Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আমরা সকলে এক একটা মাটির প্রদীপ-আলী যাকের

নেসলে বাংলাদেশ-এর একটি সম্মেলনে বক্তৃতা করেন বিশিষ্ট নাট্যজন, কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব আলী যাকের। তাঁর বক্তৃতার বিষয় ছিলÑ সংকল্প। তাঁর বক্তৃতার মাধ্যমে উঠে এসেছে জীবনগড়ার একটি প্রেরণাদায়ী গল্প। তারই কিছু অংশ আনন্দ আলোর পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো

– সম্পাদক

সংকল্পে যাবার আগে বোঝা দরকার জীবনের সংকল্পগুলো কীভাবে তৈরি হয়। ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সে কথা বলতে চাই। বিশ্বে যে যাই করুক না কেন ব্যক্তিগত সাফল্য ও অভিজ্ঞতার কাছে এসব সবকিছুই ‘তুল্যমূল্য’ নয়। আমি বড় হয়েছি অত্যন্ত প্রগতিশীল ও খোলামনের একটি পরিবারে। শিক্ষা পেয়েছি তাদেরই আবহে। পড়েছি ভালো স্কুলে, কলেজে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সবই ঠিক আছে। হঠাৎ করেই আমার জীবনে একটা বিপর্যয় নেমে আসে। সেটা কি? সেটা হলো… এই বয়সে বলতে খারাপ লাগছে। তবুও চলছি। আমি যখন ইন্টারমিডিয়েটে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি তখন অকস্মাৎ আমার বাবা মারা যান। তিনি গাড়িতে চড়ে অফিসে যাচ্ছিলেন। গাড়িতেই হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। আকাশ ভেঙে পড়ে আমার মাথার ওপরে। কারণ তখনও আমার লেখাপড়া অনেক বাকি। বড় ভাই কেবল পাস করে চাকরিতে ঢুকেছেন। তৎকালীন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সে তার চাকরি হয়েছে। বাবাকে ছাড়া সংসার চলবে কি করে আমার মায়ের তখন এমন কোনো চিন্তা ছিল না। কাজেই মা যেন হঠাৎ করেই গভীর সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে শুরু করলেন। আমি তখন থেকেই লক্ষ্য করে আসছি… এটা খুব প্রণিধান যোগ্য… একটি পরিবার যদি সংঘবদ্ধ হয়, একটি পরিবারে সবার মধ্যে যদি বোঝাপড়া থাকে, একটি পরিবারের বন্ধন যদি হয় ¯েœহের এবং কমিটমেন্টের হয় তাহলে সেই পরিবার যে কোনো সংগ্রামের মোকাবিলা করতে পারবে। এই পরিবার থেকে যে শিক্ষা শুরু সেটি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে। আপনারা চারপাশে ঘুরে দেখবেন যাদের পারিবারিক অবস্থান সুদৃঢ় তারা যতবড় বিপদই আসুক না কেন ভেঙে পড়ে না। তারা ঠিকই নির্ধারণ করতে সক্ষম হয় কোন পথে তাদের পাড়ি দিতে হবে। কারণ পরিবার থেকেই সেই শিক্ষাটা তারা পেয়েছে।

আমি যখন সেকেন্ড ইয়ার অনার্সে পড়ি তখন আমার মা মারা যান। সাবসিডিয়ারী পরীক্ষা দিব ঐ সময়… দুটি মৃত্যু পরপর ঘটলো। আমার সবচেয়ে বড় বোন যাকে আমরা দিদি ডাকতাম। তিনি মারা যান আমি যখন অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেই তখন। ভাবুন একবার পরিস্থিতিটা আমার জন্য কতটা নাজুক ছিল।  তা সত্তে¡ও আজ আমি যে এতদূর পর্যন্ত এসেছি সেজন্য আমার পরিবারের অবদান বিশাল। পরিবারই আমাকে শিখিয়েছে ¯েœহ দিয়ে মায়া, দিয়ে, শাসন দিয়ে সবকিছু জেতা যায়। জেতা সম্ভব। ঐ অবস্থায়… একজন যুবক আমি, আমাদের তেমন কোনো সম্পদ ছিল না। সাধারণত: এই বয়সে অনেক যুবক যুবতী মতি হারিয়ে ফেলেন, গতি হারিয়ে ফেলেন, দিগ ভ্রষ্ট হন। আমার সৌভাগ্য যে আমার ক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি। আমি যখনই কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি প্রথমেই ভেবেছি বাবা হলে এক্ষেত্রে কি করতেন? মা এরকম একটা পরিস্থিতিতে কীভাবে সামাল দিতেন?

মাত্র ২২ বছর বয়সে আমার কর্মজীবনের যাত্রা শুরু। বস্তুত পক্ষে আমি যখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, লিবারেল আর্টস-এর ছাত্র, সোসিওলজি পড়েছি তখনও পড়ার খরচ জোগাড় করার জন্য আমাকে চাকরি করতে হয়েছে। সেটা কি চাকরি? আমি একটা ফার্মাসিটিউক্যাল কোম্পানীর মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটিটিভ হয়েছিলাম অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে যখন পড়ি তখন। চিন্তা করুন লিবারেল আর্টস-এর ছাত্র, সায়েন্সের কোনো ব্রাকগ্রাউন্ড নাই, আমাকে মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটিটিভ-এর চাকরি করতে হয়েছে। যথাযথ ভাবে ইন্টারভিউ দিয়েই আমি চাকরিটা পেয়েছিলাম। কোম্পানীটির নাম হয়তো অনেকে শুনে থাকবেন। একটি অ্যামেরিকান কোম্পানী। এখনও অ্যামেরিকাতেই আছে। তবে আমাদের এখানে নেই। নাম হলোÑ ইলাই লিলি করপোরেশন। লিলি নামে বিখ্যাত। বিশ্বের অনেক কড়া কড়া ওষুধ তারা রিসার্চ করে বের করেছেন। এই কোম্পানীর মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটিটিভ হলাম আমি। আমার বড় ভাইয়ের এক বন্ধু তখন কোম্পানীটির সুপারভাইজার ছিলেন। তার কাছে গিয়ে একদিন বললাম, ভাই আমার তো একটা চাকরি দরকার। তা নাহলে তো টেকা দায় হয়ে যাচ্ছে… তিনি সব শুনে বললেন, একটা চাকরি আছে কিন্তু সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ড দরকার। আমি বললাম, তাহলে উপায় কি? আমিতো সায়েন্সের ছাত্র নই। পড়াশোনাতো ছাড়তে পারব না। আমি সারাদিন আপনাদের কাজ চালিয়ে নিতে পারব। একটা সুযোগ দিন। তখন উনি আমাকে তাদের ওষধের ওপর একটা বড় ম্যানুয়াল দিলেন। সেখানে ৫টা আইটেম দেখিয়ে বললেন, ভালো করে পড়। তারপর দেখি কি করা যায়।

 

সেই বই আমি প্রায় মুখস্থ করে ফেললাম। আমাকে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার সময় দেয়া হয়েছিল। আপনারা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না। এই ৪৮ ঘণ্টায় আমি সূর্যের আলো দেখি নাই। একটা ঘরের মধ্যে নিজেকে বন্দী করে বইটা মুখস্থ করে ফেললাম। তারপর ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরিটা অর্জন করলাম। তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, ভালো বেতন ছিল চাকরিটিতে…। এই চাকরি করে পড়াশোনা চালিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর করাচিতে গেলাম। আমার ভাই পিআইএ’র একটা টিকেট দিলেন। আকাশ পথে করাচি গেলাম। সেখানে একটি এডভার্টাইজিং এজেন্সিতে চাকরি নিলাম। এটি একটি বৃটিশ কোম্পানী ছিল। তারপর থেকে আমি আর একবারও পিছনে তাকাইনি। বিজ্ঞাপন, মার্কেটিং এবং মার্কেটিং কম্যুনিকেশন, মার্কেট রিসার্চ, পাবলিক রিলেশন, ইভেন্ট এক্টিভেশনসহ বিভিন্ন কাজের সাথে ধাপে ধাপে জড়িয়ে পড়লাম।

Aly-Zaker-familyমনে আছে আমি যখন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বদলি হয়ে আসি তখন আমার বয়স মাত্র ২৪ বছর। মাত্র ২ বছর আমি করাচিতে চাকরি করেছি। আমাকে এখানে আনা হলো এক্সিউটিভ ক্লায়েন্স সার্ভিস দেখার জন্য। মাত্র ৩ মাসের মধ্যে আমি সিনিয়র এক্সিউটিভ ক্লায়েন্ট সার্ভিস হয়ে গেলাম। আমি চাকরি করে চলেছি। এমন সময় ঢাকায় আমাদের কোম্পানীর প্রধান চাকরি ছেড়ে দিলেন। করাচি থেকে আমাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং এক্সিউটিভ ডিরেক্টর ঢাকায় এলেন। আমাকে বললেন যে দ্যাখো… আমাদের বাঙালি একজনকে দরকার এই কোম্পানীকে হেড করার জন্য। আমরা সে রকমই একজনকে খুঁজছি। সব শুনে ভাবলাম নিশ্চয়ই কেউ একজন আছেন। হঠাৎ তৎকালীন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের লবিতে আমাদের কোম্পানীর এমডি হঠাৎ কফিশপে আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, যাকের আমরাতো একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। জানতে চাইলাম, বলেন কী সিদ্ধান্ত? তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ইউ আর গুয়িং টু হেড ইস্ট এশিয়াটিক এডভার্টাইজিং…।

ভেবে দেখুন তখন আমার বয়স মাত্র ২৪ বছর। ম্যানেজিং ডিরেক্টরের কথা শুনে মনে হলো আকাশ থেকে পরলাম। মাত্র ২৪ বছর বয়স। এত বড় পোস্টে আমাকে সিলেক্ট করা হয়েছে। যদিও এই ২৪ বছরের জীবনে আমাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। মাত্র ২৪ বছর বয়সে আমাকে একটা রুমে টেবিলের সামনে বসিয়ে দিয়ে বলা হল, আজ থেকে এটা তোমার দায়িত্ব। যখন দায়িত্বের কথা বলা হলো তখন আর সেটা চাকরি থাকলো না। তখন সেটা দায়িত্বে পরিণত হলো।

সেই আমার যাত্রা শুরু হলো। রবীন্দ্রনাথ আমার প্রিয় একজন মানুষ। মানুষ বললাম এই কারণে যে, তার গল্প কবিতা গানই শুধু নয় মানুষ রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে অনেক শ্রদ্ধার একজন ব্যক্তি। যিনি সব সময় আমার জীবনে পথ দেখিয়ে চলেছেন। আমার বাবা মায়ের পরই রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হয়েছি। আমার ব্যবস্থাপনা পরিচালক যেদিন আমাকে গুরু দায়িত্বটি অর্পণ করেন সেদিন আমি তার কাছে একরাতের সময় চেয়েছিলাম। কারণ আমি রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হতে চাই। রাতে তার অনেক কবিতা পড়লাম। একটি কবিতার মধ্যে চোখ আটকে গেল ‘রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, কে লইবে মোর কার্য কহে সন্ধ্যা রবি, শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তাপ ছবি। মাটির প্রদীপ ছিল সে কহিল স্বামী, আমার যেটুকু স্বাধ্য তা করিব আমি।’ এটা পড়ে আমার চিন্তা ভাবনাই পাল্টে গেল। আমি সাহস পেলাম।

আসলে আমরা প্রত্যেকেই তো এক একটি মাটির প্রদীপ, আমাদের অসীম ক্ষমতা। আমরা চাইলেই পারি মাথা তুলে দাঁড়াতে এবং যদি মাথা তুলে দাঁড়াই তখন সারা বিশ্ব আমাদের আয়ত্তে চলে আসে। আপনারা ভবিষ্যতের নেতা। কাজেই আপনাদের ভাবতে হবে মাটির প্রদীপ দিয়ে শুরু করে আপনারাই এক একজন হবে সূর্য। আপনারা আসলে সূর্যের সন্তান…

এইভাবে জীবনের শুরু। আমার বয়স যখন ২৫ তখন দেশে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ইতোমধ্যে চাকরি সূত্রে আমি একটি ফক্স ওয়াগন গাড়ি পেয়েছি। রাজারবাগের পাশে আমাকে একটি ফ্ল্যাট দেয়া হয়েছে। ২৫ মার্চের কালোরাতে সেই ফ্ল্যাট থেকে দেখলাম রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আগুন দেয়া হয়েছে। মানুষের আত্মচিৎকার, হাহাকার শুনলাম। তখন নিজেকে সংযত করতে পারিনি। যখনই শহরে কার্ফ্যু উঠে গেল আমি আমার বড় ভাইকে গিয়ে বললাম, আমি যাচ্ছি।

তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, কোথায় যাচ্ছ তুমি? উত্তরে বললাম, জানি না। তবে চলে যাচ্ছি… আমি এই পরাধিন শহরে থাকতে পারবো না। আমি বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। জানি না গন্তব্য কোথায়? আমার প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলাম। তার সারমর্ম ছিল এরকমÑ দেশ আমাকে চায় কাজেই আমাকে যেতে হবে… মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলাম। এটাই ছিল আমার সংকল্প। আমি সৎ ছিলাম বলে সংকল্পে জিতেছি। কাজেই সংকল্পে অটুট থাকবেন।