Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আগাখান স্থাপত্য পুরস্কার জিতলেন খ্যাতিমান দুই স্থপতি

মোহাম্মদ তারেক: সুলতানি আমলের স্থাপত্যের আদলে তৈরি হয়েছে বায়তুর রউফ মসজিদ। অন্যদিকে বাংলার বৌদ্ধবিহার মহাস্থানগড়ের ছাপ রয়েছে ফেন্ডশিপ সেন্টারের স্থাপনায়। এই দুটি স্থাপনা নিয়ে এলো বাংলাদেশের জন্য অনন্য সম্মান। আগাখান স্থাপত্য পুরস্কার। প্রথমবারের মতো এ পুরস্কার অর্জন করলেন বাংলাদেশের কৃতিমান দুজন স্থপতি। ঢাকার বায়তুর রউফ মসজিদ স্থাপত্যের জন্য মেরিনা তাবাসসুম এবং গাইবান্ধায় ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার স্থাপত্যের জন্য কাশেফ মাহবুব চৌধুরী এ পুরস্কার পেয়েছেন। আগাখান স্থাপত্য পুরস্কার স্থাপত্যের দুনিয়ায় অত্যনৱ সম্মান জনক। এর আগে বাংলাদেশের তিনটি স্থাপত্য এ পুরস্কার জিতলেও সেগুলোর স্থপতিরা ছিলেন বিদেশি। বেশ কয়েকবার বাংলাদেশি স্থপতিরা চূড়ানৱ মনোনয়ন পেলেও তারা পুরস্কার জিতেননি। দীর্ঘদিন পর সেই ঘোচালেন স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম ও কাশেফ মাহবুব চৌধুরী। স্থাপত্যকলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট জনেরা মনে করেন, আগাখান পুরস্কারের মতো পুরস্কার জয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্থাপত্য সম্পর্কে আনৱর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির পথ মসৃণ হলো। তরুণ স্থপতিদের উদ্ভাবনী ধারণাকে স্বীকৃতি দিতে আগাখান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক (একেডিএন) প্রতি তিন বছর পর পর এ পুরস্কার দেয়। এই পুরস্কারের জন্য স্থাপত্য ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব, পরিকল্পনা এবং ঐতিহাসিক সংরক্ষণকে গুরুত্ব দেয়া হয়। উদ্ভাবনী ধারণার পাশাপাশি স্থাপনাটি কতটা পরিবেশবান্ধব সেটিও দেখা হয়। এ পুরস্কারের জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় অত্যনৱ কঠোর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।

shah-cementগত ৩ অক্টোবর সোমবার একেডিএনের ওয়েবসাইটে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। পরের দিন বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। জানা গেছে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হবে। পুরস্কারের অর্থমূল্য ১০ লাখ মার্কিন ডলার, যা ছয় বিজয়ী মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে। এবারের পুরস্কারের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৩৪৮টি প্রকল্প জমা পড়ে। সেখান থেকে ১৯টি প্রকল্প চূড়ানৱ মনোনয়নের জন্য বাছাই করা হয়। পরে চূড়ানৱ পর্যায়ে ছয়টি স্থাপনা পুরস্কার জিতেছে। বাংলাদেশের দুটি স্থাপনা ছাড়াও বিজয়ীদের মধ্যে রয়েছে চীনের বেইজিংয়ে অবস্থিত হটং চিলড্রেনস লাইব্রেরি অ্যান্ড আর্টসেন্টার, ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অবস্থিত সুপার ক্লিয়েন, ইরানের তেহরানে অবস্থিত তাবিয়াত পেডেস্ট্রিয়ান ব্রিজ এবং বৈরুতের ইসাম ফয়ার্স ইনসটিউট। এর আগে বাংলাদেশের তিনটি স্থাপনা জাতীয় সংসদ ভবন, গ্রামীণ ব্যাংক হাউজিং প্রকল্প ও রুদ্রপুর স্কুল আগাখান স্থাপত্য পুরস্কার জিতেছিল। কিন্তু এগুলোর স্থপতি ছিলেন বিদেশি। রাজধানীর দক্ষিণখান থানা ফায়েদাবাদে বায়তুর রউফ মসজিদের স্থাপনার জন্য পুরস্কার পেয়েছেন মেরিনা তাবাসসুম। পুরস্কার পাওয়া সম্পর্কে তিনি জানান, সৃষ্টিশীল কাজের স্বীকৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ পুরস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্থাপত্য সম্পর্কে বিশেষ ইতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। এটি তরুণদের ভালো কাজ করতে অনুপ্রেরণা জোগাবে বলে আমি মনে করি।

গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের প্রত্যনৱ গ্রাম মদনের পাড়ায় ‘ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার’ স্থাপনের জন্য আগাখান পুরস্কার পেয়েছেন কাশেফ মাহবুব চৌধুরী। তিনি মনে করেন, এটি ব্যক্তিগত অর্জনের চেয়ে দেশের জন্য বড় অর্জন। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের একটি স্থাপনা বিশ্বের একটি নামকরা পুরস্কার পেয়েছে এর ফলে বাংলাদেশ সম্পর্কে সবার ধারণা পরিবর্তন হবে। আমাদের স্থপতিরা সীমিত বাজেট ও সামর্থ্যের মধ্যেও সৃষ্টিশীল কাজগুলো করে যাচ্ছেন সবার অজানেৱই। এ পুরস্কার পাওয়ার মাধ্যমে আমাদের কাজগুলো সম্পর্কে আনৱর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোচনা হবে, সেটাই আমাদের অর্জন।

তরুণ স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম যে স্থাপনাটির জন্য আগাখান পুরস্কার পেয়েছেন, সেটির অবস্থান রাজধানীর দক্ষিণখান থানার ফায়েদাবাদে। নাম আব্দুর রউফ মসজিদ। আব্দুল্লাপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে পূর্ব দিকে গিয়ে রেল লাইন পেরিয়ে মসজিদটির অবস্থান। এর স্থাপত্যের বিশেষ দিক হলো- এর বায়ু চলাচল ব্যবস্থা ও আলো চমৎকার বিচ্ছুরণ মসজিদের পরিবেশকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। ৭৫৪ বর্গমিটারের মসজিদটির বিশেষত্ব হলো- মসজিদের পরিচিত ডোম বা মিনার নেই। চতুর্দিকে আটটি পিলারের ওপর এটি তৈরি। এর নকশার বিশেষত হলো- কিবলার দিকে ১৩ ডিগ্রি কোনাকুনি করা একটি থাম। আলো প্রবেশের জন্য চারদিকে রাখা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। সুলতানি আমলের মসজিদের অনুপ্রেরণায় তৈরি হয়েছে এর স্থাপত্য।

স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম মসজিদটির বিশেষত্ব সম্পর্কে জানান, মসজিদটি তৈরি হয়েছে একটু ভিন্ন দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে। প্রচলিত মসজিদগুলোর ধরন থেকে আলাদা। আর মসজিদটি নির্মিত হয়েছে স্থানীয় ব্যক্তিদের অংশগ্রহণে, অংশগ্রহণ মূলক ধারণা থেকে। পরিবেশবান্ধব এবং আলো-বাতাসের বিষয়টি মাথায় রেখে এর ডিজাইন করেছি। ইতিহাস, সংস্কৃতি, আবহাওয়াসহ নানা বিষয় মাথায় রেখে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। আর ব্যবহৃত সব উপকরণই স্থানীয়।

shah-cementঅন্যদিকে কাশেফ মাহবুব চৌধুরীর ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারের বিশেষ দিক হলো- ইটের গাঁথুনি দিয়ে নির্মিত ভবনটি একাধিক ব্লকে বিভক্ত। সেখানে রয়েছে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, লাইব্রেরি, অভ্যনৱরীণ চলফেরা ও থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা। একটির সঙ্গে আরেকটির মধ্যে রয়েছে সংযুক্ত বারান্দা ও খোলা প্যাভিলিয়ন। কিন্তু পুরো ভবনটিই দৃষ্টির আড়ালে। পাশ দিয়ে চলে গেছে গ্রাম্য সড়ক। অথচ পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ভবনটি। সহজে কারো চোখেই পড়বে না। কারণ পুরো ভবনটি মাটির সমানৱরালের নীচে। প্রকৃতির সঙ্গে মিশে আছে। ভবনের বিভিন্নরুমের ছাদ মাটির সমতলে। তাতে লাগানো সবুজ ঘাস মিশে গেছে আশেপাশের মাটির সঙ্গে। প্রকৃতির মধ্যে মিশে যেন লুকিয়ে আছে ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার নামক এই ভবনটি। গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের মদনের পাড়া গ্রামের বালাসী সড়ক ঘেষে গড়ে ওঠা এই ভবনের আয়তন বত্রিশ হাজার বর্গফুট।

এর আগেও বাংলাদেশের এ দুই স্থপতি আগাখান স্থাপত্য পুরস্কারের জন্য চূড়ানৱ মনোনয়ন পেয়েছিলেন। ২০০৪ সালে যৌথভাবে একটি প্রকল্পের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন মেরিনা ও কাশেফ। ২০১০ সালে চান্দগাঁওয়ে নির্মিত একটি মসজিদের জন্য মনোনয়ন পান কাশেফ মাহবুব চৌধুরী।

১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্য বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর স্থপতি উত্তম সাহার ‘নন্দন লিমিটেড নামের একটি ফার্মে যোগ দেন কাশেফ মাহবুব। সেখানে তিনি এক বছর চাকরি করার পর আরেক স্থপতিকে সঙ্গে নিয়ে নিজে গড়ে তোলেন ‘আরবানা’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। ২০০৪ সাল থেকে এখন পযনৱ কাশেফ মাহবুবই আরবানার একক কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্য বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। খ্যাতিমান এ স্থপতি এযাবৎ অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য কাজে অবদান রেখেছেন। স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরীর সঙ্গে যুগ্মভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা সৱম্ভ ও স্বাধীনতা জাদুঘরের নকশা করেছেন মেরিনা। ২০০৫ সাল থেকে নিজস্ব স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস (এমটিএ) পরিচালনা করছেন তিনি। মেরিনা মনে করেন, আমাদের পরিবেশ ও বসবাসের ক্ষেত্রগুলো নিয়ে স্থপতিদের দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হতে হয়। আমাদের শহর ও বসতিগুলোর উন্নয়নে যুক্ত করতে হবে সবাইকে। সে কারণে নতুন স্থপতিদের সঠিক পথে পরিচালনা ও পথ নির্দেশনা দেয়া জরুরি।