বোধশক্তি খুবই তীব্র। তাদের যন্ত্রণার মাত্রাও প্রখর। সাধারণ মানুষের সাথে তার মিল কম। যন্ত্রণা থেকেও অনেক সময় ভালো সৃষ্টি হয়। আনন্দ থেকেও। এ জীবনের পুরোটাই বলতে পারো অসম্পূর্ণ। যা কিছু পূর্ণতা পেয়েছে তার সবটাই এসেছে পরিবার ও কলমের মাধ্যমে।
আনন্দ আলো: আমাদের বাংলা সাহিত্যের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে মূল্যায়ন করবেন।
রাবেয়া খাতুন: আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব আশাবাদী। বাংলাদেশের সাহিত্যের শুরু ’৪৭-এর পর। কলকাতার সাথে যদি তুলনা করো তাহলে বলব আমরা অনেক এগিয়েছি। আমাদের কোনো কোনো সাহিত্যিকের লেখা, কোনো কোনো সাহিত্য তাদের চেয়ে অনেক সমৃদ্ধ, উঁচুমানের। বাংলার চর্চা আমাদের এখানেই বেশি হচ্ছে। বিশ্বসাহিত্যেও আমরা পিছিয়ে নাই।
আনন্দ আলো: এই সময়ে তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে টিনএজ ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অনেকে হতাশার কথা বলেন। আপনার কী ধারণা?
রাবেয়া খাতুন: আমি মনে করি প্রজন্মকে গড়ে তুলবে প্রথমে পরিবার অর্থাৎ বাবা-মা। তারপরের দায়িত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকার ওপর। তারপর দায়িত্ব আসে সমাজের।
আনন্দ আলো: বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ভালোবাসার একপর্যায়ে ব্রেকআপ-এর কারণে তারা বেসামাল হয়ে পড়ে। যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আত্মহত্যার পর্যায়ে গড়ায়। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
রাবেয়া খাতুন: আমার মনে হয়, এটা আমাদের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে কিংবা কালচারে নতুন আসা মিষ্টি ব্যাধি। যে ছেলেটির প্রেমিকা নেই কিংবা যে মেয়েটি কোনো ছেলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, নিজেদের মধ্যে তারা ইনফিউরিটি কমপ্লেক্সে ভোগে। এটা বিদেশী কালচার থেকে এসেছে। তবে তারা (বিদেশী) এজন্য সমস্যায় ভোগে না। কিন্তু আমাদের ছেলে-মেয়েদের জন্য এটা এখনও সহজ হয়ে ওঠেনি। ফলে নানা সমস্যা দেখা দেয়। জীবন হয়ে ওঠে অগোছালো, অসহ্য। তখন আমার মনে হয় পুরো ব্যাপারটাকেই সাময়িক দুর্ঘটনার মতো সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করে ফিরে যাওয়া উচিত আবার পড়াশোনা কিংবা যার যার কর্মক্ষেত্রে।
আনন্দ আলো: খ্যাতি কী উপভোগ করেন?
রাবেয়া খাতুন: খ্যাতি কখনো উপভোগ্য কখনো বিড়ম্বনার। আমার কাজ লেখালেখি। নোবেল প্রাইজ আমার দরকার নাই। আমার দেশের মানুষ আমার লেখা পড়ে, আমাকে পছন্দ করে এতেই আমি খুশি।
আনন্দ আলো: মোহ কী?
রাবেয়া খাতুন: আচ্ছন্নতার অক্টোপাস।
আনন্দ আলো: প্রেম কী?
রাবেয়া খাতুন: জাগতিক শুদ্ধ পরমানন্দ।
আনন্দ আলো: পরকীয়া?
রাবেয়া খাতুন: পÐিতদের মতে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেম যার দাহ-দীপ্তি সমানে পোড়ায়।
আনন্দ আলো: শৈশব, কৈশোর, যৌবন, পৌঢ়ত্ব, বৃদ্ধকাল কোন সময়টা মানবজীবনের জন্য কাঙিক্ষত?
রাবেয়া খাতুন: নিঃসন্দেহে যৌবন।
আনন্দ আলো: মিথ্যে কথা কী?
রাবেয়া খাতুন: অভ্যাস। যে বলে না তার দরকার হয় না। তবে পৃথিবীর সেরা মিথ্যেবাদী সাহিত্যিকরা। যারা পাতার পর পাতা সাজিয়ে যায় বেশির ভাগই মিথ্যের আবরণে। অভিজ্ঞতার খাঁটি সোনার সঙ্গে মিথ্যের খাদ মিশিয়ে তৈরি হয় অসাধারণ কাহিনী।
আনন্দ আলো: প্রথম ভালোবাসা।
রাবেয়া খাতুন: প্রাথমিক প্রেমিক পাগলামি।
আনন্দ আলো: বিরহ কী?
রাবেয়া খাতুন: যা ভাবুক মানুষকে একসঙ্গে রিক্ত এবং সমৃদ্ধ করে।
আনন্দ আলো: ভ্রমণ আপনার কাছে কী?
রাবেয়া খাতুন: আনন্দময় বিশাল পাঠ্যপুস্তক।
আনন্দ আলো: দাম্পত্য জীবন কেমন?
রাবেয়া খাতুন: অতি উত্তম। যদি মাঝে থাকে পারস্পরিক সমঝোতা ও সহন ক্ষমতা।
আনন্দ আলো: টিনএজারদের ফ্যাশনকে কতটা গুরুত্ব দেন?
রাবেয়া খাতুন: শুধু টিনএজ কেন সব বয়সের জন্যই এটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে শোভন সৌন্দর্যের দিকটা লক্ষ্য রাখতে হবে।
আনন্দ আলো: দেশের সেরা অভিনেতা কারা?
রাবেয়া খাতুন: দেখেশুনে তো মনে হচ্ছে রাজনীতিবিদরা।
আনন্দ আলো: ড্রাগস এক কথায় কী?
রাবেয়া খাতুন: মূর্তিমান শয়তান।
আনন্দ আলো: যৌথ পরিবার কেন ভাঙছে?
রাবেয়া খাতুন: উদারতার অভাবে।
আনন্দ আলো: গান আপনার প্রিয় কেন?
রাবেয়া খাতুন: শুধু প্রিয় নয়, গান আমার প্রাণ। বিশ্বাস ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর সেরা মাধ্যম এটাই।
আনন্দ আলো: মৃত্যু চিন্তা আসে?
রাবেয়া খাতুন: প্রিয়জনের মতো। তার কাঙিক্ষত প্রত্যাশায় থাকি।
আনন্দ আলো: অর্ধশতাব্দীরও বেশী সময় একটানা জনপ্রিয়তা ধরে রাখার রহস্য কী?
রাবেয়া খাতুন: রহস্য কিছু নয়, আপন কাজের সঙ্গে সৎ থাকা।
আনন্দ আলো: আপনাদের পরবর্তী কথাকারদের কোন পথে সিদ্ধিলাভ সম্ভব?
রাবেয়া খাতুন: কায়িক ও আত্মিক শ্রমের পথ ধরে।
আনন্দ আলো: তাদের নিয়ে আপনি আশাবাদী?
রাবেয়া খাতুন: উম্। নতুন দিন তার ইঙ্গিত দিচ্ছে।