Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আমবাগানে একদিন

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা

এ আমি কোথায় এলাম? যেদিকে তাকাই শুধু আম আর আম। গাছে গাছে আম। বাড়ির উঠোনে আম। মাঠে আম। সাইকেলে আম। ভ্যান গাড়িতে আম। ট্রাকের ওপর আমের সৱূপ। আলুর বাজারে যেমন থাকে আলু আর আলুর সৱূপ। তেমনি আমের বাজারে শুধুই আম আর আম। ঝাকিতে আম, টুকরিতে আম। বসৱা ভরা আম। যেন আমময় একটা স্বপ্নরাজ্য। না না স্বপ্নরাজ্য নয় বাসৱবেই এসব চোখের সামনে দেখছি। আমের রাজ্যে অর্থাৎ আমবাগানে এই প্রথম আসা। তাই বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটছে না।

রাজশাহীতে আমার একজন ভক্ত থাকে। সেই বার বার তাগাদা দিচ্ছিলো- দিদি একবার আসবেন নাকি আমাদের দিকে? শিবগঞ্জে আমবাগান দেখাতে নিয়ে যাব। চাপাইনবাবগঞ্জের পাশেই শিবগঞ্জ। কিছুদূর এগুলেই ভারত-বাংলাদেশ সীমানৱ। তারপর ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলা। সময় করে আসেন একদিন। গাছে গাছে থোকা থোকা আম দেখে সত্যি আপনি অবাক হবেন।

এর আগে সেই অর্থে আমবাগান দেখিনি। যা দেখি তাতো বাড়ির পাশে দুই একটা আমের গাছ। সাথে কাঁঠালসহ অন্য গাছ। আর সিনেমায় দেখিছি পথের পাঁচালিতে অপু আর দূর্গাকে আম কুড়াতে। তবে আমের বাগানে হাঁটতে দেখেছি ‘উপহার’ নামের একটি সিনেমায় জয়া ভাদুড়িকে। আমবাগান সম্বন্ধে এটাই আমার ছোটখাটো ধারনা। তাই সিদ্ধানৱ নিলাম আমবাগান দেখতে যাব।

৯ জুন ২০১৬ সকালবেলা ছেলেকে সাথে নিয়ে ঢাকা থেকে আকাশপথে রাজশাহী বিমান বন্দরে গিয়ে নামলাম। সেখানে গাড়ি প্রস্তুত ছিল। সেই গাড়িতে করে দে ছুট শিবগঞ্জের দিকে। ঘন্টাখানেক পথ যাওয়ার পর একটা পরিবর্তন যেন লক্ষ্য করতে থাকলাম। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। একটু একটু করে আমবাগান চোখে পড়ছে। গাছে গাছে থোকায় থোকায় ঝুলে আছে আম। যতই যাচ্ছি ততই বিস্মিত হচ্ছি। এ আমি কোথায় যাচ্ছি? আমের রাজ্যে? এদিকে তো দেখি আমের গাছ ছাড়া আর কিছু নাই। শুধুই আম আর আম।

Bonnaশিবগঞ্জের দিকে গাড়ি ঢুকতেই বিস্ময়ের মাত্রা আরো বেড়ে গেল। রাসৱার ধারেও অগুনিত আমের বাগান। যেদিকে দুচোখ যায় শুধুই আমের বাগান। আমরা গাড়ি থামিয়ে একটি বাগানে নামলাম। হেঁটে যাচ্ছি বাগান দিয়ে আমার মাথায় গাছে ঝুলে থাকা আমের স্পর্শ পাচ্ছি। এই যে এতো আম ঝুলে আছে কেউ তা পেড়ে খাচ্ছে না। ছেলেমেয়েরা পাশেই খেলাধুলা করছে অথচ ঝুলে থাকা আমে কেউ হাত দেয় না। এখানে এটাই রীতি ঝুলে থাকা আম বাগানের মালিকের অনুমতি ছাড়া হাত দেয়া যাবে না। হাত দিলেই বেঁধে যাবে মহা হুলুস্থুল। দরবার বসবে। অপরাধীর কঠিন শাসিৱ হবে।

আম বাগানে হাঁটছি। মাথার ওপর আম। হাতের কাছে আম। কনুই ছুঁয়ে যাচ্ছে ঝুলে থাকা আম। এই দৃশ্য আমার কাছে নতুন। আমার ছেলের কাছেও নতুন। আমরা মা ছেলে অবাক বিস্ময়ে গাছে ঝুলে থাকা আম দেখছি। আশেপাশে তেমন কোনো পাহারাদার নাই। একটু এগিয়ে যেতেই একজনের দেখা পেলাম। জিজ্ঞেস করলাম ঝুলে থাকা আম কি একটু ছুঁয়ে দেখতে পারি? তিনি বললেন, ছুঁয়ে দেখুন। কিন্তু ছিঁড়বেন না। প্লিজ…

পাশেই আমের বাজারে গেলাম। ওরে বাব্বা এ যে দেখি আমরাজত্ব। আলু যেমন সৱূপ করে রেখে পাইকারী বিক্রি হয়। আমও তেমনি পাইকারী বিক্রি হচ্ছে। ট্রাকে উঠছে আম। রাসৱায় ভরানো হচ্ছে আম। ভ্যান গাড়িতে যাচ্ছে আম। সাইকেলে ব্যাগে ঝুলছে আম। সত্যি আমি বিস্মিত। আম দেখার মতো এতো আনন্দ আমি আর কখনো পাইনি।

আম এই ফলটি আমার অনেক প্রিয়। সে কারনে আমের রাজ্যে ঢুকে সত্যি আমি অবাক। ধানের দেশ, পাটের দেশ বাংলাদেশ। আমি এখন বলতে পারি আমের দেশও বাংলাদেশ। সেজন্য বোধকরি কবি লিখেছেন-

আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই,

ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ি যাই।

ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ

পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ।

চরম সত্য হলো আমাদের শহুরে ছেলেমেয়েরা ইদানিং এই আনন্দ থেকে অনেকটাই বঞ্চিত। আমার ছেলে যেমন আমবাগান দেখে খুশি হয়েছে, আমার ধারনা অন্য ছেলেমেয়েরাও তেমনি খুশি হবে। আমি মনে করি বাবা-মায়েদের উচিৎ সময় করে ছেলেমেয়েদের এমন সব ঐতিহ্যবাহী এলাকায় একবারের জন্য হলেও নিয়ে যাওয়া। এতে করে দেশের প্রতি ছেলেমেয়ের ভালোবাসা জন্মাবে। সেই সাথে তারা প্রকৃতির সান্নিধ্য পাবে। যেমন আমার ছেলে রাজশাহী থেকে ফিরে আসা অবধি আমরাজ্যের গল্প বলেই যাচ্ছে তার বন্ধুদেরকে।

আমবাগানে, আমের হাটে যে আমগুলো দেখলাম তার সবগুলোই সবুজ রঙের। এ যেন সবুজের সমারোহ।

আমবাগান থেকে ফিরে রাজশাহীর দিকে যখন আসছিলাম তখন কেন যেন একটা প্রশ্ন মাথায় উঁকি দিল। রাজশাহী অঞ্চলের এই আমগুলোই তো ঢাকাসহ সারাদেশে যায়। কিন্তু অনেকক্ষেত্রে সবুজ রঙটা কেন যেন থাকে না। আম পাকলে লাল হয়। কিন্তু সেই লালের ঔজ্জ্বল্য অন্যরকম। এটা রাজধানীতে বিক্রি হতে আসা অনেক আমে থাকে না। কেন থাকে না এটা একটা বড় প্রশ্ন বটে। প্রিয় পাঠক, আপনারা কি বলেন?