Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আমাদের চলচ্চিত্র একটা ট্র্যানজিট সময় পার করছে : মোরশেদুল ইসলাম

আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের হাতেগোনা যে ক’জন নির্মাতা উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত তাদের একজন তিনি। তাঁর হাত দিয়ে নির্মিত হয়েছে চাকা’র মতো আন্তর্জাতিকমানের ছবি। বহুল প্রশংসিত হয়েছে তার নির্মিত ‘দূরত্ব’, ‘প্রিয়তমেষু’ ও মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ ছবি ‘আমার বন্ধু রাশেদ’। সম্প্রতি এই খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার নির্মাণ করেছেন ‘অনিল বাগচীর একদিন’ নামে মুক্তিযুদ্ধের ছবি। বেঙ্গল ক্রিয়েশন্স প্রযোজিত এই ছবির পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম। বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিটি মুক্তি পেয়েছে ১১ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে। ছবিটি হুমায়ূন আহমেদকে  উৎসর্গ করা হয়েছে। ‘অনিল বাগচীর একদিন’ মুক্তি পাওয়ার আগেই দু’টি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়েছে। তার একটি কলম্বো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব অন্যটি ওয়ার্ল্ড ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ব্যাংকক। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও অংশ নিবে ছবিটি। অনিল বাগচীর একদিন নিয়ে আনন্দ আলোর সঙ্গে কথা হয় মোরশেদুল ইসলামের। নিচে তারই অংশ বিশেষ। লিখেছেন জাকীর হাসান।

আনন্দ আলো: মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘অনিল বাগচীর একদিন’ সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে। আপনার অনুভূতি জানতে চাই?

মোরশেদুল ইসলাম: আমার অনুভূতি চমৎকার। ছবিটি যারা দেখেছেন তারা একবাক্যে বলেছেন এটি সময় উপযোগী একটি ছবি। একথা বলার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে মুক্তমনের মানুষের প্রতি একশ্রেণির দুর্বৃত্তদের যে ধরনের ঘৃণ্য ও সহিংস ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি সেই দিক থেকে দুবৃত্তায়নের বিরুদ্ধে ছবিটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ছবির গল্পের প্রধান চরিত্র অনিল বাগচী একজন হিন্দু যুবক। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার বাবাকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর অনিলের প্রতিবাদ, মানবতাবাদ, মূল্যবোধ ও সততার একদিনের গল্প উঠে এসেছে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়টি প্রগাঢ়ভাবে তুলে ধরা হয়েছে যা এই সময়ের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এটি অসাধারণ একটি গল্পের ছবি। যারা দীর্ঘদিন হলে বসে ছবি দেখেন না তারা সিনেমা হলে বসে ছবিটি দেখে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন। তাছাড়া ছবির কাহিনী হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে হওয়ায় দর্শকদের বাড়তি আগ্রহতো আছেই।

আনন্দ আলো: ছবিটির নির্মাণ প্রক্রিয়া কী হুমায়ূন আহমেদ জীবিত অবস্থায় হয়েছিল?

মোরশেদুল ইসলাম: না। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর এব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। তাঁর মা ও স্ত্রীর কাছ থেকে এ ব্যাপারে অনুমতি নেয়া হয়। এই প্রসঙ্গে বলি, আজ যদি লেখক বেঁচে থাকতেন এবং স্বশরীরে ছবিটি দেখতেন তাহলে খুশি হতেন। এজন্য যে ছবিটি তার উপন্যাসকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তিনি খুব পারফেক্ট মানুষ ছিলেন। তাঁর লেখার প্রতিটি বিষয় নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে না তুললে মন খারাপ করতেন। আমি এই ছবিতে তাঁর লেখা প্রতিটি বিষয় যত্নসহকারে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি।

আনন্দ আলো: আপনি এর আগেও হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে ‘দূরত্ব ও প্রিয়তমেষু’ নামে দুটি ছবি নির্মাণ করেছিলেন। ঐ দুটি ছবি দেখে কী লেখক খুশি হয়েছিলেন?

মোরশেদুল ইসলাম: হুমায়ূন আহমেদকে খুশি করা অত সহজ কাজ নয়। তিনি একশত ভাগ পারফেক্ট না হলে খুশি হতেন না। ‘দূরত্ব’ দেখে খুশি হয়েছিলেন বলে ‘প্রিয়তমেষু’ করতে পেরেছিলাম। আমার বিশ্বাস এই ছবিটি দেখেও খুশি হতেন তিনি।

আনন্দ আলো: ছবিটি কী হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন অর্থাৎ ১৩ নভেম্বর মুক্তি দেয়ার কথা ছিল?

মোরশেদুল ইসলাম: ১৩ নভেম্বর ছবিটি একটি প্রিমিয়ার শোর আয়োজন করা হয়েছিল বসুন্ধরা সিটি সিনে প্লেক্সে। সেখানে দেশের বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন। তাদের উপস্থিতিতে আমরা এই ছবিটি হুমায়ূন আহমেদের প্রতি উৎসর্গ করার ঘোষণা দেই।

আনন্দ আলো: শুধু ডিসেম্বর বা মার্চ এলেই কেন মুক্তিযুদ্ধের ছবি নিয়ে কথা হয়, নির্মিত হয় এবং মুক্তি পায়? সারা বছর কেন হয় না?

মোরশেদুল ইসলাম: আমাদের বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস দুটি বিশেষ দিনে মুক্তিযুদ্ধের ছবি মুক্তি পাবে এটা খুবই স্বাভাবিক। মানুষ এই দুটি দিবসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রোমন্থন করে, মুক্তিযুদ্ধের ছবি বেশি দেখতে চায় এটা একটা কারণ। দ্বিতীয় কারণ হলো মুক্তিযুদ্ধের ছবিই কম নির্মিত হচ্ছে। বেশি ছবি নির্মিত হলে এই দুই দিবসের বাইরেও মুক্তিযুদ্ধের ছবি রিলিজ হতো।

আনন্দ আলো: মুক্তিযুদ্ধের ছবি কম নির্মিত হওয়ার কারণগুলো কী কী?

মোরশেদুল ইসলাম: আমাদের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কম ছবি হচ্ছে এটা ঠিক কিন্তু কেন কম হচ্ছে এর সঠিক ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। নতুন প্রজন্মের নির্মাতাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছবি নির্মাণের আগ্রহ কম থাকায় এমনটি হতে পারে। তবে প্রতি বছর প্রচুর ছবি নির্মিত হওয়া প্রয়োজন বিশেষ করে আগামী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুুদ্ধ এবং এর চেতনাকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। নতুন প্রজন্মের নির্মাতারা যদি মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণে আগ্রহী হয় তাহলে ভিন্ন মাত্রা পাবে। তাদের নতুন চিন্তা চেতনায় আরো গ্রহণযোগ্য করে তারা এ ধরনের ছবিকে দর্শকদের কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হবে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি তাদের আবেগ এক ধরনের যারা যুদ্ধ দেখেনি তাদের আবেগ অনুভূতি অন্যধরনের। আমরা চাই নতুন প্রজন্ম তাদের মেধামনন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণে এগিয়ে আসুক। মুক্তিযুদ্ধের ছবি আরো একটি কারণে কম হচ্ছে তা হলো এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা কম অর্থাৎ ব্যবসায়িক ভ্যালুজ একেবারেই নেই। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের ছবি খুবই কম হচ্ছে। আমি বলব এটা একটা বড় সংকট।

আনন্দ আলো: এই সংকট থেকে উত্তরনের উপায় কী?

মোরশেদুল ইসলাম: এই সংকট নিরসনের জন্য সার্বিকভাবে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। রাষ্ট্রের সহযোগিতা না পেলে একটি ভালো ছবি নির্মাণ করা সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের ছবির ক্ষেত্রে কোনো বাণিজ্য হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মূলধন ফিরে আসে না।

আনন্দ আলো: সাম্প্রতিক সময়ে ভালো ও মানসম্পন্ন এবং মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে কর্পোরেট হাউজগুলো পৃষ্ঠপোষকতা করছে। যেমন আপনার এই ছবি স্পন্সর করেছে মোবাইল অপারেটর রবি?

মোরশেদুল ইসলাম: এটা ভালো একটি সম্ভাবনা। কর্পোরেট হাউজগুলো যদি মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণে এগিয়ে আসে তাহলে সত্যিকারে নির্মাতারা ভালো ছবি নির্মাণ করতে পারবেন। শুধু মুক্তিযুদ্ধের ছবি কেন বাণিজ্যিক ধারার ছবিতেও আজকাল কর্পোরেট হাউজগুলো স্পন্সর করছে। তবে সেই স্পন্সরের টাকার অংক খুব বড় নয়। এই ছবির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল ক্রিয়েশন্সও বাংলাদেশের কর্পোরেট জায়ান্ট বেঙ্গল গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। তাদের আন্তরিক সহযোগিতায় এবং পৃষ্ঠপোষকতা পেলে একটি ভালো ছবি নির্মাণ করা সম্ভব তার প্রমাণ অনিল বাগচীর একদিন।

আনন্দ আলো: এই ছবির প্রধান চরিত্র অনিল বাগচীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন একজন নতুন অভিনেতা এই যুক্তিটা কেমন?

মোরশেদুল ইসলাম: অনিল বাগচীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন মঞ্চ অভিনেতা আরেফ চৌধুরী। এই চরিত্রের জন্য আমার কাছে মনে হয়েছে সেই পারফেক্ট। হয়তো এই চরিত্রে জনপ্রিয় কোনো তারকাকেও নেয়া যেত কিন্তু আরেফ যথাযথভাবে চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে। মনে হয়েছে ওর জন্যই চরিত্রটি লেখা হয়েছে। এছাড়াও ছবিতে চমৎকার অভিনয় করেছেন গাজী রাকায়েত, মিশা সওদাগর, জ্যোতিকা জ্যোতি, ফারহানা মিঠু, ইমন চৌধুরীসহ অনেকে। যারা ছবিটি ইতিমধ্যে দেখেছেন তারা এই শিল্পীদের অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন।

আনন্দ আলো: সার্বিকভাবে আমাদের চলচ্চিত্রের অবস্থা এখন কেমন?

মোরশেদুল ইসলাম: আমাদের চলচ্চিত্র এখন একটা ট্রানজিট পিরিয়ড পার করছে। প্রযুক্তিগতভাবে আমরা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। এতে করে মাঝেমধ্যে ছন্দপতন হচ্ছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে ছবি তৈরিতে অভ্যস্ত হওয়ার একটা বিষয় আছে সেটা যতদিন পর্যন্ত ঠিক না হবে ততদিন পর্যন্ত আমাদের কিছু সমস্যা থাকবে। তবে এই সমস্যা খুব তাড়াতাড়ি সমাধান হবে। এখন আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সিনেমা হল নিয়ে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে ছবি নির্মাণ করলেও সিনেমা হলে ছবি প্রদর্শনের সময় কোনো অ্যাফেক্ট পাওয়া যায় না। ঢাকার মাত্র দুটি সিনেমা হলে আমরা এই প্রযুক্তিগত সুবিধা পেয়ে থাকি। বাকি সব সিনেমা হলে ডিজিটাল ছবি প্রজেক্টরের মাধ্যমে সাধারণ পদ্ধতিতে চলে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে সিনেমা নির্মাণ করে যদি তার যথাযথ অ্যাফেক্ট পাওয়া না যায় তাহলে দর্শকতো ছবি দেখে মজা পাবে না। সব সময় ঝাপসা মনে হবে ছবি। যে কারণে দর্শকরা সিনেমা হলে প্রবেশ করতে চায় না। ডিজিটাল ছবির ক্ষেত্রে সিনেমা হলগুলোতে প্রযুক্তিগত সুবিধা বাড়াতে হবে। নতুন ডিজিটাল যন্ত্রপাতি বসাতে হবে। ডিজিটাল ছবির ক্ষেত্রে প্রতিটি সিনেমা হলে অন্তত টুকে রেজুলেশনের মেশিন বসানো দরকার যার দাম মাত্র ৩০ লাখ টাকা। শুধু ভালো মানের ছবি নির্মাণ করে লাভ নেই। সিনেমা হলে ভালোমানের ছবি প্রদর্শনের উপযোগিতা আগে যাচাই করা দরকার। যদি প্রজেক্টর বাদ দিয়ে সারা বাংলাদেশের প্রতিটি সিনেমা হলে টুকে রেজুলেশনের ডিজিটাল মেশিন বসানো যায় তাহলে চলচ্চিত্র ব্যবসায় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলে আমার বিশ্বাস। এ ব্যাপারে সিনেমা হল মালিকদের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে সরকার।