Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

সব কিছুর উপরে দেশ আগে : শতাব্দী ওয়াদুদ

কখনো তিনি মিলিটারি, কখনো ঢোল বাদক, কখনো নায়ক আবার কখনো খলনায়ক। আর সম্প্রতি তাকে বায়োস্কোপওয়ালা বলেও ডাকছেন অনেকে। তিনি অভিনেতা শতাব্দী ওয়াদুদ। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম-এর ‘গেরিলা’ ছবির পাকিস্তানি মেজর এবং ক্যাপ্টেন, ‘মেহেরজান’ ছবির খলিল, ‘জীবনঢুলি’ ছবির ঢোল বাদক কিংবা ‘বাপজানের বায়োস্কোপ’ ছবির বায়োস্কোপওয়ালা তিনি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চারটি ছবি তার ঝুলিতে। ‘গেরিলা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও। আর তাই এই প্রজন্মের অভিনেতাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে অভিনয় করা সফল অভিনেতা হিসেবে শতাব্দী ওয়াদুদকেই সাধুবাদ দেন অনেকে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে অভিনয়, সমসাময়িক ব্যস্ততা  ও নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে শতাব্দী ওয়াদুদ কথা বলেছেন আনন্দ আলো’র সঙ্গে। লিখেছেন সৈয়দ ইকবাল

আনন্দ আলো: বাপজানের বায়োস্কোপ ছবিটিতে মুক্তিযুদ্ধকে কিভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে?

শতাব্দী ওয়াদুদ: ছবির পুরো গল্প একটি চরে বায়োস্কোপ দেখানো নিয়ে। যেখানে উঠে এসেছে চরের রাজনীতি, অর্থনীতি, চরের মানুষের সামাজিক অবস্থান এবং জীবন যাত্রার চিত্র। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ছবির পুরো গল্প শেষমেশ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে শেষ হয়। ছবির গল্পে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি বায়োস্কোপের বিষয়ে ভিন্নভাবে উপস্থাপন হয়েছে। ছবিতে গ্রাম্য রাজনীতিটাকে জাতীয় পর্যায়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমি ছবিতে বায়োস্কোপ দেখাই। এই বায়োস্কোপ দেখানোর গল্পে একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজাকারের কর্মকাণ্ডের বিষয় উঠে আসে। আর তাতেই এলাকার রাজাকারের মুখোশটা উন্মোচিত হয়। এরপর নানান ঘটনায় ছবির গল্প এগুতে থাকে। মাসুম রেজার স্ক্রিপ্টে ছবিটি পরিচালনা করেছেন রিয়াজুল রিজু। আমি ছাড়াও ছবিতে আরো অভিনয় করেছেন শহীদুজ্জামান সেলিম, মাসুদ মহিউদ্দীন, তন্ময়সহ অনেকে।

আনন্দ আলো: আপনি চারটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। চারটি ছবিতে আপনাকে চার রকম চরিত্রে দেখা গেছে। এ ব্যাপারে আপনার অনুভূতি জানতে চাই।

শতাব্দী ওয়াদুদ: আমি যখন ‘গেরিলা’ ছবি করেছিলাম তখন মুক্তিযুদ্ধকে অনুভব করেছি একভাবে, আবার যখন ‘জীবনঢুলি’ করেছিলাম তখন ঢোল বাদকের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছি, আর ‘বাপজানের বায়োস্কোপ’ ছবিতে মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছি একেবারেই ভিন্নভাবে। তাই মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে আমার উপলব্ধিটা একটু ভিন্ন। আমরা মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্ম। যুদ্ধকে সরাসরি না দেখলেও গল্প-উপন্যাস ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই জানতে পেরেছি। আর নিজের অভিনীত চলচ্চিত্র কিংবা কাজের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে অনুভব করেছি। এই সময়ে এসে আমার কাছে সবসময় একটা কথাই মনে হয় তা হলো সবকিছুর উপরে দেশ আগে। নানান মত, নানান দল থাকতেই পারে তবে দেশের বিষয়ে আমাদের এক থাকতে হবে।

আনন্দ আলো: আপনি ইমপ্রেস টেলিফিল্ম-এর নতুন ছবি ‘অজ্ঞাতনামা’তেও কাজ করেছেন…

gerilaশতাব্দী ওয়াদুদ: হ্যাঁ। অভিনেতা ও নির্মাতা তৌকীর আহমেদ ছবিটি পরিচালনা করেছেন। এই ছবিতে আমার চরিত্রটি অসাধারণ। এখানে আমাকে একজন ইতিবাচক পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে দেখা যাবে। ছবির গল্পটা একটু অন্যভাবে বলেছেন তৌকীর ভাই। আরো হাতে আছে পি এ কাজল পরিচালিত বাণিজ্যিক ঘরাণার চলচ্চিত্র ‘চোখের দেখা’। এখানে মূল খল নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছি।

আনন্দ আলো: এই আপনি টিভি মিডিয়ায় অভিনয় করে চলচ্চিত্রে পা দিয়েছেন এবং ছবিগুলো দর্শক সমাদৃতও হচ্ছে। মাঝে মাঝে এমন কথাও শোনা যায় যে, টিভি মিডিয়া থেকে যারা অভিনয় কিংবা নির্মাণে আসেন- তাদের ছবি দর্শক গ্রহণ করেন না। এই বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

শতাব্দী ওয়াদুদ: একসময় খান আঁতা, জহির রায়হান, আলমগীর কবীর, আমজাদ হোসেন, চাষী নজরুল ইসলামসহ গুণী অনেক নির্মাতারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন এবং সেইসব ছবি দর্শকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হতো। সেই ছবিগুলো জীবনবোধের কথা বলেছিল। ঐ ছবিগুলোতে পাঁচটা গান, চারটা অ্যাকশন ফাইট কিংবা আইটেম গানের ফরমুলা অনুসরণ করা হতো না। অথচ এখন এই ফরমুলার বাইরের ছবিগুলোকে অনেকে ছবিই বলে না। তারা বলে এগুলো নাকি ‘নাটক’ কিংবা ‘মিডিয়া’র ছবি। এতে করে দর্শক কনফিউজড হয়ে যায়। কোনো দর্শক যদি মনস্থির করে এই ছবিগুলো দেখবেন কিন্তু তাদের এমন মন্তব্যে দর্শক তখন ছবিটি দেখতে আর প্রেক্ষাগৃহে যান না। এফডিসি কেন্দ্রিক নির্মাতা, কলাকুশলী এবং প্রযোজকরা এমন কথা বলেন। অথচ, এই ছবিগুলোই দেশ-বিদেশে নানান জায়গায় বিভিন্ন পুরস্কার অর্জন করেছে। আরেকটি কথা না বললেই নয় তা হলো সারাবিশ্বে চলচ্চিত্রকে আমাদের দেশের মতো এতো ভাগ করে দেখে না। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, সায়েন্স ফিকশন মুভি কিংবা এক মিনিটের চলচ্চিত্রসহ অনেক ধাপ। একটি বিজ্ঞাপনও কিন্তু ফিল্ম। আমার কাছে যেটা মনে হয় কেউ গল্পটা ত্রিশ মিনিটে বলবে, কেউ ষাট মিনিটে বলবে আবার কেউ বলবে দুই ঘন্টায়। আর ছবি হচ্ছে ভালো ছবি কিংবা খারাপ ছবি। ছবির ক্ষেত্রে এই পার্থক্যটা হতে পারে। আমাদের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে নব্বই দশক থেকে পাঁচটা-ছয়টা গান, ফাইট ও আইটেম গানের প্রচলন আসতে থাকে। এখানে হিন্দি-তামিল ও মারাঠি ছবির আদলে যখন স্ক্রিপ্ট লেখা শুরু হলো তখনই এমন চলচ্চিত্রের একটা ফরম্যাট লোকজন ঠিক করে নিলো। কথা হচ্ছে সেই ফরম্যাটের ছবিই যে ‘ছবি’ আর অন্য গল্পের ছবিগুলো ‘ছবি’ নয়- এটা আমি মানতে নারাজ। যেই ছবি মানুষের কথা বলবে, দেশের কথা বলবে, গণমানুষের কথা বলবে, মানুষের অধিকারের কথা বলবে এবং জীবনবোধের কথা বলবে- সেটাকেই আমি ছবি বলবো। এমন ছবি যে আমাদের এখানে দর্শকপ্রিয়তা পায়নি এটা বলা যাবে না। এমন অনেক ছবিই নির্মিত হয়েছে এবং দর্শক তা গ্রহণ করেছে। এমনকি ছবিগুলো জাতীয় পুরস্কারের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছে।

আনন্দ আলো: এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। বর্তমান ব্যস্ততা কী নিয়ে?

শতাব্দী ওয়াদুদ: বিজয় দিবস উপলক্ষে দুটি টেলিফিল্মে অভিনয় করেছি। গোলাম সোহরাব দোদুলের ‘ওয়ার্কশপ’ শিরোনামের টেলিফিল্মে কাজ করেছি। একেবারেই ভিন্ন একটি কাজ। একটি সেমিনারে ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠদানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি আসে। ভিন্ন একটি আইডিয়ার গল্প। আরেকটি ছোঁবল নামে টেলিফিল্মে কাজ করেছি। এছাড়াও প্রচার চলতি ধারাবাহিকের কাজ করছি। আর তো রয়েছেই খণ্ড নাটকের কাজ।

আনন্দ আলো: মঞ্চের ব্যস্ততা কেমন?

Shotabdi-and-Mou-gumশতাব্দী ওয়াদুদ: আমার অভিনয়ের হাতেখড়িই তো মঞ্চে। তাই চাইলেই মঞ্চকে ভুলা সম্ভব নয়। সেই ১৯৯২ সালে থিয়েটারের দল আর্তনাদ দিয়ে আমার অভিনয়ে পথচলা শুরু। আমার চাচা বিশিষ্ট অভিনেতা শহীদুল আলম সাচ্চুর হাত ধরেই আমার অভিনয়ের পথচলা শুরু। পরবর্তী সময়ে দলটির নাম পরিবর্তিত হয়। একটা সময় আমি প্রাচ্যনাট্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। মঞ্চের সঙ্গে আমার এখনো যোগাযোগ আছে।

আনন্দ আলো: মঞ্চ একজন অভিনেতা তৈরিতে কেমন ভূমিকা রাখে?

শতাব্দী ওয়াদুদ: দেখুন, অভিনয়ের ব্যাপারে আমি ছোটবেলা থেকেই পরিবারের প্রচণ্ড সাপোর্ট পেয়েছি। অষ্টম-নবম শ্রেণীতে থাকাকালীন রাত আটটা নয়টা পর্যন্ত মঞ্চে অভিনয়ের চর্চা করেছি, তবে পড়ালেখার ক্ষতি না করে। আমার চাচার (অভিনেতা শহীদুল আলম সাচ্চু) কাছ থেকেই অভিনয়ের বড় প্রেরণা পেয়েছি। অভিনয়ের জন্য নিয়মিত চর্চা করেছি, একজন দক্ষ অভিনেতা হতে প্রয়োজন নিয়মিত চর্চা। আর সেই চর্চা করতে হবে মঞ্চে। মঞ্চই একজন পেশাদার অভিনেতার আসল ক্ষেত্র। আমি মঞ্চের মানুষ, আমি বলব কেউ মঞ্চে সঠিক দিক নির্দেশনায় অভিনয় করলে শতকরা ৮০ শতাংশ অভিনেতা তাকে মঞ্চই বানিয়ে দেয়।

আনন্দ আলো: ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বলবেন-

শতাব্দী ওয়াদুদ: আমার বাবা-মা রয়েছেন। আমার তিন ভাইয়ের মধ্যে আমিই বড়। অন্য দুইজন সমাপ্তি ও অদিতিও মিডিয়ায় কাজ করে। একটা সময় ঢাকার কলাবাগানে আমরা সবাই একসাথে থাকতাম। মূলত আমার ছোটবেলা থেকে অনেক লম্বা একটা সময় কলাবাগানে কেটেছে। আমি বিয়ের পরই নগরীর ইস্কাটনে চলে আসি।  আমার চার বছরের একটা ছেলে আছে। আমার স্ত্রী একটা ইংরেজি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এছাড়াও ছোটবেলা থেকেই নৃত্যের সঙ্গে যুক্ত। ও কত্থক নৃত্য খুব ভালো নাচে। আমাদের প্রাচ্যনাট্যেও সে এখন কাজ করছে।

আনন্দ আলো: নিজের কোনো ইচ্ছা বা স্বপ্ন আছে?

শতাব্দী ওয়াদুদ: অভিনয় নিয়েই থাকতে চাই। খলনায়ক কিংবা তথাকথিত হিরো নয়- আমি অভিনয়টাই করতে চাই। সব ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের মাঝে সারাজীবন বেঁচে থাকতে চাই। আর আমি বড় আয়োজনের দশটি মঞ্চনাটকে অভিনয় করতে চাই।